মাত্র তিন বছর আগে ছোট একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। তারা থাইল্যান্ডের প্রগতিশীল তরুণদের নতুন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হওয়া এবং প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও রাজতন্ত্র অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ওই সময় খুব কম মানুষ ধারণা করেছিলেন যে খুব দ্রুত দলটি দেশটিতে শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
রবিবারের নির্বাচনে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) নামের দলটি প্রতিদ্বন্দ্বী সবাইকে পেছনে ফেলে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সবচেয়ে বড় দলে পরিণত হয়েছে। এমনকি সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল ফেউ থাই পার্টিকেও তারা পিছনে ফেলে দিয়েছে। এই দলটির নেতৃত্ব আবার প্রভাবশালী সিনাওয়াত্রা পরিবারের হাতে।
এই নির্বাচনের ফলাফল থাইল্যান্ডের জনগণের মত পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত। মানুষের জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করা রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
মুভ ফরোয়ার্ড দলের নেতৃত্বে রয়েছে ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক হওয়া পিটা লিমজারোয়েনরাত। তরুণ ভোটারদের মধ্যে ৪২ বছর বয়সী এই নেতার প্রায় সেলিব্রেটির মতো জনপ্রিয়তা রয়েছে। প্রায় সময় তিনি দলের নেতাদের সঙ্গে মিছিলে সেলফি তুলে প্রকাশ করেন। তিনি নিউ জিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছেন। হার্ভার্ড ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেছেন।
এর আগে পারিবারিক কৃষি ব্যবসার নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছে পিটা। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গ্র্যাব নামের দক্ষিণ-পূর্বভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ও ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাপেও কাজ করেছেন তিনি।
দলটির পক্ষ থেকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিবর্তন আনার প্রচার চালানো হয়। এই প্রজন্মটি ২০০৬ ও ২০১৪ সালের দুটি সামরিক অভ্যুত্থান দেখেছে। একটি নতুন ও আরও গণতান্ত্রিক সংবিধান, জেনারেলদের ব্যারাকে ফেরানো এবং বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলটি। তাদের অর্থনৈতিক নীতির মূলে রয়েছে ছোট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা এবং ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
সোমবার পিটা বলেছেন, আমাদের গণতন্ত্রের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমি প্রস্তুত।
দলটির সবচেয়ে বিতর্কিত প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে রাজপরিবারের সম্মান রক্ষার একটি আইন বাতিল করা। এই আইন অনুসারে, রাজপরিবারের মানহানির ঘটনায় ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
পিটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি আইনে পরিবর্তন আনবেন, যাতে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না যায়।
২০২০ সালে তরুণদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার থেকে কয়েকশ’ ব্যক্তিকে আইনটির অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের ধনাঢ্য রাজপরিবার দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরিবারটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রাজপ্রাসাদের সমালোচনা বিরল, মূলত কঠোর আইনটির কারণে। রাজপরিবারের সরকারি ভূমিকা অরাজনৈতিক। যদিও রাজা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অনেক প্রভাবশালী।
কয়েক দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। রাজপরিবারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে স্বীকৃতি দিয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা হয়েছে।
মুভ ফরোয়ার্ড এই রাজকীয়-সামরিক কাঠামোর জন্য একটি প্রত্যক্ষ হুমকি হয়ে উঠেছে। এরা দেশটির পুরনো ও রক্ষণশীল ব্যবস্থার রক্ষক। দলটির তরুণ, যারা অনেক সমৃদ্ধ দেশ ও বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে বেড়ে উঠেছেন, তারা গত শতাব্দীর রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
ব্যাংককের চুলালঙ্কর্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক থিতিনান পংসুধিরাক বলেন, থাই রাজনীতির জন্য এটি একটি নতুন সীমানা। তারা একটি আদর্শবাদী দল, যারা থাইল্যান্ডকে পরবর্তী ধাপ একুশ শতকে নিয়ে যেতে চায়।
২০১৯ সাল থেকে বিরোধী আইনপ্রণেতা পিটা। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত রয়েছেন। তবে মুভ ফরোয়ার্ড দলের ক্ষমতার আসার বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।
রবিবারের নির্বাচনে ৫০০টি আসনের মধ্যে ১৫২টিতে জয় পেয়েছে এমএফপি। এতে এটি বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। অপর গণতন্ত্রপন্থি দল ফেউ থাই পেয়েছে ১৪১টি আসন। দুই দল জোট বাঁধলে তাদের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব। এমন কিছুর পরও ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের পর জান্তা কর্তৃক সংশোধিত আইনের কারণে তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া ঠেকিয়ে দিতে পারবে। আইন অনুসারে, ৩৭৬ জন আইনপ্রণেতার সমর্থন না পেলে যে কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ভেটো দিতে পারবে ২৫০ সদস্যের সিনেট।
এক্ষেত্রে মুভ ফরোয়ার্ডকে ফেউ থাইসহ আরও কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে ভুমিজাইথাই পার্টির সমর্থন পেলে ৩৭৬ আসনের কাছাকাছি তারা পৌঁছে যাবে।
পিটা বলেছেন, ৩৭৬ জনের সমর্থন না পেলেও ভোটারদের রায় স্পষ্ট এবং সিনেটের উচিত এর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। ৩০৯টি আসনের জোট গঠনে কাজ চলছে।
এই অনিশ্চয়তার কারণে সেনাবাহিনী এখনও একটি ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধীদের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকানোর ক্ষেত্রে সামরিক কাঠামোর যেকোনও উদ্যোগ নতুন বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।
ব্যাংককের থাম্মাসাট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রাজাক কঙ্গকিরাতি বলেন, এটি মসৃণ ক্ষমতা হস্তান্তর হবে না। মুভ ফরোয়ার্ড ও ফেউ থাই দলকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে।
তবে আশাবাদী দলটির কর্মীরা। মুভ ফরোয়ার্ডকে ভোট দেওয়া ৩২ বছর বয়সী এক অভ্যর্থনাকারী নামফন হমক্লিন বলেন, আমি আত্মবিশ্বাসী যে থাই রাজনীতিতে এটি একটি নতুন অধ্যায়। এটি কী পরিবর্তন আনে তা দেখতে মুখিয়ে রয়েছি আমি।
সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।