ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে উটের পিঠে দুই পথিক। পেছনে ফেলে আসা মক্কার সেই দীপ্ত চোখের তরুণ, যার কণ্ঠে সত্যের বাণী শুনে কুরাইশদের ষড়যন্ত্র তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সামনে মাটির শহর ইয়াসরিবের দূরত্ব। এ শুধু একটি ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়; এ এক যুগান্তকারী অভিযাত্রার সূচনা, মানব ইতিহাসের এক অমোঘ অধ্যায়। হিজরতের ইতিহাস শুধু একটি ঘটনা নয়, এটি বিশ্বাসের জন্য ত্যাগের মহিমা, এক মহান নেতৃত্বের পরীক্ষা, এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের গল্প। আজও যখন আমরা সেই গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায় স্মরণ করি, হৃদয় কাঁপে সেই অসীম সাহসিকতা, অপরিসীম ধৈর্য আর আল্লাহর ওপর অগাধ ভরসার সাক্ষ্যে। এই যাত্রাপথই তৈরি করেছিল ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র, এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিগন্ত।
হিজরতের ইতিহাস: গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়ের প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতি
হিজরতের ইতিহাস রচিত হয়েছিল এক চরম সংকট ও অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নবুওয়াতের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পর থেকেই মক্কার কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ইসলামের দাওয়াতকে ভয়াবহ হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে। তাদের স্বার্থান্বেষী শাসন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস আর সামাজিক প্রাধান্য এই নতুন সত্যের আলোয় ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ফলস্বরূপ, নবজাগরিত মুসলমানদের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতনের স্টীমরোলার। বিলাল (রা.)-এর মতো দাসদের উপর চালানো হত পাথর চাপা দিয়ে অমানবিক শাস্তি, আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)-এর মতো সাধারন মানুষদেরকে জ্বলন্ত বালুর উপর শুইয়ে পেটে পাথর চাপা দেওয়া হত, শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার ‘অপরাধে’। খাদিজা (রা.)-এর মতো ধনাঢ্য ব্যক্তিও অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়েন। এই অমানবিক অত্যাচার গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায় রচনার আগে অন্ধকার প্রাক্কাল মাত্র।
এই ক্রমবর্ধমান দুর্যোগের মধ্যে রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পেলেন এক নতুন অভিমুখে। ইয়াসরিব (পরবর্তীতে মদিনা) থেকে আগত কিছু প্রতিনিধি আকাবার শপথে ইসলাম গ্রহণ করে নবীজি (সা.)-কে তাদের শহরে আমন্ত্রণ জানান। তারা শুধু নবীজিকে নয়, সমস্ত নির্যাতিত মুসলমানদেরকে আশ্রয় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এই আমন্ত্রণ ছিল ঐশী পরিকল্পনার অংশ। হিজরতের ইতিহাসের এই সূচনালগ্ন ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ। কুরাইশদের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। রাসূল (সা.) নিজে হিজরতের নির্দেশ দিলেন, কিন্তু কাকে কখন কীভাবে যেতে হবে, তা ছিল গভীর গোপনীয়তার বিষয়। প্রতিটি মুহাজিরকে চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। সম্পদ বিক্রি করা, প্রিয়জনের সাথে শেষ দেখা করা – সবই ঘটেছিল গোপনে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। এই গোপন প্রস্তুতি ছিল সেই গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা দেখিয়েছিল মুমিনদের কৌশলগত প্রজ্ঞা ও আল্লাহর নির্দেশে অবিচল বিশ্বাস।
হিজরতের পথে: বিপদ, ত্যাগ ও অলৌকিক সাহায্য
মুসলমানদের জন্য হিজরতের ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর অধ্যায় শুরু হয়েছিল যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কুরাইশ নেতারা বুঝে গিয়েছিল যে মুসলমানদের এই স্থানান্তর তাদের জন্য ভয়ানক হুমকি। তাই তারা নবীজি (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। প্রায় অসম্ভব এক পরিস্থিতিতে, আল্লাহর বিশেষ সাহায্যে, রাসূল (সা.) তাদের ঘেরাও ভেদ করে বেরিয়ে আসেন। সেই রাতেই তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় সাথী আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর সাথে মিলিত হন। এখানেই শুরু হয় হিজরতের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় – সাওর গুহার ঘটনা।
কুরাইশরা নবীজিকে ধরার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। তারা ঘোষণা করেছিল যে মুহাম্মদ (সা.)-কে জীবিত বা মৃত হাজির করতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে। রক্তচক্ষু শিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নবীজি (সা.) এবং আবু বকর (রা.) মক্কার অদূরে অবস্থিত সাওর পাহাড়ের একটি গুহায় তিন দিন তিন রাত লুকিয়ে ছিলেন। এই সময়টুকু ছিল মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভয়াবহ রকমের অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক। কুরাইশ অনুসন্ধানকারীরা গুহার মুখ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছিল! আবু বকর (রা.)-এর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল প্রিয় নবীর নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু রাসূল (সা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, “হে আবু বকর! দু’জনের তৃতীয়জন আল্লাহ হলে তুমি কি ভয় পাও?” (সহীহ বুখারী)। আল্লাহর অলৌকিক কুদরতে মাকড়সা গুহার মুখে জাল বুনে দেয়, একটি পায়রা ডিম পাড়ে, এবং গাছের একটি ডাল সেখানে গজিয়ে ওঠে – যা অনুসন্ধানকারীদেরকে এই ধারণা দিয়েছিল যে কেউ ভিতরে প্রবেশ করেনি। এই অলৌকিক রক্ষাকবচ ছিল হিজরতের ইতিহাসের এক জ্বলন্ত প্রমাণ যে আল্লাহ তাঁর প্রেরিত রাসূলকে রক্ষা করেন। এই গুহাকেন্দ্রিক ঘটনা শুধু একটি আশ্রয়স্থল নয়, এটি ছিল আল্লাহর সাহায্যের এক জীবন্ত নিদর্শন এবং বিশ্বাসের পরীক্ষার এক চূড়ান্ত মুহূর্ত, যা গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়কে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
আলী (রা.)-এর অতুলনীয় ত্যাগ: নবীজির হিজরতের আগের রাতেই ঘটে যায় এক অসামান্য ত্যাগের ঘটনা। কুরাইশ হত্যাকারীদের চক্রান্ত ছিল নবীজির ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে হত্যা করা। রাসূল (সা.) নির্দেশ দিলেন তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা হযরত আলী (রা.)-কে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকতে। আলী (রা.) জানতেন এটা মৃত্যুর ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব। তবুও তিনি বিনা দ্বিধায় রাজি হলেন। ভোরবেলা যখন হত্যাকারীরা তরবারি নিয়ে নবীজির বিছানায় আঘাত হানল, তখন তারা দেখল সেখানে শুয়ে আছেন আলী (রা.)। নবীজির জীবন রক্ষায় আলী (রা.)-এর এই আত্মোৎসর্গ হিজরতের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত। এরপর আলী (রা.) নবীজির আমানত (লোকদের গচ্ছিত সম্পদ) যথাযথভাবে মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েই মদিনার পথে রওনা হন। এই আমানতের প্রতি বিশ্বস্ততা ছিল প্রাথমিক মুসলিম সমাজের নৈতিক ভিত্তির অন্যতম স্তম্ভ।
কঠিন যাত্রাপথ ও সুরাকার ঘটনা: গুহা থেকে বেরিয়ে নবীজি (সা.) এবং আবু বকর (সা.) দক্ষ গাইড আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিতের সহায়তায় মদিনার পথে রওনা হন। পথ ছিল অত্যন্ত দুর্গম, মরুভূমির উত্তপ্ত বালি, অনিশ্চিত গন্তব্য এবং সর্বত্র কুরাইশ অনুসন্ধানকারীদের ভয়। এই যাত্রায় ঘটে যায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কুরাইশ ঘোষিত পুরস্কারের লোভে সুরাকা ইবনে মালিক নামের এক ব্যক্তি তাদের ধাওয়া করে। কিন্তু যখনই সে নবীজির কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করত, তার ঘোড়ার পা বালিতে ডুবে যেত। বারবার ব্যর্থ হয়ে সুরাকা বুঝতে পারল এ কোন সাধারণ ঘটনা নয়। সে অনুশোচনায় ভেঙে পড়ল এবং নবীজির কাছে ক্ষমা চাইল। নবীজি (সা.) তাকে ক্ষমা করলেন এবং ভবিষ্যতে পারস্য সম্রাটের চাবুক পরিধানের সুসংবাদ দিলেন। এই ঘটনাও হিজরতের ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়, যা আল্লাহর হেফাজতের আরেকটি প্রমাণ এবং ভবিষ্যত বিজয়ের ইঙ্গিতবাহী। সুরাকা পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।
মদিনায় পৌঁছানো: স্বাগত ও ভ্রাতৃত্বের নতুন অধ্যায়
কুবায় প্রথম পদার্পণ: কষ্টকর যাত্রার পর রাসূল (সা.) এবং আবু বকর (রা.) সর্বপ্রথম পৌঁছান মদিনার উপকণ্ঠে কুবা নামক স্থানে। সেখানে তিনি কয়েক দিন অবস্থান করেন এবং ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ, মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন। এই মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থানই নয়, হিজরতের ইতিহাসের এক স্মারক স্তম্ভ, যেখানে পথশ্রান্ত মুহাজিররা প্রথমবারের মতো নিরাপদে নামাজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। কুবায় অবস্থানকালে রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করেন।
মদিনায় প্রবেশ: আনন্দের জোয়ার: রাসূল (সা.)-এর মদিনায় প্রবেশ ছিল এক অভূতপূর্ব উৎসবের দিন। আনসার (মদিনার মুসলিম সাহায্যকারী) পুরুষ, নারী ও শিশুরা পথের দু’ধারে সারিবদ্ধ হয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। “তালাআল বাদরু আলাইনা…” (আমাদের উপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে…) – গান গেয়ে তারা তাঁকে বরণ করে নিলেন। প্রতিটি গোত্র তাঁকে নিজেদের ঘরে আমন্ত্রণ জানাল। রাসূল (সা.) তাঁর উটনী কাসওয়ার নির্দেশের উপর ছেড়ে দিলেন। উটনীটি বনু নাজ্জার গোত্রের এক খোলা স্থানে বসে পড়ে, যা ছিল হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর ঘরের সামনে। এভাবেই নির্ধারিত হলো রাসূল (সা.)-এর আবাসস্থল এবং পরবর্তীতে ঐতিহাসিক মসজিদে নববীর স্থান। মদিনায় এই অভ্যর্থনা শুধু একজন ব্যক্তিকে স্বাগত জানানো নয়; এটি ছিল আশ্রয়, ভালোবাসা এবং এক নতুন যুগের সূচনাকে স্বাগত জানানো। এই দৃশ্য গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়ের হৃদয়গ্রাহী সৌন্দর্যকে চিরন্তন করে রেখেছে।
মুহাজির-আনসারের ভ্রাতৃত্ব: একটি অনন্য সামাজিক বিপ্লব
হিজরতের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও বিপ্লবী দিকগুলোর একটি ছিল মুহাজির (মক্কা থেকে আগত অভিবাসী) এবং আনসার (মদিনার সাহায্যকারী)-দের মধ্যে গড়ে ওঠা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। মদিনায় আগত মুহাজিররা প্রায় সবকিছু হারিয়েছিলেন – বাড়ি, ব্যবসা, সম্পদ। তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব। আনসাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেন। রাসূল (সা.) প্রত্যেক মুহাজিরকে একজন আনসারের সাথে ভাই বানিয়ে দিলেন। এই ভ্রাতৃত্ব ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এ ছিল সম্পত্তি, আবাসন এমনকি উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
- আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ও সাদ ইবনে রবি (রা.): সাদ ইবনে রবি (রা.) তাঁর মুহাজির ভাই আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে তাঁর অর্ধেক সম্পদ, এমনকি অর্ধেক স্ত্রীকেও (তালাকের পর বিবাহের প্রস্তাব) দেওয়ার প্রস্তাব দেন! আবদুর রহমান (রা.) কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শুধু বাজারের পথ দেখিয়ে দিতে বলেন এবং নিজের শ্রম ও বুদ্ধিমত্তায় ব্যবসা শুরু করে সফল হন। এই ঘটনা আনসারদের আত্মত্যাগের চরম উদাহরণ।
- সুবিচার ও সহমর্মিতার মূর্ত প্রতীক: আনসাররা তাদের মুহাজির ভাইদের সাথে বাড়ি ভাগ করে নিতেন, খাবার ভাগ করে খেতেন, ব্যবসায় অংশীদার হতেন। তারা মুহাজিরদের নিজেদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এই ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়; এটি ছিল হৃদয়ের গভীর থেকে গড়ে ওঠা এক আধ্যাত্মিক বন্ধন, সামাজিক বিভেদ ও গোত্রীয় দ্বন্দ্বের উপর এক চূড়ান্ত বিজয়। এটি গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়কে চিরভাস্বর করেছে, প্রমাণ করেছে যে সত্যিকারের বিশ্বাস ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়। এই মডেল পরবর্তীতে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে উম্মাহর ধারণাকে সুদৃঢ় করে।
মদিনা সনদ: বহু ধর্মের সহাবস্থান ও রাষ্ট্রীয় ভিত্তি
হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম প্রধান কীর্তি ছিল মদিনা সনদ বা মদিনার সংবিধান প্রণয়ন। এটি ছিল বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন লিখিত সংবিধান, যা একটি বহু ধর্মীয় ও বহু গোত্রীয় সমাজকে এক সুতোয় গেঁথে রাষ্ট্রীয় কাঠামো দিয়েছিল। এই সনদে:
- সকল গোত্রের স্বীকৃতি: ইহুদি গোত্রসহ মদিনার সমস্ত গোত্রকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- সামষ্টিক নিরাপত্তা: মদিনা রাষ্ট্রের (উম্মাহ) বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে সবাই মিলে যৌথ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। “মুসলমান ও ইহুদিরা একে অপরের বিরুদ্ধে অন্য কারো সাথে আঁতাত করবে না।”
- ধর্মীয় স্বাধীনতা: প্রত্যেক সম্প্রদায়কে নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। “ইহুদিদের তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের তাদের ধর্ম থাকবে।”
- আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার: অপরাধ ও বিরোধের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আইনি বিধান এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। “যে কেউ অন্যায় করবে, সে নিজের ও নিজ পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনবে।”
- রাষ্ট্রপ্রধান: বিবাদের ক্ষেত্রে সর্বশেষ সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
মদিনা সনদ ছিল হিজরতের ইতিহাসের সবচেয়ে স্থায়ী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক অবদান। এটি একটি গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়ের সূচনা করেছিল যেখানে ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার ও দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। এটি আধুনিক বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণার এক উজ্জ্বল প্রারম্ভিক উদাহরণ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে মদিনা সনদের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ – প্রাসঙ্গিক নিবন্ধের জন্য অনুসন্ধান করুন)।
হিজরতের শিক্ষা ও আমাদের বর্তমান জীবন
হিজরতের ইতিহাস শুধু অতীতের ঘটনা নয়; এটি এক জীবন্ত শিক্ষা, যার প্রতিটি ধাপ আমাদের ব্যক্তি, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে প্রাসঙ্গিক:
- আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও সাহস: রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবন বিপদে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসার অনন্য উদাহরণ। সাওর গুহার অন্ধকারে, মরুভূমির কষ্টকর পথে – সর্বত্র ছিল আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা। আজকের জীবনের প্রতিটি সংকটে এই তাওয়াক্কুলই আমাদের শক্তি জোগাতে পারে।
- ত্যাগের মর্ম: মুহাজিররা সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন – বাড়ি-ঘর, সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন। আলী (রা.) বিছানায় শুয়ে জীবনবাজি রেখেছিলেন। এই ত্যাগের মহিমা আমাদেরকে স্বার্থপরতা ও ভোগবাদিতা থেকে মুক্ত হতে শেখায়। সত্য ও ন্যায়ের জন্য ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব গড়ে তোলে।
- ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য: মুহাজির-আনসারের ভ্রাতৃত্ব সামাজিক বিভেদ, গোত্রপ্রীতি, বর্ণবাদ ও জাতিগত বিদ্বেষের উপর এক চূড়ান্ত বিজয়। এটি আমাদেরকে সমাজে ভেদাভেদ ভুলে মানবিক বন্ধন ও ঐক্য সুদৃঢ় করতে অনুপ্রাণিত করে। আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে এই শিক্ষা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়ের এই দিকটি চিরন্তন।
- পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি: হিজরত ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ফসল। গোপনীয়তা, নির্ভরযোগ্য গাইড, সময় নির্বাচন – সবকিছুই ছিল সুচিন্তিত। এটি আমাদের শেখায় যে সফলতা অর্জনে সঠিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও কৌশলগত চিন্তা অপরিহার্য।
- ন্যায়বিচার ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: মদিনা সনদ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সকল নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। এটি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক আদর্শ মডেল। এটি আজকের বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সংঘাত নিরসনের পথ দেখাতে পারে।
- সামাজিক দায়িত্ববোধ: আনসারদের আত্মত্যাগ সামাজিক দায়িত্ববোধের সর্বোচ্চ নিদর্শন। অসহায়, অভিবাসী, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। এই হিজরতের ইতিহাসের শিক্ষা সামাজিক সংহতি গড়ে তোলে।
বিশ্ব সভ্যতায় হিজরতের প্রভাব: হিজরতের ইতিহাস শুধু মুসলিম ইতিহাস নয়, এটি বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসকেই প্রভাবিত করেছে। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তীতে বিশাল ইসলামী সভ্যতার বিকাশ ঘটে, যা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, দর্শন, আইন ও চিকিৎসাবিদ্যায় অভূতপূর্ব অবদান রাখে। হিজরত থেকেই ইসলামী পঞ্জিকা (হিজরি সন) শুরু হয়, যা মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
(Final Paragraph – No Heading)
হিজরতের ইতিহাস তাই কেবল একটি অভিবাসনের ঘটনা নয়; এটি বিশ্বাসের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার, ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হওয়ার, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে অটুট হওয়ার এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার এক অমর মহাকাব্য। এটি ইসলামের সেই গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়, যার আলো আজও পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করে। সাওর গুহার অন্ধকারে আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া, কুবায় প্রথম মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, মদিনার পথে আনসারদের উচ্ছ্বসিত স্বাগত আর মুহাজির-আনসারের হৃদয়ছোঁয়া ভ্রাতৃত্ব – এই সবকিছু মিলেই তৈরি হয়েছে এক অবিনশ্বর উত্তরাধিকার। এই ইতিহাস আমাদেরকে শেখায় অন্ধকারে আলোর পথ খুঁজে নেওয়া, বিপদে ধৈর্য ধরা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ভিন্নতাকে সম্মান জানিয়ে একসাথে বাস করার। হিজরতের ইতিহাসের এই শিক্ষাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে, ব্যক্তি জীবনে তাওয়াক্কুল ও ত্যাগের চর্চা করে, সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে – আসুন, আমরা এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে জীবন্ত রাখি। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সংগ্রামই হোক এক আধ্যাত্মিক হিজরত, সত্য ও ন্যায়ের দিকে এক অগ্রযাত্রা।
জেনে রাখুন
হিজরতের ইতিহাসের সাথে জড়িত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখানে দেওয়া হলো:
হিজরত কী এবং কেন এটি সংঘটিত হয়েছিল?
হিজরত হলো ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুসলমানদের মদিনায় অভিবাসন, যা ৬২২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়। মক্কার কুরাইশ নেতাদের অত্যাচার ও নির্যাতন চরমে উঠলে এবং মদিনার আনসারদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে মুসলমানরা এই ঐতিহাসিক স্থানান্তর করেন। এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূচনা। এই ঘটনাই ইসলামি বর্ষপঞ্জি (হিজরি সন) শুরু হয়।
সাওর গুহায় কী ঘটেছিল?
কুরাইশদের হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং আবু বকর (রা.) মক্কার অদূরে সাওর পাহাড়ের একটি গুহায় তিন দিন তিন রাত লুকিয়ে ছিলেন। কুরাইশ অনুসন্ধানকারীরা গুহার মুখে এসে দাঁড়ালেও আল্লাহর কুদরতে মাকড়সা জাল বুনে, একটি পায়রা ডিম পেড়ে এবং গাছের ডাল গজিয়ে ওঠায় তারা ভিতরে কেউ নেই বলে ধারণা করে চলে যায়। এটি হিজরতের ইতিহাসের এক অলৌকিক অধ্যায়, যা আল্লাহর সাহায্যের স্পষ্ট প্রমাণ।
মুহাজির ও আনসার কারা? তাদের ভ্রাতৃত্ব কী ছিল?
মুহাজির হলেন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসা মুসলমানরা যারা সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। আনসার হলেন মদিনার সেই মুসলমান যারা মুহাজির ভাইদেরকে সাহায্য করেছিলেন এবং তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। রাসূল (সা.) প্রত্যেক মুহাজিরকে একজন আনসারের সাথে ভাই বানিয়ে দেন। এই ভ্রাতৃত্ব ছিল অত্যন্ত গভীর; আনসাররা তাদের মুহাজির ভাইদের সাথে সম্পদ, ঘরবাড়ি এমনকি ব্যবসা পর্যন্ত ভাগ করে নিতেন, যা গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম অধ্যায়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
মদিনা সনদ কী এবং এর গুরুত্ব কী?
মদিনা সনদ বা মদিনার সংবিধান ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক প্রণীত একটি লিখিত চুক্তি, যা মদিনাকে একটি বহু ধর্মীয় ও বহু গোত্রীয় রাষ্ট্র হিসেবে সংগঠিত করেছিল। এতে মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রের অধিকার, দায়িত্ব, যৌথ নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান সুস্পষ্ট করা হয়েছিল। রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বোচ্চ সালিশ। এটি বিশ্ব ইতিহাসে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রথম লিখিত সংবিধানগুলোর একটি।
হিজরতের ইতিহাস থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই?
হিজরতের ইতিহাস থেকে আমরা অমূল্য শিক্ষা লাভ করি: আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস (তাওয়াক্কুল) ও ধৈর্য ধারণ, সত্য ও ন্যায়ের জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি, গোত্র, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির গুরুত্ব, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সামাজিক দায়িত্ববোধ। এই শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অপরিহার্য।
হিজরি সন শুরু হয় কীভাবে?
হিজরতের ইতিহাসের সবচেয়ে স্থায়ী প্রভাবগুলোর একটি হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সনের সূচনা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খিলাফতকালে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বছর (৬২২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। এই সন মুসলমানদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
(Disclaimer – If Necessary)
বিঃদ্রঃ: এই নিবন্ধটি ঐতিহাসিক হিজরতের ঘটনা, এর প্রেক্ষাপট, তাৎপর্য এবং শিক্ষা সম্পর্কে তথ্যমূলক আলোচনা করেছে। এখানে বর্ণিত ঘটনাগুলো ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বিবরণ ও হাদিসের ভিত্তিতে লিখিত। ধর্মীয় বিধিবিধান বা ফতোয়া দেওয়া এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো ধর্মীয় সিদ্ধান্তের জন্য নির্ভরযোগ্য আলেম ও ইসলামিক স্কলারদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করা উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।