বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরে যে তিনটি মৌল তৈরি হয়েছিল, তার একটি হিলিয়াম। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই এর উৎপত্তি। এখানে হিলিয়াম মানে, হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। পর্যায় সারণির দ্বিতীয় মৌল। ভরের দিক থেকে হাইড্রোজেনের পরেই এর অবস্থান। বলা বাহুল্য, হাইড্রোজেন সবেচেয়ে হালকা মৌল। দ্বিতীয়তে থাকা হিলিয়াম বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীন নিষ্ক্রিয় গ্যাস। মোট সাতটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মধ্যে এটিই সবচেয়ে হালকা।
মহাবিস্ফোরণের পরে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার বছর পরে ইলেকট্রনগুলো বাঁধা পড়তে শুরু করে নিউক্লিয়াসের আকর্ষণে। এ সময় প্রথম হাইড্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে কিছু হিলিয়াম পরমাণুও তৈরি হয়। অর্থাৎ ইলেকট্রন ঘুরতে শুরু করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের চারপাশে। তবে এরপর হাইড্রোজেন থেকেও তৈরি হতে থাকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে নক্ষত্রের মধ্যে হাইড্রোজেন থেকে তৈরি হয় এ মৌল।
উৎপত্তির মতোই, হিলিয়াম আবিষ্কারের কাহিনিটিও বেশ চমকপ্রদ। এক সময় মানুষ বিশ্বাস করত, নক্ষত্র কী দিয়ে তৈরি, তা আমরা কখনোই জানতে পারব না। ১৮৩৫ সালে ফরাসি দার্শনিক অগাস্টে কোঁতে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা কখনোই নক্ষত্রের রাসায়নিক গঠন জানতে পারব না।’ কোঁতে ভেবেছিলেন, নক্ষত্রের রাসায়নিক গঠন জানতে হলে কোনো নক্ষত্রকে ধরে ঢুকিয়ে দিতে হবে পৃথিবীর কোনো গবেষণাগারে।
অথবা যেতে হবে সেই নক্ষত্রে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। তাই এর পরিচিতি জানাও অসম্ভব। তবে কোঁতেকে ভুল প্রমাণ করে আমরা আজ নক্ষত্রের পরিচয় জানি। জানি তাদের বুকে ঘটে চলা নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার কথা। মানুষ আবিষ্কার করেছে নক্ষত্রের গাঠনিক উপাদান মৌল শনাক্ত করার পদ্ধতি।
১৮১৪ সালের কথা। জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ ফ্রনহফার প্রিজমের সাহায্যে সূর্যের আলোকে সাত রঙে বিভক্ত করেন। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কৃত এ পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি সফলতা পান। ফ্রনহফার প্রিজম ব্যবহার করে সূর্যের আলোয় কিছু কালো রেখা লক্ষ্য করেন। এটাই ছিল কোনো নক্ষত্রের বর্ণালির প্রথম পর্যবেক্ষণ।
১৮৫৯ বা ৬০ সালের মধ্যে জার্মান বিজ্ঞানী গুস্তাভ কার্শফ এবং রবার্ট বুনসেন বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করেন, ফ্রাউনহফারের দেখা কালো রেখাগুলো কোনো পদার্থের ছাপের মতো। ১৮৬০ সালে এই দুই বিজ্ঞানী নীল বর্ণালি রেখা থেকে সিজিয়াম আবিষ্কার করেন। পরের বছর ১৮৬১ সালে লাল বর্ণালি রেখা থেকে আবিষ্কার করেন রুবিডিয়াম।
একই বছর ব্রিটিশ রসায়নবিদ উইলিয়াম ক্রুকস একটি উজ্জ্বল সবুজ বর্ণালি রেখা পর্যবেক্ষণ করে থ্যালিয়াম আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানী কার্শফ এবং বুনসেন সূর্যের বর্ণালি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে আসেন যে সূর্যের বায়ুমণ্ডলে লোহার উপস্থিতি আছে। পরে আমরা জানতে পারি, তাঁদের এই আবিষ্কার হিলিয়াম খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল।
১৮৬৮ সালের ১৮ আগস্ট। ফরাসি জ্যোতির্বিদ পিয়েরে জ্যানসেন একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের অপেক্ষায় ছিলেন। এজন্য তিনি ভারতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তাঁর আর তর সইছিল না। সূর্যগ্রহণের আগেই পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন সূর্যের করোনা অঞ্চল। তখন তিনি যে গ্যাসগুলোর বর্ণালি পর্যবেক্ষণ করেন, তার মধ্যে একটি হলুদ রেখা দেখতে পান। এই হলুদ রেখাটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল ১৮ দশমিক ১৮৬৮ ন্যানোমিটার। তবে তিনি এই তরঙ্গদৈর্ঘের উৎস শনাক্ত করতে পারেননি।
এর দুই মাস পরে ইংরেজ জ্যোতির্বিদ নরম্যান লকইয়ার লন্ডনে তাঁর নিজস্ব স্পেকট্রোস্কোপ বা বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করেন। লকইয়ার ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার-এর প্রথম সম্পাদক। তিনিও পিয়েরে জ্যানসেনের দেখা হলুদ রেখাটি দেখতে পান। এ সময় তিনি আরেক ব্রিটিশ রসায়নবিদ এডওয়ার্ড ফ্রাঙ্কল্যান্ডের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করছিলেন।
লকইয়ার হলুদ রেখাটি সম্পর্কে জানান এডওয়ার্ডকে। তাঁরা দুজনে হলুদ রেখাটি নিয়ে আলোচনা করেন। রেখাটি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনার কথা ভাবেন। এটা যে একটা নতুন মৌল হতে পারে, সে বিষয়েও ভেবেছিলেন এ দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু তিনি সে আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেননি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।