২০১৮ সালের নভেম্বরের হে জিয়ানকুই একটা ইউটিউব ভিডিওতে একটি ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীকে চমকে দেন। তিনি জানান, পৃথিবীর প্রথম জিনোম সম্পাদিত শিশুর জন্ম হয়েছে। নিশ্চয়তা দিয়ে বলার উপায় নেই যে একদম সঠিক জায়গায় জিনোম সম্পাদনাটি হবে। জিনোমে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ফলে অনাগত শিশুর মৃত্যুব্যাধিও হতে পারে।
দ্বিতীয় কারণ হলো নৈতিক অনিশ্চয়তা। মানবশিশুর জিনোম চিরতরে বদলে দেওয়ার নৈতিক যৌক্তিকতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আলোচনা করছেন বহুকাল ধরেই। এর মাধ্যমে যে পরিবর্তন হবে, তা কি ভবিষ্যতে অসম সমাজ তৈরি করবে? সন্তানদের জিনোমে কী পরিবর্তন করা হবে, এটা ঠিক করার অধিকার কার? সরকার পরিবর্তন বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে? বা বাস্তুসংস্থানের দিক থেকে দেখলে মানবগোষ্ঠীর মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্যতা কমে আসবে? আরও অনেক প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায় বিজ্ঞানীদের।
তৃতীয় কারণ হলো সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। জিনোম সম্পাদনা করা যে কতটা বিতর্কিত এক ব্যাপার, তা বোঝা যায় শস্যের জিনোম সম্পাদনার বিরুদ্ধে উন্নত বিশ্বের সামাজিক আন্দোলন থেকে। মোনার্ক প্রজাপতির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমার পেছনে জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য (জিএমও) দায়ী কি না, এই প্রশ্ন উঠেছে। জিএমও খেলে শরীরে কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া হয় কি না, তা নিয়েও তুলকালাম লেগে গিয়েছিল।
আরেকটা কারণ হলো বিজ্ঞানী হিসেবে হে–এর যোগ্যতা। চীনের অখ্যাত এক তরুণ গবেষক হে জিয়ানকুই। তিনি স্নাতক করেছেন চীনে পদার্থবিজ্ঞানে ও পিএইচডি করেছেন আমেরিকার রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে, বায়োফিজিকসে। তিনি বেশ সম্ভাবনা দেখিয়েছেন গবেষক হিসেবে এবং একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেছেন। কিন্তু জিনোম সম্পাদনার মৌলিক কোনো বিষয় নিয়ে তাঁর নেই কোনো পূর্ববর্তী গবেষণা।
ঘোষণাটা দেওয়া হয়েছে ‘দ্য হে ল্যাব’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতে। হে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারা তাঁর এই গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানে না। যেকোনো গবেষণার প্রস্তাবকেই একটা এথিকস রিভিউ বোর্ডে পাস করিয়ে নিতে হয় গবেষকদের, হে তার ধার ধারেননি। অথচ তিনি দাবি করছেন, তাঁর সব কাজ এথিকস বোর্ডে পাস করানো। এ–সংক্রান্ত নালিশেই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা হারান।
তৃতীয়ত, হে জিয়ানকুই আজ পর্যন্ত তাঁর এই গবেষণাকর্ম কোথাও প্রকাশ করেননি। প্রকাশনার কাছাকাছি যেটা করেছেন সেটা হলো, হংকংয়ে হওয়া দ্বিতীয় মানব জিনোম সম্পাদনার আন্তর্জাতিক সামিটে এসে বক্তৃতা দেওয়া। এ সময় একটা এক্সেল স্প্রেডশিটে কিছু তথ্য দেখিয়েছেন। হে জিয়ানকুই ছাড়া কোনো গবেষক এখনো তাঁর করা কাজকে পর্যালোচনা ও যাচাই করার সুযোগ পাননি।
ইউটিউব ভিডিওতে হে নিজের কাজকে সমর্থন করে যে কথা বলেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেন চীনের এইডস আক্রান্ত রোগীদের ক্লেশ। এরা সমাজে অচ্ছুতের মতো জীবন যাপন করে। সুতরাং তিনি তাদের সন্তানদের এইচআইভি প্রতিরোধী করে তুলতে চেয়েছেন ক্রিসপার ব্যবহার করে। তিনি বলেন, ‘অনুগ্রহ করে স্মরণ করুন, আমার কাজের অনেক উচ্চস্বর সমালোচনা হবে, তবে অনেক নিশ্চুপ পরিবার আছে, যারা একটি শিশুকে বংশগত রোগ থেকে ভুগতে দেখে। এই কষ্টের মধ্য দিয়ে তারা আরও যাবে, সেটা উচিত না। এই মানুষগুলো হয়তো কোনো এথিকস সংস্থার মহাপরিচালক নয়, যার কাছে থেকে নিউইয়র্ক টাইমস–এর সাংবাদিক বাণী নেবেন, কিন্তু কী উচিত বা অনুচিত, এটা ঠিক করার অধিকার তাদের কোনো অংশে কম নয়। কারণ এটা তাদেরই জীবন।’ হাততালি দেওয়ার মতোই কথা। কিন্তু নিজে কী করেছেন হে জিয়ানকুই?
তাঁর গবেষণার পদক্ষেপগুলো সংক্ষেপে বললে প্রথমে বলতে হয় বিস্ময়কর কিছু মানুষের কথা। এইডস রোগে এই পৃথিবীর কিছু মানুষ কখনোই আক্রান্ত হবে না, কারণ তাদের জিনোমে একটা মিউটেশন আছে। এই মিউটেশনটাকেই হে কৃত্রিমভাবে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে দিতে চাচ্ছিলেন, নতুন জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে যেন তারা কখনো এইডস আক্রান্ত না হয়। এই উদ্দেশ্য মহৎ, নিঃসন্দেহে।
হের দেখানো তথ্য থেকে সামিটে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেন যে জিনোম সম্পাদিত শিশু দুটির সব কোষে সম্পাদনা হয়নি। অর্থাৎ যে দাবি করা হচ্ছে, শিশু দুটির এইডস হবে না কখনো, সে দাবিটিও ভুল। ফলে জিনোম সম্পাদনার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। এটি ছাড়া তাঁর এই কাজে আরও অনেক ত্রুটি সন্দেহ করা হয়েছে। সব তথ্য প্রকাশ না করাতে এগুলো যাচাই করা যাচ্ছে না। মোটকথা, হে জিনোম সম্পাদনার মতো ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেননি ও কাজটাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রাচ্যের গবেষকদের দুর্নাম আছে, তাঁরা তথ্য নিয়ে কারচুপি করা, নীতি না মেনে গবেষণা করা, ভুল ফলাফল প্রকাশ করা ইত্যাদি। হে হতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি জিনোম সম্পাদিত মানবশিশুর জন্মে কাজ করেছেন। তাতে তিনি সফল হয়েছেনও। প্রথম টেস্টটিউব সন্তান আইভিএফের মাধ্যমে জন্ম দেওয়ার কৃতিত্ব যেমন বয়ে এনেছিল সম্মান ও নোবেল পুরস্কার ড. রবার্ট এডওয়ার্ডসের জন্য, হে জিয়ানকুই সেটাও চেয়েছিলেন। সেটার উল্টোটা পেলেন। এখন শেষমেশ তিনি প্রতীক হয়ে গেলেন ‘প্রাচ্যের সেই খারাপ বিজ্ঞানীগুলো’র, যাঁরা অসৎ পথে খ্যাতি ও যশ কামাতে চান। তিনি জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ইতিহাসে একটি কলঙ্কের অধ্যায়ও যোগ করলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।