রঞ্জু খন্দকার : তখন হেমন্তের হেলেপড়া বিকেল। সূর্যের তেজ কমে গিয়ে এর তেরছা কিরণ পড়েছে সুরা মসজিদের গায়ে। হলুদাভ সে রশ্মি যেন এক লহমায় আমাদের নিয়ে গেল প্রায় পাঁচ শ বছর আগে সুবা বাংলার নবাবী আমলে।
সুরা মসজিদের অবস্থান উত্তরের ঐতিহ্যবাহী জনপদ ঘোড়াঘাটে। এটি দিনাজপুরের মধ্যে পড়লেও গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার একেবারে কাছে। বাড়ি পলাশবাড়ী হওয়ায় এক সঙ্গীর মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে সম্প্রতি যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল ‘কিংবদন্তী’র মসজিদটিতে।
স্থাপনাটি স্থানীয়ভাবে সৌর ও সুজা মসজিদ নামেও পরিচিত। এটি নিয়ে যেসব কিংবদন্তী প্রচলিত তার একটি হচ্ছে, জিনেরা অনেক পরিশ্রম করে এক রাতে তৈরি করেছেন ইট ও পাথরে গড়া স্থাপনাটি। সূর্য ওঠার আগেই তৈরি হয়েছে বলে এটি সৌর বা সুরা নামে পরিচিত হয়।
এলাকাটি তুলনামূলক নির্জন হওয়ায় হঠাৎ যে কারও কাছে এমন কিংবদন্তীর সত্যতার বিষয়ে ধন্দও তৈরি হতে পারে। তাই তো, এমন পাণ্ডববর্জিত এলাকায় এমন একটি আলিশান মসজিদ কে বা কারা তৈরি করবেন! কেনই বা করবেব? এখানে মসজিদ তৈরির লোকবল, এমনকী মুসল্লিই বা পাওয়া যাবে কোথায়?
আরেকটি কিংবদন্তী হলো, মুঘল সম্রাট শাহ সুজা স্থাপনাটি তৈরি করিয়েছেন। সে কারণে এটি সুজা মসজিদ নামেও পরিচিতি পায়। তবে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, সুজা দিল্লির সম্রাট হওয়ারও আগের স্থাপনা এটি।
কিংবদন্তীর মসজিদটি ঘোড়াঘাট উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে চৌগাছার সুরা এলাকায় অবস্থিত। এর পাশে কয়েকটি চা পানের দোকান গড়ে উঠেছে। সেখানকার কয়েকজন জানালেন, তাঁদের দাদা, পরদাদারাও এই মসজিদ তৈরির ইতিহাস জানেন না। তবে বংশ পরম্পরায় এখানে নামাজ পড়ে আসছেন তাঁরা।
মোটরসাইকেলে আমার সহসওয়ারী শাহওয়াজ কবির পলাশবাড়ীর সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তাঁর ভাষ্য, রাতারাতি মসজিদ বা মন্দির তৈরি হওয়ার গল্প উত্তরের এই অঞ্চলের ‘কমন কাহিনি’। ফলে লোককথায় কান দেওয়ার সুযোগ আসলেই কম।
দুপক্ষের চাপান-উতোর উজিয়ে আমরা চললাম স্থাপনাটি চাক্ষুষ করতে। পূর্বদিক দিক থেকে ঢুকতেই অতিশয় উঁচু প্রাচীরের বাঁধা। এত উঁচু প্রাচীর সাধারণত ধর্মীয় স্থাপনায় দেখা যায় না। তবে প্রাচীরের অধিকাংশই ক্ষয়ে গেছে। সবদিকে এখন আর নাই।
মূল মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। দেখতে বর্গাকার। এর সামনের ভাগে একটি বারান্দা আছে। পূর্ব পাশ থেকে কয়েকটি ধাপ সিঁড়ি চত্বর পর্যন্ত উঠে গেছে। সব কোণে আছে অষ্টভুজ স্তম্ভ, মোট স্তম্ভের সংখ্যা ছয়।
এর পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দিকে আছে তিনটি কারুকাজখচিত মিহরাব। নামাজের কক্ষটি একটি গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজে আচ্ছাদিত।
বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, মসজিদটির বর্গাকার নামাজকক্ষের প্রত্যেক পাশের দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৯ মিটার। কার্নিস রীতিমাফিক বাঁকানো। মসজিদের বারান্দা জুড়ে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদের সঙ্গে এই গম্বুজগুলির সাদৃশ্য আছে।
ইমারতটির বহির্গাত্রে গোলাপ ও অন্যান্য লতাপাতার নকশাখচিত পোড়ামাটির কারুকাজ আছে। জ্যামিতিক আকৃতির কিছু নকশাও দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলাপিডিয়া আরও জানাচ্ছে, মসজিদের ভেতরের মিহরাবগুলো সম্পূর্ণরূপে পাথরের তৈরি ছিল। মধ্যবর্তী মিহরাবটি সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত। এর শিকল ও ঘণ্টার মোটিফ, লতাপাতার নকশা, লেখ্যপটের মোটিফ এবং জ্যামিতিক আকৃতির নকশাগুলো করা হয়েছে বেশ চমৎকারভাবে। গম্বুজগুলোর ভিত পোড়ামাটির কারুকার্যখচিত ইট দ্বারা অলঙ্কৃত।
আমরা দেখি, মসজিদের সামনেই সুবিশাল পুকুর। সেখানে একপাল হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। সামনে শানবাঁধানো ঘাট। মুসল্লিদের অযু-গোসলের জন্যই নিশ্চয় এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখনো সেই ব্যবস্থা অটুট আছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে চাপকল, টিপকলও।
মসজিদ ঘুরে আমরা গিয়ে বসলাম পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোনার পাড়ে আমগাছতলায়। সেদিকে তখন বিস্তৃত ধানখেত। কৃষক আপন মনে হৈমন্তী ফসল ধান কাটছে। পাড়ে বসে বিশ্রামের ফাঁকে আমরা আবার চলে গেলাম গুগলের জ্ঞানের ভাণ্ডারে।
জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, সুরা মসজিদ থেকে কোনো লিপিফলক পাওয়া যায়নি। তবে এ স্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে চম্পাতলী এলাকায় আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলের একটি শিলালিপি আবিস্কৃত হয়েছে। তাতে ৯১০ হিজরি (১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দ) উল্লেখ আছে। এতে একটি মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, এই লিপির সঙ্গে সুরা মসজিদের সম্পর্ক আছে, তাহলে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দ বলে ধারণা করা যায়। এটির নির্মাণশৈলীর সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদের সামঞ্জস্য রয়েছে। এর ভিত্তিতে পুরাতত্ত্ববিদ আহমদ হাসান দানী এটিকে হোসেন শাহী আমলের বলে মনে করেন।
সব দেখে শুনে মনে হলো, যে বা যাঁরা মসজিদটি তৈরি করেছিলেন, প্রথম প্রার্থনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরা আজ কে কোথায়। প্রকৃতির নিয়ম কী অমোঘ! কত কাল পরেও কত স্মৃতিস্তম্ভ রয়ে যায়, শুধু স্মৃতি তৈরি করা মানুষগুলোই আর থাকে না!
ততক্ষণে সুরা মসজিদের পুকুরে চড়ে বেড়ানো হাঁসের দল ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। হেমন্তের হেলেপড়া বিকেল তখন সন্ধ্যার সন্নিকটে। কিংবদন্তীর সুরা মসজিদ পেছনে ফেলে মোটরসাইকেলের সিলিন্ডারে ধোঁয়া ও ধূলা উড়িয়ে আমরা রওনা করি সময়ের সাথে, আমাদের পথে।
১৯৭১ সালের পর প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে এসেছে পাকিস্তানের জাহাজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।