জুমবাংলা ডেস্ক : উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কৃষি উদ্যোক্তা হওয়া এখন আর কোনো ব্যতিক্রমী উদাহরণ নয়। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই কৃষির নতুন নতুন খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে তরুণরা এগিয়ে আসছেন।
ফলের বাগান, মৎস্য খামার, সবজি ও মসলা চাষের মতো উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনে এখন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। এর বাইরে গিয়েও ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টা করছেন অনেকে। তেমনি একজন মোখলেছুর রহমান (৩৫)।
কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া মোখলেছুর রহমান পড়াশোনা করে হতে চেয়েছিলেন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। কিন্তু ঢাকা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি মেলামাইন কোম্পানিতে চাকরি নেন তিনি। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে নিজের স্বপ্ন পূরণে গ্রামের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ী গিয়ে শুরু করেন কফি চাষ।
মোখলেছুর রহমান বলেন, ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছা থেকেই কফি চাষ শুরু করি। এখন কফি গাছের ফল আহরণ শুরু হয়েছে। চলবে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। বাগানের গাছ থেকে তোলা ফল প্রক্রিয়াজাত করে স্থানীয়ভাবেই বানানো হচ্ছে পানের উপযোগী কফি।
এ বছর কফি বাগানে খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। এবার নিজেই প্রক্রিয়াজাত করে কফি বিক্রি করবেন তিনি। এতে লাভ বেশি হবে। তার লক্ষ্য, এবার তিনি ৩০ লাখ টাকার কফি বিক্রি করবেন।
গত ২৮ অক্টোবর থেকে নিজের বাগানের পাশে কফিশপ চালু করেছেন তিনি। সেখানে নিজের বাগানের উৎপাদিত কফি বিক্রি করছেন। পরবর্তীতে পাশের বগুড়া, রংপুর ও সৈয়দপুর শহরসহ বিভিন্ন স্থানে কফি সরবরাহ করবেন বলে জানান তিনি।
তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গোয়ালপাড়া গ্রামে মোখলেছুরের কফি বাগান। তার পাশেই চালু করেছেন এই কফিশপ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাগান-জুড়ে থোকায় থোকায় ধরে আছে কফি ফল। সবুজ পাতার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল, হলুদ রঙের পাকা ফল। কোনোটা অবশ্য এখনো পাকেনি। সেগুলোর রং সবুজ। গাছের উচ্চতা ছয় থেকে সাড়ে ছয় ফুট।
কফি চাষের শুরুর দিকের কথা প্রসঙ্গে মোখলেছুর রহমান জানান, প্রায় ৭ বছর আগে ইউটিউবের মাধ্যমে জানতে পারেন পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢালু জমিতে কফির চাষ হচ্ছে। তখন তার ভাবনায় আসে তারাগঞ্জের মাটিও তো ঢালু। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলে এখন চা উৎপাদন হচ্ছে। তাহলে এখানেও তো কফি চাষ হতে পারে। পরে চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন।
২০১৭ সালের শেষে চট্টগ্রামের একটি নার্সারি থেকে ৮০০ কফির চারা নিজের ২৮ শতক জমিতে রোপণ করেন। এর মধ্যে ৪৫০টি চারা টিকে যায়। দুই বছরের মাথায় প্রথম ফল আসে। এরপর থেকে প্রতি বছরই ফল আহরণ করছেন তিনি। একটি গাছে ফল ধরে প্রায় তিন হাজার। আর একটি ফল থেকে বীজ আসে বারোটা। তাতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ জনের কফি পাওয়া যায়।
অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে কফি চাষ লাভজনক বলে মনে করেন মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, একর প্রতি হিসাব করলে খরচ বাদে কফি বাগান থেকে বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
তিনি ২৮ শতক জমি থেকে ২০১৯ সালে প্রথমবার কফি বিক্রি করেন ছয় হাজার টাকার। এর পরের দুই বছর তিনি যথাক্রমে পৌনে দুই ও পৌনে তিন লাখ টাকার করে কফি বিক্রি করেন। ২০২২ সালে তিনি প্রায় পাঁচ লাখ টাকার কফি ও চারা বিক্রি করেন।
কফি চাষের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে মোখলেছুর রহমান বলেন, প্রথমত, অন্য চাষিরা এই চাষ সম্পর্কে তেমন জানেন না। দ্বিতীয়ত, কফি চাষে প্রথম দুই বছর ফলন পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র চাষিরা এই সময়টুকু দিতে চান না। জমি ফেলে রাখতে চান না।
তবে ধীরে-ধীরে কফিচাষ জনপ্রিয় হচ্ছে বলে জানান মোখলেছুর। তিনি বলেন, তার এলাকায় এখন তিনটি কফি বাগান। তার দেওয়া চারা দিয়ে পঞ্চগড়, বগুড়া ও নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় ৫০টির বেশি বাগান হয়েছে। তিনি নিজে এসব চাষিকে বাগানের বিষয়ে নানা পরামর্শ দেন।
কফি নিয়ে অনেক স্বপ্ন মোখলেছুরের। তিনি বলেন, কফি বিশ্বের অন্যতম বড় শিল্প। তিনি দেশে এই শিল্পের বিকাশে কাজ করতে চান। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে কফির প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিদেশে রপ্তানিও করতে চান তিনি। এরই অংশ হিসেবে তিনি বাগানের পাশেই কফিশপটি চালু করেছেন। তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের কফি চাষে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে সরকারকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে এখন ব্যাপকভাবে চা চাষ হচ্ছে। কফি চাষের জন্য উষ্ণ (২০-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা) ও আর্দ্র জলবায়ু এবং বার্ষিক ১৫০-২০০ সে.মি. বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। আর ফল পরিপক্ব হওয়ার সময় শুষ্ক আবহাওয়া প্রয়োজন পড়ে। মৃদু অম্লধর্মী এবং লৌহ, পটাশ, নাইট্রোজেন ও জৈব-সমৃদ্ধ উর্বর লালচে দো-আঁশ মাটি কফি চাষের জন্য আদর্শ। এছাড়াও তীব্র সূর্যালোকের হাত থেকে কফি গাছকে রক্ষার জন্য বাগানের মধ্যে ছায়া প্রদানকারী যেমন- ইপিল, একাশিয়া, কলা প্রভৃতি গাছ লাগানো প্রয়োজন। আবহাওয়াগত-ভাবে রংপুর অঞ্চলের মাটি চা ও কফি চাষের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। এ কারণে আগ্রহী কফি চাষিকে সব রকম সহয়তা দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) শামিমুর রহমান বলেন, তারাগঞ্জ উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার মাটি জলবায়ুর কারণেই কফি চাষের উপযোগী। কফি চাষ করতে অমিয় মাটর (কম খরা সম্পন্ন মাটি) প্রয়োজন হয়। তাই এ অঞ্চলের মাটি বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ উপযোগী। রংপুরে কফি চাষ জনপ্রিয় করতে কৃষি বিভাগও কফির চারা উৎপাদন করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উৎপাদিত কফি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।