এ কে এম শাহনাওয়াজ : আমাদের দেশের বাস্তবতায় চমকে যাওয়ার মতো নতুন কোনো বিষয় নয়, তবু একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ে খুব খারাপ লাগল। ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, কিশোরগঞ্জে স্থাপিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে ভোররাতে এক নবীন ছাত্রের ওপর চড়াও হয়েছে চতুর্থ ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রলীগকর্মী। র্যাগিংয়ের নামে নির্মম নির্যাতন করেছে ছেলেটির ওপর। আহত ছাত্রটিকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে।
ছাত্রটি অন্যদের মতোই মেধাচর্চার ফল হিসেবে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছে। ভর্তি হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে নিজের, পরিবারের ও দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু স্বপ্নযাত্রার শুরুতেই ওকে হোঁচট খেতে হলো।
ছাত্রলীগ নামের ক্ষমতাশালী বড় ভাইদের নির্যাতনে তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এখন বিপন্ন।
দুই দশক আগেও আমাদের দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের নামে বর্বরতার এমন প্রকাশ দেখা যায়নি। এই নিকৃষ্ট সংস্কৃতি নাকি আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। ওখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং চলত।
আমি গবেষণার কাজে ১৯৯১-৯২ সালে কলকাতায় ছিলাম। তখন মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে র্যাগিংয়ের নামে নির্মমতার খবর ছাপা হতো। অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে দেখেছি। এ সময় আমার এক চাচাতো ভাইয়ের ছেলে খড়গপুর আইআইটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হয়েছিল। একদিন ওর বাবা অর্থাৎ আমার ভাই কলকাতার বাসায় এসে হাজির।
খড়গপুর থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। র্যাগিংয়ের বীভৎসতা ওর মুখে শুনলাম। ও নিজেও র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে একাধিকবার। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে কৈশোর পেরোনো তরুণ ছেলেটি। ও আর পড়বে না। বাবাও পড়াবেন না ওখানে। আমি দীর্ঘক্ষণ ওদের সঙ্গে কথা বললাম। মানসিক দিক থেকে ওকে অনেকটা সুস্থ করে ফেরত পাঠিয়েছিলাম কলেজে। ওখানে শেষ পর্যন্ত ভালো ফল করেছিল। এখন বাংলাদেশ সরকারের বড় প্রতিষ্ঠানে বড় পদে চাকরি করছে।
ভারতের নানামুখী কৃতিত্ব আমরা ধারণ করতে না পারলেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা র্যাগিং নামের অন্ধকার সংস্কৃতি ক্ষমতাবান ছাত্র-ছাত্রীরা সহজেই গ্রহণ করে এবং দাপটের সঙ্গে প্রয়োগ করে সতীর্থ জুনিয়রদের ওপর। এভাবে নাকি ওরা জুনিয়রদের স্মার্ট করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দাপট দেখানোর ক্ষমতা একমাত্র সরকারদলীয় ছাত্রদের। বিএনপির আমলে এসব দাপট যেমন ছাত্রদল দেখিয়েছে, এখন ছাত্রলীগ দেখাচ্ছে। বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে যান। এখন ছাত্রলীগও তেমন বেপরোয়া। ক্যাম্পাসে যেকোনো অপকর্ম হলেই মানুষ প্রথম ধরে নেয় এসব ছাত্রলীগের কর্ম।
এদের লাগাম টানতে পারেন একমাত্র দলীয় নেতারা। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তাঁরা তো সোনার ছেলেদের পিঠ চাপড়াতেই ব্যস্ত। ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে তাঁরা নাকি এসব ছাত্রকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরার জন্য প্রস্তুত করছেন। ছাত্রলীগের এসব নেতাকর্মী সোনার ডিম না পাড়লেও সোনার ডিম তো জোগাড় করে দেন। সুতরাং তাঁদের সব অনাচারের সাতখুন মাপ।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার জানার চেষ্টা করেছিলাম র্যাগিংয়ের নামে কারো ওপর চড়াও হচ্ছে কেন এবং অত্যাচারের ধরন কী!
জানলাম, কারণ খুবই তুচ্ছ। উপলক্ষ মাত্র। যেমন—কোনো ক্ষমতাবান বড় ভাইকে সালাম দেয়নি কেন, এক প্যাকেট সিগারেট আনতে বলেছিল এনে দিতে দেরি হয়েছে কেন, মিছিলে আসেনি কেন? এমন সব অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু এসবের শাস্তি অসাধারণ। কান ধরে সবার সামনে ১০০ বার উঠবস করা, শীতের রাতে পুকুরে গলাপানিতে আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, চুল কামিয়ে দেওয়া, উলঙ্গ হয়ে দাঁড় করানো। এ ছাড়া চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি তো আছেই।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীরা, যারা মা-বাবা আর পরিচিত পরিবেশ রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠেছে, কেমন মানসিক প্রতিক্রিয়া হবে ওদের! মাঝে মাঝে শোনা যেত র্যাগিংয়ের অত্যাচার সইতে না পেরে সূচনায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছে ঘরে। একবার এক সিনিয়র ছাত্রী জানাল, ওদের হলে ছাত্রলীগ নামধারী ছাত্রীদের কয়েকজন নবীন ছাত্রীদের র্যাগ দিচ্ছিল। ছাত্রীটি সিনিয়র হওয়ার সুবাদে প্রশ্ন করেছিল, কেন তোমরা এভাবে নির্যাতন করছ। ওরা বলল, আমরা আসলে ওদের স্মার্ট বানাচ্ছি। আমি বললাম, সব শুনে তো মনে হলো ওদেরই আগে স্মার্ট হতে হবে। এমন নিম্নমানের মানসিকতা নিয়ে ওরা কিভাবে আরেকজনকে স্মার্ট বানায়! কারো কারো আবার সরল উক্তি, আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে এসেছিলাম, সিনিয়ররা আমাদেরও র্যাগ দিয়েছে। আমরা এখন শোধ নেব না কেন!
এসব শুনে আমি ফিরে যাই ৪৬ বছর আগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবেরুনী হলে কক্ষ বরাদ্দ পেয়েছিলাম। আমার রুমমেট ছিলেন মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আলাউদ্দিন ভাই। পাশের কক্ষে ছিলেন আমার দুই বছরের সিনিয়র ফিজিকসের আতাউর রহমান ভাই। বাকি প্রতিবেশীরা আমারই মতো নবীন। আমি হলে ওঠার পর আতাউর ভাই দেখা করতে এলেন। পরিচিত হলেন। নানাভাবে অভয় দিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন নিচে। হল অফিস চিনিয়ে দিলেন। সন্ধ্যায় স্যাররা এলে কিভাবে ডাইনিংয়ের খাবারের কুপন নিতে হয় সব বুঝিয়ে দিলেন। পরদিন বিকেলে আমাকে নিয়ে গেলেন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। দেখালেন কিভাবে ক্যাটালগ থেকে বইয়ের কল নম্বর নিতে হয়ে। রিডিং রুমে পড়ার নিয়ম, বই উত্তোলন করার নিয়ম—সব শিখিয়ে দিলেন। বড় ভাইদের সহযোগিতায় আমার একাকিত্ব কেটে গেল। অল্পদিনের মধ্যেই রুমমেট আলাউদ্দিন ভাই বুঝলেন ভালো রেজাল্ট করার লক্ষ্যে আমি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছি। আমার সুবিধার জন্য প্রায় সময়ই তিনি চারতলায় বন্ধুর কক্ষে পড়াশোনা করতেন। রাতেও থেকে যেতেন। এই সোনালি দিনগুলো তাই আমার কাছে এখনো উজ্জ্বল। ক্লাসরুমে বা কোথাও বক্তৃতা করতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে এসব স্মৃতিচারণা করে আনন্দ পাই। আর ভাবি—আহা, এ সময়ে র্যাগিংয়ের নামে সিনিয়র ভাই-বোনের অত্যাচারে মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত ছাত্র-ছাত্রীরা স্মৃতিতে কী ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাবে!
কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এতে কিছুটা সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। এখন অনেকটা লুকিয়ে-চুরিয়েই হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে অন্য জায়গায়। র্যাগিং হলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দাখিল করতে বলা হয়েছে। কিন্তু র্যাগিং হলেও অভিযোগ করার কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একমাত্র দাপুটে দল ছাত্রলীগ। এই র্যাগিংয়ের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ছাত্রলীগের সম্পর্ক থাকে। ফলে মার খেয়েও মুখ বন্ধ রাখাটা শ্রেয় মনে করে নবীন শিক্ষার্থীরা। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারি। হলগুলোতে এখন প্রভোস্ট, হাউস টিউটরদের নিয়ন্ত্রণ তেমন নেই। বেশির ভাগ হলে সিট বণ্টন থেকে শুরু করে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাত্রনেতাদের কর্তৃত্বেই সম্পাদিত হয়। তাঁদের অখুশি করে হল চালানো নাকি অনেকটা কঠিন। অমন বাস্তবতায় র্যাগিং বন্ধ করার সাধ্য কি হল কর্তৃপক্ষের!
তবে হ্যাঁ, ব্যাপারটা যদি উল্টো হতো। হলগুলোতে যদি র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারত, তবে র্যাগিং থেকে আরোগ্য লাভ করা সহজ হতো। কিন্তু এমনটি হলে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ববাদ দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে এই দলের নেতারা এমন পথে হাঁটবেন বলে মনে হয় না।
তাহলে সারকথা হচ্ছে, র্যাগিংয়ের অভিশাপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে রক্ষা করতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন নয়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু তাঁরা কিভাবে সে দায়িত্ব নেবেন? দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তাঁরাও কি কম কর্তৃত্ববাদী হয়েছেন? কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক সংসদ অধিবেশনের ফুটেজ দেখলাম। সেখানে একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও দলের বড় নেতাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করলেন। উত্তরে মন্ত্রী অভিযোগ খণ্ডন না করে সংসদেই হুমকি দিলেন। বললেন, ‘ছাড় দিচ্ছি বলে ছেড়ে দেব না।’ এমন বাস্তবতায় ক্ষমতাধর নেতাদের শিষ্যরা ক্যাম্পাসে সবার ওপর ছড়ি ঘোরাবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
আমি ভাবি অন্য কথা। এসব নষ্ট রাজনীতির কথা ছেড়ে দিই। যেসব সিনিয়র ছাত্র সদ্য ক্যাম্পাসে আসা সতীর্থদের ওপর র্যাগিংয়ের নামে নিবর্তন চালায়, ওদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে না-ই বা ভাবলাম। ওরাও তো মানুষ। মানবিক গুণও নিশ্চয় হারিয়ে যায়নি। কোনো এক ভদ্র পরিবার থেকে এসেছে। তাহলে ওরা এতটা অমানবিক হয়ে পড়ে কেমন করে? নবাগত ছোট ভাই-বোনদের সহযোগিতা করার বদলে কিভাবে নির্যাতনকারী হয়ে যেতে পারে? বিবেক কিভাবে সায় দেয়? র্যাগিং করে ছোটদের স্মার্ট বানানোর দায়িত্ব ওদের কে দিয়েছে?
বয়সের চাঞ্চল্যে হিরোইজম দেখাতে গিয়ে নিজেদের যে ছোট করে ফেলছে এই সত্যটি বিবেচনায় আনতে হবে। ছাত্রজীবন পার হয়ে যাওয়ার পর জীবনের আরেক ধাপে পৌঁছবে সবাই। সে সময়ে একান্ত ভাবনায় একজন নির্যাতনকারী হিসেবে নিজের ছবিটি যখন ভেসে উঠবে, তখন কি আত্মপীড়ন হবে না? কোথাও থেকে পাওয়া অসুস্থ ধারা নয়, আমরা সুস্থ সংস্কৃতিরই চর্চা করতে চাই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।