তারেকুজ্জামান শিমুল, বিবিসি বাংলা : ‘ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর আমার হাত-পা কাঁপতেছিলো,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ভুক্তভোগী ফারজানা আক্তার বিথী।
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা জালগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মিজ বিথীর মা হাড়ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। মাকে নিয়ে সম্প্রতি তিনি গিয়েছিলেন একই জেলার বেসরকারি মুন হাসপাতালে।
সেখানে তার মাকে অ্যাকলাস্টা নামের একটি ইনজেকশন দেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক, যেটি মূলত তৈরি করে থাকে সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি।
ওষুধটি মিজ বিথী কিনেছিলেন চিকিৎসকের সহকারী বিজয় সরকারের কাছ থেকে। পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন যে, তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
‘উনি (বিজয় সরকার) নিজে হাতেই ইনজেকশনটা পুশ করেন। এরপর আমি ইনজেকশনের শিশিটার একটি ছবি তুলতে চেয়েছিলাম আমার ভাইকে পাঠাবো বলে। কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বার বার শুধু প্যাকেটের (ওষুধের মোড়কের) ছবি তুলতে বলছিলেন,’ বলেন বিথী।
এ ঘটনায় তার মনে সন্দেহ জাগে। তখন মিজ বিথী রীতিমত জোরাজুরি করে ওষুধের শিশিটা হাতে নেন।
‘হাতে নিয়ে দেখি সেটা আসলে অ্যাকলাস্টা না। আরেকটা কোম্পানির ওষুধের নামের ওপর আঠা দিয়ে অ্যাকলাস্টার নাম বসিয়ে বিক্রি করা হয়েছে,’ বলছিলেন মিজ বিথী।
পরে জানা যায়, যে ইনজেকশনটি দেওয়া হয়েছিল, সেটিও হাড়ক্ষয় রোগেরই ওষুধ। তবে সুইজারল্যান্ডের কোনও প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং ইনজেকশনটি তৈরি করেছে দেশিয় একটা কোম্পানি।
অথচ বিদেশি ওষুধ হিসেবে বিক্রি করে দাম রাখা হয়েছে কয়েক গুণ বেশি।
‘ছয় হাজার টাকার ওষুধ উনি আমার কাছে ৩৪ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছে। হাসপাতালের মানুষই যদি এমন কাজ করে, তাহলে আমরা কোথায় যাবো?,’ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন মিজ বিথী।
কুমিল্লার এই ভুক্তভোগির মতো অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশে রয়েছেন, যারা ওষুধ কিনতে গিয়ে নানাভাবে প্রতারণা ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
এক্ষেত্রে বিদেশি বলে দেশি ওষুধ হাতে ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি ঘটছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম রাখার ঘটনাও।
এদিকে, কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও “খেয়াল-খুশি মতো” ওষুধের দাম বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। গত এক বছরে কোনো কোনো ওষুধের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
‘সব মিলিয়ে, ওষুধখাতে এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ওষুধ কিনে খাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে, সার্বিকভাবে যা জাতীয় স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন।
অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি
‘ফল বেঁইচা যে টাকা ইনকাম হয়, হেইডা দিয়া ভাত খামু, না ওষুধ কিনমু? বুইঝা পাই না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকার মিরপুর এলাকার ফল বিক্রেতা আব্দুল মতিন।
মি. মতিনের সত্তরোর্ধ্ব মা গেঁটে বাতসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত। মায়ের চিকিৎসায় প্রতিমাসেই তাকে প্রায় হাজারখানেক টাকার ওষুধ কিনতে হয়। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় ওষুধের খরচ যোগাতে এখন তাকে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে।
‘আগে যেইখানে এক হাজারের মধ্যে সবডি ওষুধ হইয়া যাইতো, এখন সেইখানে দেড়-দুই হাজারেও কুলাইয়া উঠতে পারতেছি না। তাইলে আমগো মতো গরিম মানুষ ক্যামনে বাঁচবো?,’ বলেন মি. মতিন।
গত এক বছরে গ্যাস্ট্রিক, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস সহ বেশ কিছু রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত দুই ডজনেরও বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। এর মধ্যে কোনো কোনো ওষুধের দাম ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তারা।
তেমনই একটি ওষুধের নাম ‘অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স-৫০০’। গেঁটে বাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত এই ওষুধটির প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ২১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আর দাঁত ব্যথার ওষুধ মারভ্যান-১০০ মিলিগ্রামের ১০ পাতার একটি বক্স আগে যেখানে চারশ’ টাকায় বিক্রি হতো, এখন সেটির দাম তিনশ’ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতশ’ টাকায়।
গ্যাস্ট্রিক ও আলসারজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ফ্যামোট্যাক ২০ মিলি গ্রামের একপাতা ওষুধের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে।
একইভাবে, অ্যাজমা ও ফুসফুসজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত ডক্সোমা ট্যাবলেটের বক্সপ্রতি দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে এখন চারশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
‘বছর বছর ওষুধের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শেষকালে ওষুধের অভাবেই মরতে হয় কী-না, সেই ভয়ে আছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন হাঁপানি রোগে আক্রান্ত সুফিয়া বেগম।
বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানি গুলো ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে তারাও বিপাকে পড়েছেন।
‘আমরাও তো বিপদে আছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকার অন্যতম বড় ওষুধ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান লাজ ফার্মার কলাবাগান শাখার মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসাইন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মি. হোসাইন আরও বলেন, ‘কোম্পানি দাম বাড়ানোর কারণে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করে আমাদের ওষুধ কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় বেঁচা-বিক্রি বাড়েনি, বরং মূল্য বৃদ্ধির ফলে কিছুক্ষেত্রে বিক্রি কমছে।’
এর আগে, গত বছরের শুরুর দিকে ওষুধের দাম বাড়তে দেখা গিয়েছিল। তখন প্রায় অর্ধশত ওষুধের দাম ২০ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছিল।
এরপর ক্যাবের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল যে, ইচ্ছামতো ওষুধের দাম বাড়ানো যাবে না।
বাড়তি মূল্যের অভিযোগ
ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। এর মধ্যে আবার পাওয়া যাচ্ছে, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রির অভিযোগও।
‘সামান্য গ্যাসের ওষুধ, সেইটাও অনেক সময় বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সিফাত আহমেদ।
ওষুধের দাম বেশি রাখার এই প্রবণতা ঢাকার বাইরে বেশি বলেও দাবি করেন তিনি।
‘ঢাকায় একপাতা সার্জেল টোয়েন্টির দাম কত? ৭০ টাকা। কিছুদিন আগে একটা কাজে আমাকে নরসিংদী যেতে হয়েছিল। সেখানে সার্জেলের পাতার দাম চাইলো পাঁচাত্তর টাকা,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমেদ।
রাশেদুল ইসলাম নামের আরেক ক্রেতাও একই রকম অভিযোগ করেছেন।
পেশায় ব্যবসায়ী মি. ইসলামের স্ত্রী নূর জাহান বেশ কয়েক মাস ধরে ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এ সমস্যার সমাধানে মিজ জাহানকে ‘মিলক্যাল’ নামের একটি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।
মি. ইসলাম বলছেন, ওষুধটি একেক ফার্মেসিতে একেক দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
‘একই ওষুধ, অথচ কোথাও এটির দাম রাখা হচ্ছে ৫৫০ টাকায়, আবার কেউ কেউ এটা বিক্রি করতেছে ৬২০ টাকায়। এই হলো অবস্থা,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. ইসলাম।
মি. ইসলাম ও সিফাত আহমেদের মতো আরও অনেকেই ফার্মেসিগুলোর বিরুদ্ধে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রির অভিযোগ করেছেন বিবিসি বাংলার কাছে।
খোঁজ নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে।
প্যাকেটের গায়ে লেখা দাম অনুযায়ী, মিলক্যাল ট্যাবলেটের ৬০টি বড়ির একটি কৌটার খুচরা বিক্রয় মূল্য ছয়শ টাকা।
কিন্তু ঢাকার মিরপুর, গাবতলী, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, শাহবাগ, লালবাগ, বংশালসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো ফার্মেসিতে ওষুধটি পাঁচ থেকে দশ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
মূলতঃ পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে গড়ে ওঠা ফার্মেসি গুলোতে ওষুধের দাম বেশি রাখতে দেখা গেছে।
‘দোকানের ভাড়া বাড়ছে। কিছু বেশি না রাখলে পোষায় না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কল্যাণপুর এলাকার একজন বিক্রেতা। অন্যদিকে, ওই একই ওষুধ অনলাইনভিত্তিক একাধিক প্ল্যাটফর্মে সাড়ে পাঁচশ টাকাতেও বিক্রি করতে দেখা গেছে।
একই রোগের ওষুধের ভিন্ন ভিন্ন দাম
রোগ একটাই, কিন্তু কোম্পানি ভেদে সেটার ওষুধের দামে বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের ওষুধের বাজারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা ওষুধগুলোর একটি হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ।
স্বাস্থ্যখাতের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল স্ট্যাটিসটিকস হেলথের’ (আইএমএস হেলথ) তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এককভাবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ১০টি ওষুধের মধ্যে পাঁচটিই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ।
এর মধ্যে বিক্রির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ‘সার্জেল’। আইএমএস হেলথ তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে ওষুধটির বিক্রির আর্থিক পরিমাণ ছিল ৯১৮ কোটি টাকা।
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সার্জেল ২০ মিলিগ্রামের প্রতিটি ক্যাপসুল ফার্মেসি বিক্রি হচ্ছে সাত টাকা দরে।
একই রোগের জন্য তৈরি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সেকলো ২০ মিলিগ্রামের প্রতিটি ওষুধের দাম রাখা হচ্ছে ছয় টাকা। আবার গণস্বাস্থ্য ফার্মার জি-ওমিপ্রাজল ২০ মিলি গ্রামের প্রতিপিস বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিন টাকায়।
অন্যদিকে, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রোগাট মাপস ২০ মিলি গ্রামের একটি ওষুধের দাম রাখা হচ্ছে আট টাকা।
‘একই রোগের ওষুধের কেন এত রকম দাম থাকবে? আবার দামের মধ্যে এত পার্থক্যও-বা কেন থাকবে?,’ প্রশ্ন রাখেন ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন।
দামবৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক?
বাংলাদেশে ওষুধের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয় বলে অভিযোগ ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।
‘এখানে কিছুদিন পরপরই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। বিশেষ করে, অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস যেসব ওষুধের চাহিদা বেশি, সেগুলোর দাম যে প্রক্রিয়ায় বাড়ানো হয়, সেটার কোনো যৌক্তিকতা নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ক্যাবের নেতা এস এম নাজের হোসাইন।
‘অসুখে ভোগা সাধারণ মানুষের জন্য এগুলো মড়ার ওপরে খাড়ার ঘায়ের মতো। কাজেই এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ,’ বলেন মি. হোসাইন।
ওষুধখাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে দুই শতাধিক ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, যারা বছরে ২৭ হাজারেরও বেশি রকমের ওষুধ উৎপাদন করছে।
এর মধ্যে ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। বাকি ওষুধগুলোর মূল্য ধার্য করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
‘এটার কারণে আমরা দেখি, বেশিরভাগ ওষুধের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরকার খুব একটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। বেশি মুনাফার লোভে কোম্পানিগুলো খেয়াল-খুশি মতো দাম নির্ধারণ করে,’ বলেন মি. হোসাইন।
যদিও ক্যাবের এই অভিযোগ অস্বীকার করছে উৎপাদক কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি’র নেতারা।
‘কোনো ওষুধের দামই অযৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হয় না। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা ওষুধের মূল্য নির্ধারণ বা সমন্বয় করে থাকি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন।
গত এক বছরে যেসব ওষুধের দাম বেড়েছে, সেগুলো জন্য ওষুধের কাঁচামাল, উৎপাদন ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে দায়ি করছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামালের খরচ তো বেড়েছেই, তার চেয়েও বেশি বেড়েছে পরিচালন ব্যয়,’ বলেন ডা. হোসেন।
ওষুধের কারখানায় শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন আগে ছিল আট হাজার টাকা। পাঁচই অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সেটি বাড়িয়ে এখন ১৪ হাজার টাকা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিকরা।
‘এতে আমাদের কস্টিং (খরচ) অনেক বেড়ে গেছে। এখন সেটা যদি আমরা ওষুধের দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারি, তাহলে তো কোম্পানি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না,’ বলেন ওষুধ শিল্প সমিতি মহাসচিব।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ওষুধের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সরকারের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
‘উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে ওষুধ উৎপাদনের খরচ অনেক কম। কারণ ওষুধের কাঁচামাল, মেধাস্বত্ত্বসহ অনেকগুলো ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ ছাড় পেয়ে থাকে। কাজেই সেই ছাড় পাওয়া পরও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক, সরকারের সেটি খতিয়ে দেখা উচিৎ,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় আরও নতুন নাম যুক্ত করে সেগুলোর দাম নির্ধারণ করার তাগিদ দিয়েছেন মুশতাক হোসেন।
সেই সঙ্গে, ফার্মেসিতে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রির পেছনে আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকাকেই দায়ি করছেন তিনি।
‘ওষুধের বাড়তি দামে সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে হবে এবং সেটা ঠিকমত মানা হচ্ছে কী-না তার জন্য মনিটরিংয়ের (নজরদারি) বিষয়ে ওষুধ প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে,’ বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।
কী বলছে ওষুধ প্রশাসন?
বাংলাদেশে ওষুধের দামের বিষয়টি নজরদারি করে থাকেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। নিয়ম অনুযায়ী, ওষুধের দাম বাড়ানোর আগে কোম্পানিগুলোকে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়।
‘এক্ষত্রে প্রতিটি কোম্পানি তাদের কস্টিং শিট (খরচের হিসাব) আমাদের কাছে জমা দেয়। তখন আমরা প্রথমে সেটার সঙ্গে দেশের অন্যান্য কোম্পানির ওষুধের কস্টিং চেক করি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আসরাফ হোসেন।
‘অনেক ক্ষেত্রে ভারতসহ আশপাশের দেশের উৎপাদন খরচের সঙ্গেও তুলনা করে তারপর একটা ওষুধের দাম নির্ধারণ বা সমন্বয় করা হয়ে থাকে,’ বলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এই পরিচালক।
এবারও সেই একই প্রক্রিয়া মেনে কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
‘তবে ওষুধের দাম পাঁচ থেকে সাত শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়নি। ভোক্তা ও উৎপাদক কোম্পানি কেউই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা মাথায় রেখে আমরা কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করেছি,’ বলেন মি. হোসেন।
তাহলে কিছু ওষুধের দাম দ্বিগুণ করা হলো কোন যুক্তিতে?
‘ওগুলোর ব্যাপার আলাদা,’ বলেন পরিচালক আসরাফ হোসেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আমি যতটুকু জানি, ওই ধরনের ওষুধের দাম বেশ আগেই বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রচার ও বাজার ধরার কৌশল হিসেবে কিছু কোম্পানি এতদিন লসে (ক্ষতি মেনে নিয়ে) ওষুধ বিক্রি করছিল। এখন তারা সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে বলেই দাম বেড়ে গেছে।”
তারপরও বাড়তি দামের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এই পরিচালক।
এদিকে, কোম্পানিগুলো এতদিন ক্ষতি মেনে নিয়ে ওষুধ বিক্রি করেছে- এই যুক্তি মানতে নারাজ ক্যাবের নেতা এস এম নাজের হোসাইন।
‘এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সত্যিই এমনটা হয়ে থাকলে উৎপাদন খরচের তথ্য পাবলিক করা হোক,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসাইন।
‘কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেটি প্রকাশ্যে আনা হোক। আমরা মনে করি, দাম বৃদ্ধির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভোক্তাদের সঙ্গেও ওষুধ প্রশাসনের কথা বলা উচিৎ,’ বলেন তিনি।
ফার্মেসিগুলোতে ন্যায্যমূল্যে ওষুদের দাম যে সবসময় নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেটা প্রশাসনও স্বীকার করছে।
‘আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু জনবলসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে এখনও আমাদের সংকট রয়ে গেছে,’ বলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আসরাফ হোসেন।
তিনি আরও বলেন, ‘সেজন্য ভোক্তাদের কাছে আহ্বান জানাবো, ওষুধের দাম কোথাও বেশি রাখা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানান। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।’
শাস্তি হয় কতটা?
বাজারে ন্যায্য দামে ওষুধের বিক্রি নিশ্চিত করোর ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগের প্রতি জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘এক্ষেত্রে নিয়মিত বাজার মনিটরিং (নজরদারি) করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির স্থাপন করাটা গুরুত্বপূর্ণ,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবতা হচ্ছে, নির্ধারিত দামের চেয়ে ওষুধের মূল্য বেশি নেওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে কঠোর শাস্তির নজির সেভাবে দেখা যায় না।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ বেশি দামে ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করলে তাকে সর্বোচ্চ এক বৎসর কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
কিন্তু অতীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যত অভিযান চালানো হয়েছে, সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির নজির কমই দেখা গেছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অল্প কিছুদিনের জেল বা জরিমানা করতে দেখা গেছে, যা যথেষ্ঠ নয় বলে মনে করেন অনেকে।
‘বাড়তি দামে ওষুধ বিক্রির ঘটনা যে থামছে না, সেটার জন্য অপরাধীর লঘু দণ্ডও একটা বড় কারণ,’ বলেন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন।
কুমিল্লার মুন হাসপাতালে ফারজানা আক্তার বিথী ও তার মায়ের সঙ্গে যে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
যদিও অভিযুক্ত বিজয় সরকার নিজ মুখেই কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেছেন।
‘আসলে আমার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল। সেজন্য কাজটা করছি। আমি ভুল স্বীকার করছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. সরকার।
ঘটনার পর মি. সরকারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রশাসন, কাউকেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।-বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।