আব্দুল হামিদ : ঢাকা থেকে সাভারে যাওয়ার পথে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেছিলেন মিজানুর রহমান। যোগাযোগ করে জানতে পারেন, প্রজেক্টেটি টেরানোভা ডেভেলপমেন্টস কোম্পানির। রাজধানীর কল্যাণপুরে প্রধান সড়কের পাশেই ‘টেরানোভা সেফ হ্যাভেন’ নামে নতুন প্রজেক্টে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকায় একটি ফ্ল্যাট (এ–৩) এবং ৪ লাখ টাকায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা বুকিং দেন ভোলার একটি ইটভাটার মালিক মিজানুর।
কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মিজানুর তার ফ্ল্যাট বুঝে পাবেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের ৩ বছর পার হয়ে গেলেও তালবাহানা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে আইন আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ওই ব্যবসায়ী। সম্প্রতি তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে ফ্ল্যাট বুঝে পেতে একটি আবেদন করেন। এর আগে আদালত অর্থ আত্মসাতের একটি মামলাও করেন তিনি।
কল্যাণপুরে প্রধান সড়কের পাশেই ‘টেরানোভা সেফ হ্যাভেন’ প্রজেক্টে ১০ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করে টেরানোভা ডেভেলপমেন্টস। ওই ভবনে ৪০টি ইউনিট করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৩টি ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে কোম্পানিটি। এর মধ্যে মিজানুর এ–৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি কেনার জন্য চুক্তি করেন।
ব্যবসায়ী মিজানুর বলেন, শখ করে ঢাকার একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলাম। কিন্তু আজকে সেখানে থাকা তো দূরের কথা, শখের ফ্ল্যাটটি বুঝে পাওয়ার আশায় দৌড়াতে দৌড়াতে অসুস্থ হয়ে গেছি।
জানা যায়, ফ্ল্যাট ও কার পার্কিং বাবদ ৬৫ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্য নির্ধারিত হয়। ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি ৫ লাখ টাকা বায়না করে দু’পক্ষের মধ্যে তিনটি ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি হয়। পরে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। পরে ২২ কিস্তির মাধ্যমে বাকি টাকা পরিশোধ করেন মিজানুর। চুক্তিপত্রে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে মিজানুরকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিতে পারলে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া বাবদ দেওয়ার কথাও চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত ১৮ মাসে ওই কোম্পানির কাছে মিজানুরের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
এদিকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মিজানুরকে ১৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির নোটিশ পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। নোটিশে ১৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধিবাবদ ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকাসহ আরও ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৬ টাকা দাবি করে ফ্ল্যাট বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে ২০২৩ সালের ২৫ জুন বাড়তি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করে নিতে বলা হয়। অন্যথায় অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দেয়। এরই মধ্যে ২০২৩ সালের জুনে কয়েকজনকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার মাসে মূল্যবৃদ্ধির নোটিশ দেখে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন ভুক্তভোগী মিজানুর। পরে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানকে আইনি নোটিশ পাঠান। তাতেও কাজ না হওয়ায় আইনের আশ্রয় নেন মিজানুর। তিনি গত বছরের ২৫ জুলাই আদালতে ফ্ল্যাট জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় টেরানোভা ডেভেলপমেন্টস, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম, তার স্ত্রী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাসনোভা মাহবুব সালাম, হেড অব বিজনেস আসরাফুল আলম এবং হেড অব মার্কেটিং সেলস সালেক ইমরান খানকে আসামি করা হয়।
আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেন। পরে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান মামলাটি তদন্ত করেন। তদন্তে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম ও এমডি তাসনোভার বিরুদ্ধে ফ্ল্যাট জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং আশরাফুল ও ইমরানের বিরুদ্ধে হুমকির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে আসামিরা উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করেন।
উচ্চ আদালত ৩ মাসের মধ্যে ভুক্তভোগীকে তার ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার শর্তে আসামিদের ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু এখনও আসামিরা ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়নি বলে অভিযোগ মিজানুরের। তিনি আরও দাবি করেন, ১৩৬০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট দেওয়ার চুক্তি হলেও এ–৩ নম্বরের ওই ফ্ল্যাটের আয়তন ১১০০ বর্গফুট।
টেরানোভা ডেভেলপমেন্টস প্রজেক্টে ফ্ল্যাট কিনেছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি চুক্তিপত্রের শর্ত মানে না। ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার সময় বিভিন্ন টালবাহানা করে। এ ছাড়া এখানে ফ্ল্যাট কেনা লোকজনের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির সেসব শর্ত মেনে ফ্ল্যাট বুঝে নিয়েছে। এরপরও এখন পর্যন্ত দুজন ফ্ল্যাট বুঝে পায়নি বলে শুনেছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানের এমডি তাসনোভা মাহবুব সালাম ও হেড অব মার্কেটিং সেলস সালেক ইমরান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি। একপর্যায়ে তারা ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান বলেন, টেরানোভা ডেভেলপমেন্টস ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর সঙ্গে করা চুক্তিপত্রের চেয়ে কয়েকশ বর্গফুট কম আয়তনের ফ্ল্যাট তৈরি করেছে। এমনকি ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করেছে। এ ছাড়াও তাকে হুমকি দেওয়া হয়, যা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। তারা ফ্ল্যাট বিক্রির নামে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।