আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ‘কোয়ারেন্টাইন’ ইংরেজি শব্দ। শব্দটি প্রথম প্রচলিত হয় ই্তালি থেকে। প্রায় ৭০০ বছর আগে থেকেই রোগবালাই দমনে ব্যবহার হয়েছে সামাজিক দূরত্ব ও মানুষকে একাকী রাখার পদ্ধতি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়া দমন করতে সামাজিক দূরত্ব তৈরি (সঙ্গ নিরোধ) এবং কোয়ারেন্টাইনের (নির্জনবাস) নিয়ম শুরু হয়েছিল প্রায় ৭০০ বছর আগে। ১৩০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপ ও এশিয়ার ছড়িয়ে পড়েছিলো ব্ল্যাক ডেথ নামের একটি সংক্রামক রোগ। বলা হয়ে থাকে এটি প্রথম ছড়িয়েছিল পণ্যবোঝাই জাহাজ থেকে। বেশিরভাগ নাবিক মারা গিয়েছিলেন। রোগ নয় যেন খুব দ্রুত মৃত্যু ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীতে।
সেই মধ্যযুগের কথা। বুবোনিক প্লেগের ভয়ানক থাবা গ্রাস করে ফেলেছিল পুরো পৃথিবীকে। আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর তিনভাগের একভাগ মানুষ। বুবোনিক প্লেগের ধ্বংসাত্মক প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করা সে সময়ে অনেকটাই অসম্ভব ছিল। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নিয়ে ন্যূনতম ধারণাও ছিল না। তাদের কাছে কেবল ছিল ব্ল্যাক ডেথ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৩৪ সালে জারি করা হয়েছিল সামজিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টাইন (নির্জনবাস)।
ইতালির ভেনিস এবং মিলান শহরে বুবোনিক প্লেগ প্রবেশ করে ১৩৪৪ সালে। সাথে সাথেই শহরের কর্মকর্তারা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এটিকেই এখন ‘কোয়ারেন্টাইন’ বলা হচ্ছে।
অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক ইউরোপীয় রোগ ইতিহাসের প্রবীণ প্রভাষক জেন স্টিভেন ক্রেশো বলেছেন, ‘সে সময়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বুঝেছিলেন যে পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছে সে সম্পর্কে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। তাই ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি যোগাযোগ সীমাবদ্ধ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছিল।’
প্রথম কোয়ারেন্টাইন
দক্ষিণ ক্রোয়েশিয়ার ডুব্রোভনিক নগরের আড্রিয়াটিক বন্দরে প্রথম কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। তারাই সর্বপ্রথম এমন আইন পাস করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বন্দরে আসা জাহাজ বা ক্যারাভেনকে জীবাণু আছে কিনা, তার জন্য স্ক্রিন না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ডুব্রোভনিক আর্কাইভে ওই আদেশ আজও সংরক্ষিত আছে। ওই নগরীর মেজর কাউন্সিলের পাসকৃত আইনে বলা হয়, ‘যারা প্লেগ-আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আগত তারা (রাগুসা বর্তমান ডুব্রভনিক) বা তার জেলায় প্রবেশ করতে পারবেন না যদি না তারা নিজেদের জীবাণুমুক্ত করতে ম্রকান দ্বীপে একমাস অবস্থান না করে।’
‘টমিক ইন এক্সপ্লেইনিং দ্য প্লেগ: দ্য হেলথ অফিস অ্যান্ড দ্য ইমপ্লিমেনটেশন অফ কোয়রেন্টাইন ইন ডুব্রোভনিক’ নামক আর্টিকেলে বলা হয়, রাগুসা শহরের দক্ষিণে একটি জনবহুল পাথুরে দ্বীপ ছিল ম্রকান। এটি ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত কাফেলার রাস্তার শেষে অবস্থিত ছিল। প্লেগ না ছড়াতে ওই দ্বীপকেই ব্যবহার করেছিল রাগুসার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
ওই আর্টিকেলে টমিক বলেছেন, কিছু চিকিৎসা-ইতিহাসবিদ রাগুসার পৃথককরণ বা কোয়ারেন্টাইন নির্দেশকে মধ্যযুগীয় চিকিৎসার অন্যতম সাফল্য বলে মনে করেন। ৩০ দিনের জন্য স্বাস্থ্যকর নাবিক এবং ব্যবসায়ীদের বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দিয়ে রাগুসান কর্মকর্তারা একটি ইনকিউবেশন সময় পার করাতেন। নতুন আসা ব্যক্তিদের প্লেগের লক্ষণ না থাকলেও তারা রোগমুক্ত কিনা তা নির্ধারণ করতে তাদের যথেষ্ট সময় ধরে আটক রাখা হত।
১৩৭৭ সালে কোয়ারেন্টাইনের ৩০ দিনের মেয়াদটি ইতালীয় ভাষায় ‘ট্রেন্টিনো’ হিসাবে পরিচিত ছিল। তবে অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিভেনস ক্রেশো বলেছেন, ‘চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদেরই এই সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘতর কোয়ারেন্টাইন আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। ইতালিতে ৪০ দিনকে আদর্শ কোয়ারেন্টাইন সময় বলে মানা হয়।
কোয়ারেন্টাইন ৪০ দিন কেন?
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ৪০ দিনের জন্য পৃথককরণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর কারণ মধ্যযুগীয় খ্রিস্টানদের কাছে এই সংখ্যাটি প্রতীকী এবং ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বাইবেলে আছে, যখন ঈশ্বর পৃথিবীতে বন্যা করেছিলেন, তখন ৪০ দিন এবং ৪০ রাত বৃষ্টি হয়েছিল এবং যীশু প্রান্তরে ৪০ দিন উপবাস করেছিলেন।
স্টিভেনস ক্রেশো তার লেখায় দেখালেন, প্লেগ আসার আগেও বিশুদ্ধ হতে ৪০ দিনের সময়কালটি বাইবেলের ধারণা। যেমন প্রসবের পরে একজন নতুন মা ৪০ দিনের জন্য বিশ্রাম নেন। এখন নতুন কোয়ারেন্টাইনে ১৪ দিনের নির্জনবাসের নিয়ম। তবে রাগুসা শহরে যদি কোয়ারেন্টাইন পালনে কঠোর নির্দেশ দেওয়া না হতো, তাহলে রোগের প্রাদুর্ভাবে বাণিজ্যে টিকে থাকা ওই সামুদ্রিক শহরটি হয়ত আর বাঁচতো না পৃথিবীর বুকে।
ক্রেশো মনে করেন, ‘সামাজিক ভাঙ্গন, ব্যাপক আতঙ্ক বা আত্মত্যাগের পরেও মহামারি ঝুঁকি থাকে। তবে অনেক আবেগ আছে যেগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। বর্তমানে প্রচলিত কোয়ারেন্টাইন ৭০০ বছর আগেও জনস্বাস্থ্য নীতির অংশ ছিল।’
হিস্টোরিডটকম অবলম্বনে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।