জুমবাংলা ডেস্ক : কথিত ইউনিয়ন পরিষদের অফিসকে বানানো হয়েছিল টর্চার সেল। সরকারি জমিতে ইউনিয়ন পরিষদের অফিস থাকলেও ক্ষমতার দাপটে পারিবারিক জমিতে পরিষদের অফিস করেন উজিরপুর ইউনিয়নের বির্তকিত চেয়ারম্যান ফয়েজ উদ্দীন। পদ্মা নদী সংলগ্ন বেড়িবাঁধে তৈরি করেছেন নিজের ডেরা। এখান থেকেই তিনি পরিচালানা করতেন তার সকল অবৈধ কর্মকাণ্ড।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানে বসেই তিনি মা দক, অ স্ত্র আর জাল টাকার কারবার নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে ব্যবহৃত হতো কার্যালয়টি। এছাড়া এটি মা দক সেবনের আখড়া বলেও জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
পদ্মা নদীর বেড়িবাঁধের এই জায়টিকেই চোরাচালানের ঘাঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছিল ফয়েজ উদ্দিন। ভারতীয় গরু ব্যবসা আর গরু ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ছিনতাই করে আনা গবাদিপশু বৈধ করার জন্য নিজেই বসান অবৈধ পশুর হাট।
১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের গাইনপাড়া গ্রামের খোদাবক্সের ছেলে নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকর্মী রুবেল হোসেন নামে এক যুবকের দুই হাতের কবজি কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফয়েজ চেয়ারম্যান ও তার ক্যাডারবাহিনি। থানায় মামলা করা হলে ফয়েজ উদ্দীনসহ তার ৪ সহযোগীকে ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মামলার মূল আসামি উজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উজিরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মো. ফয়েজ উদ্দিন (৩৫), সহযোগী তারেক আহমদ (৩৫), জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) আলাউদ্দিন (৩৫) ও আতিক রহমান রিমন (৩০)।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর থেকেই চেয়ারম্যান ফয়েজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। শুক্রবার সরেজমিনে উজিরপুর গেলে কাছে ফয়েজ চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন তারা।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতিকরাও জানান, শিবগঞ্জে এমন নৃশংসতা যেকোনো সময়ের নৃশংসতাকে হার মানিয়েছে। রুবেলসহ তিন যুবককে আটকের পর ছেড়ে দেয়ার জন্য এমপির নির্দেশও মানেনি দুর্বৃত্তরা।
কথিত ইউনিয়ন পরিষদের কাছে গেলে স্থানীয় যুবক সাইফ খান তোতা জানান, জলবাজার মোড়ে গত ১০ বছর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়। কিন্তু চেয়ারম্যান ফয়েজ আসার পর পদ্মা নদীর বেড়িবাঁধ এলাকায় তার পারিবারিক জমিতে অফিসের সকল কাগজপত্র নিয়ে অফিস স্থানান্তর করেন।
তারপর তিনি এটিকে ইউনিয়ন কাউন্সিল ঘোষণা করে। প্রতিদিন গভীররাত পর্যন্ত এখানে চলে মা দকের আড্ডা। এছাড়া ছিনতাই ও অপহরণ করে ভুক্তভোগীদের এখানে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন চালাত তার বাহিনী।
তিনি আরো জানান, কিছুদিন আগে প্রকাশ্য দিবালোকে এলাকার অনেক মানুষের মধ্যে ফয়েজ চেয়ারম্যান হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমার কাছে ৪৪ টি পি স্তল আছে। ৪টি সবসময় আমার কাছে থাকে। বাকি ৪০টি আমার লোকজন কাছে, আমার নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয়।’ এ থেকে অনেকেই ধারণা করেন যে, সে একজন অ স্ত্র ব্যবসায়ী।
সাইফ খান তোতা আরো জানান, ফয়েজ চেয়ারম্যান বর্তমান এমপি শিমুলকে উজিরপুর কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে না মেনে নেওয়ায় কলেজে তালা মারতে গেলে আমি ও এলাকার অনেকেই বাধা দিই। এ নিয়ে এলাকায় মারামারি ও হামলার ঘটনাও ঘটান ফয়েজ চেয়ারম্যান। যখন যে ক্ষমতায় থাকে তখন বিভিন্ন কৌশলে তারই হয়ে যায় ধুরন্ধর ফয়েজ উদ্দিন।
উজিরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দুরুল হোদা জানান, গত ইউপি নির্বাচনে ভোট কারচুপি করে ফয়েজ চেয়ারম্যান হয়েছেন। তৎকালীন এমপি গোলাম রাব্বানী আর উপজেলা নির্বাচন অফিসার তাকে ভোট কারচুপি করে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন।
আর বর্তমান এমপি ডা. শিমুল আর তার ভাইয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। ফয়েজ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলায় তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল।
অথচ তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। রুবেল নামে একটি ছেলের দুই হাতের কবজি কেটে নিয়ে ছেলেটির জীবন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
এসব সন্ত্রাসীদের কারণে আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। আমার দাবি, রুবেলের দুই হাতের কবজি কাটার সাথে জড়িতদের যেন উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।
উজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তোসলিম উদ্দীন জানান, ফয়েজ চেয়ারম্যান একজন সন্ত্রাসী। এর আগে তিনি সাবেক এমপি গোলাম রাব্বানির ছত্রছায়ায় তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। বর্তমানে এমপি ডা. শিমুলের ছত্রছায়ায় রয়েছে।
ঘটনার সময় রুবেলসহ তিনজনকে অপহরণের ঘটনা জানানো হলেও এমপি শিমুল কোনো ব্যবস্থা নেননি। ঘটনা জানার পর তিনি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রুবেল এর দুটি হাত বিচ্ছিন্ন করার দুঃসাহস দেখাতে পারত না ফয়েজ চেয়ারম্যান ও তার ক্যাডাররা।
তিনি আরো জানান, জেলা পরিষদ নির্বাচনে তার বউকে সদস্য পদে প্রার্থী করেছিলেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই তার বউকে ভোট না দেয়ায় সব সদস্যকে অবৈধভাবে বহিষ্কার করে সে। পরে সব সদস্য তার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানান।
এলাকাবাসীদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, চলতি বছরের ২৬ মার্চ চেয়ারম্যানের সাথে বিরোধীদের সংঘর্ষ, হামলা, বোমাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ তাকে আটক করলেও পরে ছাড়া পেয়ে যায়। কয়েক বছর আগে শিবগঞ্জ কারবালা মোড়ে জনৈক বরজাহানের বাড়ি ও জমি দখলের জন্য সন্ত্রাসী হামলা ও ভাঙচুর করেছিল ফয়েজ ও তার ক্যাডাররা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দীন আহমেদ শিমুল জানান, ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে আমার সাথে তার যতুটুকু সম্পর্ক থাকা দরকার তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঘটনার দিন রাতে আমি বিষয়টি জানার পর তাকে ওই তিন ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কঠোরভাবে বলি।
শুধু তাই নয়, তাদের বাড়ি পৌঁছে দিতেও বলি। এমনকি তাদের যেন কোনো প্রকার মারধর না করা হয় সে কথাও বলি। ফয়েজ চেয়ারম্যান আমাকে কথা দেয় ছেলেগুলোকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি যে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
আমি বিষয়টি আঁচ করতে পারলে কখনও এমনটি হতে দিতাম না। আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছে তারা। এরকম জঘন্য অপরাধের কোনো ক্ষমা হতে পারে না। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের জন্য যা যা করা প্রয়োজন আমি তা করব।
গত বৃহস্পতিবার রুবেলের মা রুলি বেগম বাদী হয়ে ২১ জনের নাম উল্লেখসহ ৫-৬ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার (১৯/০৯/১৯) রাতে শিবগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
পরে শুক্রবার বিকেলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আসামিদের আদালতের হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। চাঁপাইনবাবগেঞ্জর চিফ জুডিশিয়াল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ‘খ’ অঞ্চলের বিচারক মাইনুল হোসেন শুনানী শেষে ৪ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানান শিবগঞ্জ থানার ওসি তদন্ত আতিকুল ইসলাম জানান।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার গভীর রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফয়েজ উদ্দীন ও তার ক্যাডার বাহিনী রুবেল হোসেন নামের এক যুবকককে তাদের টর্চার সেল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তুলে নিয়ে গিয়ে পদ্মা নদীর বেড়িবাঁধ তালপট্টি মোড় এলাকায় দুই হাতের কবজি কেটে নেয়। রুবেলের দুই সঙ্গী হাবিবুর রহমান হবি ও রবিউল ইসলামকে পাশে এক স্কুল ঘরে বন্দি করে রাখা হয় প্রায় চার ঘণ্টা।
গুরুতর আহত অবস্থায় রুবেলকে এলাকাবাসী প্রথমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ও পরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। রুবেল বর্তমানে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।