আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান মধ্যপন্থী ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিয়েছেন। রুশ হামলার বিরোধিতা করলেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। আবার ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন এবং তুর্কি প্রণালী বন্ধ করে পাচ্ছেন পশ্চিমাদের প্রশংসা। স্পষ্টভাবে এরদোয়ান জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেন কিংবা রাশিয়ার কারও সঙ্গেই সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারবে না তার দেশ। এমন অবস্থান নিয়ে এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কে ফাটল তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে রাশিয়ার বিরাগভাজন হওয়া থেকে তুরস্ককে রক্ষা করছেন এরদোয়ান।
ইউক্রেনের খারকিভ ও কিয়েভে রুশ বোমাবর্ষণের পটভূমিতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা দুই দফা বৈঠক করেছেন। দ্বিতীয় বৈঠকে বেসামরিকদের সরিয়ে নিতে মানবিক করিডোর স্থাপনের সমঝোতা হয়েছে। আবার সেই সমঝোতা লঙ্ঘনের জন্য উভয় দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এমন সময়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, তিনি রাশিয়া কিংবা ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারবেন না। রবিবার এরদোয়ান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাবেন বলে জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এরদোয়ান রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছেন এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। যা ন্যাটোর অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে তুরস্ক।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার সঙ্গে উষ্ণ ও সমদূরত্বের সম্পর্ক বজায় রাখার এই অবস্থান শিগগিরই হয়তো প্রচণ্ড চাপে পড়বে। কিন্তু আপাতত তুরস্কের এই নীতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ক্ষুব্ধ করেনি।
মার্কিন প্রশংসা
মধ্যপ্রাচ্যে যখন তুরস্ক নিজেকে অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বিচ্ছিন্ন অনুভব করছে তখন চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। অর্থনীতি তীব্র সংকটে থাকায় নিজেদের অহংকার চাপা রেখে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েল ও মিসরের মতো মুসলিম দেশগুলোকে পাশে টানতে চাইছে আঙ্কারা। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, যখন এই দেশগুলোকে এরদোয়ানের নিন্দার মুখে পড়তে হয়েছে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেছেন এরদোয়ান। কয়েক বছর ধরে শীতল সম্পর্কের অবসানের ইঙ্গিত ছিল এই সফরে। এই মাসের শেষে দিকে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট তুরস্ক সফরের পরিকল্পনা করছেন। নেতানিয়াহু যুগের বৈরিতার পর এটি উভয় দেশের সম্পর্কের নতুন সূচনা হতে পারে। মিসরের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কাজ চলমান রয়েছে।
আমিরাতের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায় ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে চান এরদোয়ান। তাই মার্কিন রাজনীতিকরা রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক বজায় রাখাকে হুমকি বলে মনে করেন না। যদিও তুরস্ক যাতে রুশ এস-৪০০ না কেনে সেজন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে। আর তাই এই সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় তুরস্কের দৃঢ় সমর্থনের প্রশংসা করেছেন। মার্কিন সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির ভাইস-চেয়ার রিপাবলিকান মার্কো রুবিও ইউক্রেনে ব্যবহৃত তুর্কি ড্রোনের প্রশংসা করেছেন।
১৯৩৬ সালের মন্ট্রিউক্স কনভেনশনের ধারা প্রয়োগ করে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের প্রশংসা অর্জন করেছেন এরদোয়ান। এর ফলে তুরস্কের প্রণালী দিয়ে রুশ যুদ্ধজাহাজের চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতিতে রাশিয়ার অবস্থান
গত কয়েক বছর ধরে তুরস্ক যে পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করেছে সেটাকে স্বতন্ত্র হিসেবে বললে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য, ককেশাস অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আঙ্কারা বহুমুখী পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করেছে। এক সময় দেশটি ছিল ন্যাটো মিত্র। কিন্তু ২০১৭ সালে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে চুক্তি করে। আঙ্কারা ও মস্কোর মধ্যকার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত এই চুক্তি। এটি দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ককে আরও বৃদ্ধি করেছে।
একই সময়ে তুরস্ক ও রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক নানা সংঘাতে পরস্পরকে পেয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। যেমন- সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগোরনো-কারাবাখ। এসব অঞ্চলে দুই দেশ ভিন্ন ভিন্ন পক্ষকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু এরপরও এরদোয়ান ও পুতিন সংলাপ অব্যাহত রেখেছেন।
তুরস্কের প্রতিক্রিয়ার নেপথ্যে?
বসফরাস প্রণালীতে যুদ্ধজাহাজের চলাচল নিষিদ্ধ করলেও ইসরায়েলের মতো তুরস্ক কৌশলগতভাবে প্রতিরক্ষামূলক কিন্তু নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ মধ্যম পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছে। জাতিসংঘে রাশিয়ার নিন্দা জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে তুরস্ক। কিন্তু মস্কোর বিরুদ্ধে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। এমনকি তুর্কি আকাশসীমায় রুশ বিমানের চলাচলও নিষিদ্ধ করেনি।
কয়েকজন বিশ্লেষক ইউক্রেনপন্থী তুরস্কের নীতির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোটের অবস্থানের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, তুরস্ক দুই নৌকাতেই পা রাখতে চাইছে। বক্তব্যে ইউক্রেনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান, কিন্তু সংঘাত বন্ধে রাশিয়ার পক্ষে যায় এমন মধ্যস্থতায় আগ্রহী তুরস্ক। রাশিয়ার এস-৪০০ কেনার পর এমন অবস্থানের পক্ষে যুক্তিও রয়েছে।
এছাড়া সিরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তুরস্কের স্বার্থ রাশিয়ার সঙ্গে জড়িত। সেখানে কুর্দি রাষ্ট্রের আবির্ভাব চায় না তুর্কিরা। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) সংশ্লিষ্ট পিপল’স প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি)-কে চাপে রাখতে অভিযান চালাচ্ছেন এরদোয়ান। এক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে তুর্কি কর্মকর্তাদের রুশদের সংবেদনশীলতাকে আমলে নিতে হচ্ছে। কারণ সিরিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইরের শক্তি হলো রাশিয়া। রুশদের বিরাগভাজন হলে সেখানে তুরস্কের সামরিক অভিযান জটিলতায় পড়তে পারে এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ পড়তে পারে হতাশায়।
যেভাবে উপকৃত হবেন এরদোয়ান
ইউক্রেনের স্বাধীনতার পক্ষে এরদোয়ানের দৃঢ় সমর্থনকে হাস্যকর বলে করেন অনেক সমালোচক। তাদের মতে, নিজ দেশে এরদোয়ান ভিন্নমতালম্বীদের দমন করার সময় জেলেনস্কি নয়, পুতিনের মতোই আচরণ করেন।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে তুরস্কের মধ্যপন্থী অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে এরদোয়ানের জন্য। কিন্তু তিনি যদি সফলভাবে ভঙ্গুর কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন তাহলে দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা লাঘব হবে। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছাকাছি আসতে পারবেন পুতিনের সঙ্গে বড় ধরনের বিরোধিতায় না গিয়েও। সূত্র: ফরেন পলিসি, হারেৎজ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।