আধুনিক জীবনের দৌঁড়ঝাঁপ, খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম, এবং মানসিক চাপ আমাদের শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন এনে দেয়, যা কখনো কখনো নীরবে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে একটি হলো রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। প্রথমদিকে এই সমস্যাটি নিরব ঘাতকের মতো থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি গাউট, কিডনি পাথরসহ নানা জটিলতায় রূপ নেয়। অনেকেই বুঝতেই পারেন না যে তাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ছে এবং ধীরে ধীরে তা ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
Table of Contents
ইউরিক অ্যাসিড হলো শরীরের স্বাভাবিক বর্জ্য পদার্থ। এটি তৈরি হয় যখন শরীর পিউরিন নামক একটি রাসায়নিককে ভেঙে ফেলে। এই পিউরিন আমাদের খাদ্যতালিকার অনেক খাবারে থাকে, যেমন: লাল মাংস, সামুদ্রিক মাছ, মিষ্টি পানীয় এবং অ্যালকোহল। সাধারণত কিডনি এই ইউরিক অ্যাসিডকে ফিল্টার করে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। তবে যখন শরীর অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে বা কিডনি যথাযথভাবে এটি ফিল্টার করতে ব্যর্থ হয়, তখন রক্তে এর ঘনত্ব বেড়ে যায়। একেই বলে হাইপারইউরিসেমিয়া।
ইউরিক অ্যাসিড: লক্ষণ ও প্রাথমিক শনাক্তকরণ
ইউরিক অ্যাসিড শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে জমে গেলে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। এটি কখনো নিরব থাকে, আবার কখনো তীব্র যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে বাড়ে এবং প্রায়ই অন্যান্য রোগের সঙ্গে মিশে গিয়ে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়াই একমাত্র উপায়।
সাধারণ লক্ষণসমূহ
জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলাভাব
অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড প্রথমত আক্রমণ করে আমাদের জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিগুলোতে। বিশেষ করে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ালিতে তীব্র ব্যথা ও ফোলাভাব দেখা দেয়। এই অবস্থাকে বলে গাউট।রাতে ব্যথা বেড়ে যাওয়া
গাউটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের দিকে ব্যথা বেড়ে যাওয়া। এতে ঘুম ব্যাহত হয় এবং দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা কমে আসে।জয়েন্টের চারপাশে লালচে ও চকচকে ত্বক
ফোলা জয়েন্টগুলোর চারপাশে ত্বক লালচে ও কখনো কখনো চকচকে হয়ে যেতে পারে।ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
ইউরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি কিডনিতে প্রভাব ফেললে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবে ব্যথা বা গন্ধযুক্ত প্রস্রাব দেখা দেয়।পিঠে ব্যথা
কিডনিতে ইউরিক অ্যাসিড জমে পাথরের সৃষ্টি করলে পিঠ বা কোমরের এক পাশে ধারাবাহিক ব্যথা অনুভূত হয়।
কম ইউরিক অ্যাসিডের লক্ষণ
অত্যধিক কম ইউরিক অ্যাসিডও ক্ষতিকর হতে পারে। এর ফলে দেখা দিতে পারে:
অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া
মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা
ডিহাইড্রেশন
ইউরিক অ্যাসিডের প্রধান কারণসমূহ
যদিও ইউরিক অ্যাসিড রক্তে স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত থাকে, তবে কিছু অভ্যাস ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা এর মাত্রা বাড়াতে পারে।
১. পিউরিন-সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ
লাল মাংস, কলিজা, মুরগির চামড়া, টুনা মাছ, অ্যাঙ্কোভিস, স্ক্যালপস ইত্যাদিতে প্রচুর পিউরিন থাকে। এগুলোর নিয়মিত গ্রহণ ইউরিক অ্যাসিড বাড়ায়।
২. অ্যালকোহল সেবন
বিশেষ করে বিয়ার এবং মদ শরীরে পিউরিন বিপাককে প্রভাবিত করে, ফলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায়।
৩. মিষ্টি পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাবার
ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ সফট ড্রিংক, ডেজার্ট, প্যাকেটজাত জুস এসব ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধিতে সহায়ক।
৪. অতিরিক্ত ওজন
স্থূলতা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়, যা কিডনির ইউরিক অ্যাসিড নির্গমনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
৫. কিডনি সমস্যা
কিডনি ঠিকমতো ইউরিক অ্যাসিড ফিল্টার করতে না পারলে এটি রক্তে জমে থাকে।
৬. কিছু ওষুধ
ডাইইউরেটিকস, ইমিউনোথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং কিছু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ইউরিক অ্যাসিড বাড়াতে পারে।
ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাপ ও সঠিক মাত্রা
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা সাধারণত মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার (mg/dL) ইউনিটে পরিমাপ করা হয়। এই মান পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা হয়ে থাকে।
মাত্রা | পুরুষ | মহিলা |
---|---|---|
স্বাভাবিক | 2.5 – 7 mg/dL | 1.5 – 6 mg/dL |
ঊর্ধ্বতন | >7 mg/dL | >6 mg/dL |
নিম্ন | <2 mg/dL | <1.5 mg/dL |
কীভাবে ইউরিক অ্যাসিড মাপা হয়?
ডাক্তার সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। এর পাশাপাশি কিডনি ফাংশন বিশ্লেষণ, প্রস্রাব পরীক্ষা এবং জয়েন্ট থেকে তরল সংগ্রহ করে গাউট শনাক্ত করা যেতে পারে।
কাদের পরীক্ষা করা উচিত?
যাদের জয়েন্টে ব্যথা বা ফোলাভাব থাকে
যারা অতিরিক্ত লাল মাংস ও অ্যালকোহল গ্রহণ করেন
যাদের কিডনি সমস্যা রয়েছে বা ছিল
যাদের পরিবারে গাউটের ইতিহাস আছে
ইউরিক অ্যাসিড কমানোর চিকিৎসা ও প্রতিকার
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা যদি চিকিৎসকের মতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তবে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারেন:
১. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
বর্জন করুন: লাল মাংস, অঙ্গের মাংস (লিভার, কিডনি), শেলফিশ, বিয়ার, চিনিযুক্ত পানীয়
গ্রহণ করুন: পানি, শসা, করলা, চেরি, লেবু পানি, কম ফ্যাটযুক্ত দুধ
পিউরিন নিয়ন্ত্রণ: মাঝারি মাত্রায় পিউরিনযুক্ত মাছ (টুনা, স্যামন) খাওয়া যেতে পারে
২. পর্যাপ্ত পানি পান
দিনে অন্তত ৮–১০ গ্লাস পানি পান করলে কিডনি ইউরিক অ্যাসিড সহজে বের করতে পারে।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ
স্থূলতা ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৪. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা
গাউট হলে NSAIDs (যেমন: ইবুপ্রোফেন), কোচিসিন, অলোপিউরিনল ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করা বিপজ্জনক।
৫. কিডনি পাথরের জন্য চিকিৎসা
হালকা কেসে পাথর নিজে নিজেই বের হয়ে যেতে পারে। তবে বড় পাথরের ক্ষেত্রে Lithotripsy বা সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিরোধে জীবনধারা পরিবর্তন
ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির ঝুঁকি এড়াতে নিচের অভ্যাসগুলো গড়ে তুলুন:
প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি পান করুন
লাল মাংস ও ফাস্ট ফুড কম খান
সফট ড্রিংক ও চিনি যুক্ত পানীয় বাদ দিন
নিয়মিত হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম করুন
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
FAQ: ইউরিক অ্যাসিড নিয়ে সাধারণ জিজ্ঞাসা
ইউরিক অ্যাসিড কেন বাড়ে?
শরীর অতিরিক্ত পিউরিন গ্রহণ করলে এবং কিডনি সঠিকভাবে তা প্রস্রাবে বের করতে না পারলে ইউরিক অ্যাসিড জমে যায়।
ইউরিক অ্যাসিড কি গাউটের একমাত্র কারণ?
গাউটের অন্যতম কারণ ইউরিক অ্যাসিড হলেও অন্যান্য শারীরিক অবস্থা যেমন অস্থিরোগও এর পেছনে দায়ী হতে পারে।
কোন খাবার ইউরিক অ্যাসিড কমায়?
লেবু পানি, শসা, চেরি, কম ফ্যাটযুক্ত দুধ, করলা, এবং প্রচুর পানি ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সহায়ক।
ইউরিক অ্যাসিড কী সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য?
সঠিক জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, যদিও এটি পুনরায় বাড়তে পারে।
ইউরিক অ্যাসিডের জন্য কি ঘরোয়া চিকিৎসা আছে?
হালকা কেসে করলা, চেরি, লেবু পানি, মেথি ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে উপশম পাওয়া যেতে পারে।
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে প্রথম করণীয় কী?
ব্যথা শুরু হলে যত দ্রুত সম্ভব একজন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা করান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।