আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত ১১ অক্টোবর তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশেষ করে গত ১ অক্টোবর ইসরাইলের ইরানের বড় ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরাইলের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি
দুই নেতার আলোচনায় বিভিন্ন খাতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। বিশেষত রাশিয়া ও ইরান উভয়ই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক ইস্যুতে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করছে।
চলমান ইউক্রেন সংকটে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত পুতিন রাশিয়ার অবস্থানকে পশ্চিমের সঙ্গে বৃহত্তর অস্তিত্বের সংগ্রামের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি গ্লোবাল ইস্ট ও সাউথের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী। যেখানে ইরান অন্যতম প্রধান অংশীদার। উভয় দেশই মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে।
সামরিক সহযোগিতা: একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
গত কয়েক বছরে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে। ইরানকে রাশিয়ার জন্য ড্রোন সরবরাহ করার অভিযোগও রয়েছে। বিশেষ করে ‘শাহেদ’ নামক আক্রমণাত্মক ড্রোন রাশিয়াকে সরবরাহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ইরান রাশিয়াকে স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। এর ফলে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে ইরান সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার ইরানকে সরাসরি সহায়তা করার সম্ভাবনা খুবই কম। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের পরিস্থিতিতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া হবে যথেষ্ট সংযত।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটন ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ইরান প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অ্যালেক্স ভাতাঙ্কা বলেন, ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তা হলো- যেকোনো সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমকে প্রতিরোধ করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখছি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ ধরনের মনোভাব কার্যকর হচ্ছে। যেমন- ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ইরান ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে। অন্যদিকে রাশিয়া ইরানকে সামরিক দক্ষতা ও প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। ইরান-ইসরাইল সংঘাতের মাঝেও রাশিয়া ইরানকে সহায়তা করছে। এছাড়া, উভয় দেশের মধ্যে সাইবার যুদ্ধের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবিরোধী সহযোগিতা বাড়ছে।
নিষেধাজ্ঞা কবলিত ইরান ও রাশিয়ার সম্পর্ক
রাশিয়া ও ইরান উভয়েই বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে এবং তারা এই বিচ্ছিন্নতার ভিত্তিতে আরও একত্রিত হয়েছে। কিন্তু এই সম্পর্কের মাধ্যমে ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। এই ঘনিষ্ঠতা কতটা টেকসই হবে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে, তা অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
ইরান ব্রিকস (BRICS) এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (SCO) মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সদস্যপদ অর্জন করে কূটনৈতিক গুরুত্ব বাড়াতে সক্ষম হলেও, এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সদস্যপদ ইরানের অর্থনীতিতে এখনও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারেনি।
এ বিষয়ে ভাতাঙ্কা বলেন, এই কূটনৈতিক সম্পর্ক ইরানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয় এবং ইরানকে রাশিয়া, চীন, ভারত এবং ব্রাজিলের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর পাশে রাখে। তবে, এর অর্থনৈতিক সুফল এখনও ইরানের জন্য বাস্তবায়িত হয়নি।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ‘নৃশংসতা’ মোকাবিলায়।
ইরান-ইসরাইল বৈরিতা: রাশিয়ার জন্য হাতিয়ার?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান বৈরিতার প্রেক্ষাপট রাশিয়ার জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একদিকে, ইসরাইল ও তথাকথিত ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ (যার মধ্যে ইরান ও তার মিত্ররা অন্তর্ভুক্ত) এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত রাশিয়ার স্বার্থে কাজ করছে, কারণ এটি পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টি ইউক্রেনের পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
এই সংঘাত রাশিয়ার জন্য একটি প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। যার মাধ্যমে মস্কো পশ্চিমাদের দ্বৈতনীতি তুলে ধরছে, বিশেষ করে ফিলিস্তিন ও ইউক্রেনের মতো ইস্যুতে। রাশিয়া দেখানোর চেষ্টা করছে যে, পশ্চিমা দেশগুলো একাধিক ক্ষেত্রে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করছে।
তবে বিশাল আকারের কোনো যুদ্ধ, বিশেষ করে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ, যাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়তে পারে, তবে রাশিয়া নয়।
এ বিষয়ে জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের (SWP) ভিজিটিং ফেলো হামিদরেজা আজিজি বলেন, এ ধরনের সংঘাত রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে, বিশেষ করে সিরিয়ায়।
বর্তমানে ইসরাইল ইরান-সমর্থিত অবস্থানের বিরুদ্ধে তার অভিযান বাড়িয়েছে। যদি ইসরাইল সিরিয়ায় আসাদ বাহিনীকে টার্গেট করে প্রতিরোধ অক্ষের সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে, তাহলে এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়ার জন্য যতটা সুবিধাজনক ছিল, ততটা নাও হতে পারে।
গত ৩ অক্টোবর ইসরাইল রাশিয়ার হমেইমিম ঘাঁটির কাছাকাছি লাতাকিয়াতে একটি অস্ত্র ডিপোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরাইলের কিছু ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে গুলি করে নামানো হয়েছিল। তবে অন্য কিছু ক্ষেপণাস্ত্র সিরিয়ান ও ইরানিয়ান বাহিনীর ব্যবহৃত একটি গুদামঘরে আঘাত হানে।
আজিজি বলেন, ইরানের দুর্বলতার দিকে নিয়ে যাওয়া একটি সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়লেও, রাশিয়া তাতে নাক গলাবে না।
রাশিয়া ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে সূক্ষ্মভাবে পরিচালনা করে থাকে। যেমন দেশটি ঐতিহ্যগতভাবে ইরানের সরকারের কঠোরপন্থি গোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মনোভাব পোষণ করে। তবে পুরো ইরানি রাষ্ট্রের সঙ্গে নয়। তাই রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদী বৈরিতায় লাভবান হলেও, দেশটিটি এমন কোনো পরিস্থিতি এড়াতে চায়, যা ইরানকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করবে।
রাশিয়ার সামরিক সহায়তা: কতটা প্রত্যাশিত?
যদিও রাশিয়া ইরানকে প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা সহায়তা দিতে পারে, তবে সরাসরি সামরিক সাহায্যের সম্ভাবনা খুবই কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া সম্ভবত ইরানের মিত্রদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে, তবে তা হবে অনেকটা পরোক্ষভাবে। রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশেষত সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ, যা বজায় রাখার জন্য মস্কো এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইবে না, যা এই সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইসরাইলি বাহিনী হিজবুল্লাহর ঘাঁটি থেকে ‘অত্যাধুনিক রুশ অস্ত্র’ উদ্ধার করেছে। এ ঘটনার ফলে রাশিয়া এবং ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা জটিল হয়ে উঠতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া ইরানকে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ পুতিনের দেশ ইসরাইলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকা
মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অবস্থান হচ্ছে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ভারসাম্য বজায় রাখা। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি এবং অঞ্চলটির গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রাশিয়াকে এমন একটি অবস্থানে রেখেছে, যেখানে তারা যেকোনো বড় সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইবে।
তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী হলেও ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়া সরাসরি সহায়তা দেবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। রাশিয়া ইরানের মিত্র হিসেবে কিছুটা সহায়তা করতে পারে। তবে তা হবে পরোক্ষ এবং সামরিক প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করার মাধ্যমে। এর বেশি কিছু নয়।
(আল আরাবিয়ায় প্রকাশিত লেখক ভ্যানেসা গ্যানেম-এর কলাম অনুসারে)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।