আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফ্র্যাঙ্ক উইলিয়াম এবেগ্নেল (জুনিয়র), জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে। যখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর তখনই তার বাবা ও মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। মাত্র ১৫ বয়সে ফ্র্যাঙ্ক প্রথমবারের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ফ্র্যাঙ্কের বাবা ফ্র্যাঙ্ককে ট্রাক সম্পর্কিত জিনিসপত্র কেনার জন্য একটি ক্রেডিট কার্ড দেন। তিনি ভেবেছিলেন ছেলেটি তাকে পার্ট টাইম বিজনেসে সহযোগিতা করবে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এ টাকা ডেটিংয়ে খরচ করবেন। কিন্তু এই ক্রেডিট কার্ড শুধু ট্রাক সম্পর্কিত জিনিসপত্র ছাড়া আর কোনোভাবে ব্যবহার করা যেত না বিধায় তিনি একটি গ্যাস স্টেশন থেকে ট্রাকের জন্য টায়ার, ব্যাটারি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা শুরু করলেন এবং এক ব্যক্তিকে এই জিনিসগুলো কম দামে কিনে নেওয়ার জন্য রাজি করালেন। প্রথমদিকে না বুঝলেও মাস শেষে ফ্র্যাঙ্কের বাবার ক্রেডিট কার্ডে অতিরিক্ত ৩,৪০০ ডলারের বিল আসলে তিনি ছেলের এ জালিয়াতি ধরে ফেলেন। ফ্র্যাঙ্কের এই অধঃপতন দেখে তার বাবা তাকে ওয়েওয়ার্ড স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।
কিন্তু স্কুলে না গিয়ে ফ্র্যাঙ্ক ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ফ্র্যাঙ্কের মূল জালিয়াতির জীবন শুরু হয় এ সময় থেকেই। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সামান্য পরিমাণ অর্থ দিয়ে দৈনন্দিন জীবন চালানো কষ্ট হয়ে পড়ছিল ফ্র্যাঙ্কের জন্য। এ কারণে ফ্র্যাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাংকে জালিয়াতি করবেন। প্রথম দিকে নিজের অ্যাকাউন্টের চেক ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ডলার ধার নেওয়া শুরু করলেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই পূর্বের ঋণ শোধ করতে না পারায় ব্যাংক তাকে ধার দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তৎকালীন ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণ ত্রুটি ছিল। ফ্র্যাঙ্ক এ ত্রুটির সুযোগ নেওয়া শুরু করলেন। তিনি ভুয়া পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে পূর্বের মতো ধারে টাকা নেওয়া শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি চেকের জালিয়াতির কাজ শুরু করেন।
এ ছাড়াও চেকের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটিয়ে অন্যের ডিপোজিটের টাকা কৌশলে নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে আসতেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ফ্র্যাঙ্কের স্বপ্ন ছিল পাইলট হবেন। এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন অবৈধ পথে। বিমান সংস্থা পেন আমেরিকান এয়ারলাইন্সে কল দিয়ে নিজেকে কো পাইলট হিসেবে পরিচয় দিয়ে তার পোশাক হোটেলে হারিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে নতুন পোশাক সংগ্রহের উপায় জেনে নিলেন। এরপর স্কুলের ছাত্র সেজে প্রজেক্টের নাম করে এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়ে বিমান ও পাইলট সম্পর্কিত সব তথ্য জেনে নেন। তারপর একটি নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে শুরু করেন পাইলট জীবন সে সময় পাইলটদের বিমান ভ্রমণ এমনকি হোটেলে থাকা খাওয়া ফ্রিতে উপভোগ করার সুযোগ ছিল। ফ্র্যাঙ্ক এ সুযোগ নিয়ে ২ বছরে প্রায় ১,০০০,০০০ মাইল ফ্রিতে ভ্রমণ করেন। ২৫০টিরও বেশি ফ্লাইটে তিনি প্রায় ২৬টি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। অনেক সময় মাঝ আকাশে অন্য পাইলটরা তার হাতে কন্ট্রোল তুলে দিতেন। তখন তিনি বিমানকে অটোপাইলট মুডে চালু করে নিজেকে রক্ষা করতেন। পাইলট হিসেবে চাকরি ছাড়ার পর ফ্র্যাঙ্ক জর্জিয়ায় ডাক্তার পরিচয়ে নতুন বাসা ভাড়া নেন। একই বিল্ডিংয়ে আরেক ডাক্তারের সুবাদে তিনি চাকরি পান জর্জিয়া হাসপাতালে সুপারভাইজার পদে। সুপারভাইজারদের সাধারণত চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো কাজ না থাকায় তিনি চাকরিটি লুফে নিলেন। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ইমার্জেন্সি চলে আসলে সমস্যায় পড়তেন বিধায় এ চাকরিটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি।এরপর ফ্র্যাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিলেন আইনজীবী হবেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে লুইজিয়ানা বার এক্সামে অংশ নিয়ে স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে চাকরি শুরু করেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ড পাস এক সহকর্মীর কাছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় তিনি ৮ মাস পর এই চাকরিটিও ছেড়ে দেন। এদিকে এফবিআইয়ের হাত থেকে বাঁচতে ফ্র্যাঙ্ক কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। তবে তার প্রাক্তন প্রেমিকা ফ্রান্সে তার ওয়ান্টেড ছবি দেখে পুলিশকে জানিয়ে দেন। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো তাকে গ্রেফতার করে ফ্রান্স পুলিশ। ফ্রান্সের কারাগারে প্রায় ৬ মাস নির্দয়ভাবে রাখা হয় ফ্র্যাঙ্ককে। এরপর তাকে সুইডেনের কারাগারে আরও ৬ মাস রাখা হয়। পরবর্তীতে যখন তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়, তখন তিনি এয়ারপোর্ট থেকেই পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যান। পালিয়ে ফ্র্যাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিলেন কানাডা হয়ে ব্রাজিলে চলে যাবেন। কিন্তু কানাডায় দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করা হয় তাকে। এরপর পাঠানো হয় আটলান্টায় ১২ বছরের সাজা ভোগ করতে। কিন্তু ১৯৭১ সালে আবারো পালিয়ে যান তিনি। ২ সপ্তাহের ব্যবধানে গ্রেফতার করে পুনরায় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফ্র্যাঙ্ককে।
১৯৭৪ সালে এফবিআই ফ্র্যাঙ্ককে মুক্তি দেওয়ার কথা বলে। তবে শর্ত ছিল সপ্তাহে একদিন এফবিআই অফিসে বিনামূল্যে ব্যাংক জালিয়াতির কেস সমাধানে সাহায্য করতে হবে। ফ্র্যাঙ্ক অফারটি লুফে নিয়ে মুক্তি পান। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সিকিউরিটি কনসালটেন্ট হিসেবে নতুন সৎ জীবন শুরু করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি “Abagnale & Associates” নামে নিজস্ব কনসালটেন্সি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন যার কাজ ছিল বিভিন্ন চেক জালিয়াতির ত্রুটি শনাক্ত করে ব্যাংকের নিরাপত্তা বাড়াতে সহায়তা করা। বর্তমানে ফ্র্যাঙ্ক সস্ত্রীক বসবাস করছেন সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এফবিআই একাডেমিতে লেকচারার হিসেবে নিয়মিত ক্লাস নেন একসময়ের মোস্ট ওয়ান্টেড এ ব্যক্তি। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয় ফ্র্যাঙ্ক সেমি বায়োগ্রাফিক বই “Catch Me if you Can”. এই বই অবলম্বনে একই নামে বিখ্যাত নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ ২০০২ সালে তৈরি করেন একটি মুভি। ব্যবসা সফল এ ছবিতে ফ্রাঙ্কের ভূমিকায় অভিনয়ে ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।