জুমবাংলা ডেস্ক : সারা পৃথিবীর বিলাসবহুল রিভার ক্রুজের মানচিত্রে অচিরেই যোগ হতে যাচ্ছে গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের নাম। আগামী ১৩ জানুয়ারি ভারতের বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ হয়ে যে প্রমোদতরী একটানা ৫০ দিন ধরে আসামের ডিব্রুগড়ে যাবে, সেটির মাধ্যমেই বাংলাদেশ ও ভারত একেযাগে ঢুকে পড়ছে আন্তর্জাতিক রিভার ক্রুজের সার্কিটে।
ফলে এতদিন যে ধরনের নৌযাত্রা ইউরোপের ডানিয়ুব বা রাইন, আমেরিকার মিসিসিপি, রাশিয়ার ভোলগা, মিশরের নীলনদ কিংবা এশিয়ার মেকং বা ইয়াংসে-তেই শুধু সম্ভব ছিল, তা এখন ঘরের কাছে গঙ্গা, পদ্মা বা যমুনাতেও করা যাবে। তবে যেহেতু এটি আপাতত ধনী পর্যটকদের কথা মাথায় রেখেই করা হচ্ছে, তাই টিকিটের ভাড়াও বেশ চড়া হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এই রিভার ক্রুজের প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন ধরেই, বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারও এর বাস্তবায়নে কাজ করছিল হাত মিলিয়ে। অবশেষে গত শুক্রবার (৩০ ডিসেম্বর) কলকাতায় একটি রেল প্রকল্পের ডিজিটাল উদ্বোধন করতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ক্রুজের যাত্রা শুরুর তারিখটিও ঘোষণা করে দিয়েছেন– সেটি হলো আগামী ১৩ জানুয়ারি (শুক্রবার)।
নরেন্দ্র মোদি সেদিন বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ সরকার নিজেদের মধ্যে জলপথ সংযোগ (ওয়াটারওয়েজ লিঙ্ক)-গুলো চালু করার জন্য বহুদিন ধরেই একসঙ্গে কাজ করছে। আগামী ১৩ জানুয়ারি কাশী (বারাণসী) থেকে এই পথেই যাত্রা শুরু করবে অত্যাধুনিক রিভার ক্রুজ, যা হবে ৩২০০ কিলোমিটার লম্বা। কলকাতা হয়ে এই ক্রুজ বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, তারপর সে দেশের মধ্যে দিয়ে আবার ভারতের আসামে ঢুকে ডিব্রুগড়ে যাত্রা শেষ করবে।’
আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজের সংসদীয় কেন্দ্র বারাণসীর গঙ্গার ঘাট থেকে এই রিভার ক্রুজের যাত্রা শুরুর ফ্ল্যাগ-অফ করবেন বলে স্থির হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডিজিটালি যুক্ত হতে পারেন বলে বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে।
কোন রুটে চলবে এই ক্রুজ?
বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করে গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে বক্সার, রামনগর, গাজীপুর পেরিয়ে আট দিনের মাথায় এই প্রমোদতরী পৌঁছবে পাটনায়। তারপর সেখান থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হবে ক্রুজ, ঠিক ২০ দিনের মাথায় সেটির কলকাতায় পৌঁছনোর কথা।
কলকাতার পর সুন্দরবনের বুক চিরে প্রমোদতরী ঢুকবে বাংলাদেশে। ক্রুজের বাংলাদেশ পর্বে মোট ১১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে এই নৌযান, অর্থাৎ মোট যাত্রাপথের এক-তৃতীয়াংশই হবে বাংলাদেশে।
পশ্চিমবঙ্গের হেমনগর পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পর একে একে মোংলা, বাগেরহাট, কটকা, হাড়বাড়িয়া, মোড়েলগঞ্জ পেরিয়ে ক্রুজ পৌঁছবে বরিশালে। তারপর সেখান থেকে মেঘনাঘাট, (ঢাকার কাছে) সোনারগাঁও, আরিচা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, চিলমারি হয়ে আসামের ধুবড়ির কাছে সেটি আবারও ভারতে প্রবেশ করবে।
বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে যে রুটে রিভার ক্রুজটি যাবে সেটি ‘ইন্দো-বাংলা প্রোটোকল (আইবিপি) রুট’ নামে পরিচিত। দুই দেশের সম্মতিক্রমে এই নৌপথে ইতোমধ্যেই ‘ট্রেড ও ট্রানজিট’ (বাণিজ্য ও চলাচল) শুরু হয়ে গেছে, এখন সেটি যুক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের বিলাসবহুল রিভার ক্রুজের সঙ্গেও। প্রমোদতরীটি বাংলাদেশে কাটাবে মোট ১৫ দিন।
ভারতে আবার ঢোকার পর আসামের ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, গৌহাটি, বিশ্বনাথ পেরিয়ে প্রমোদতরীর যাত্রা শেষ হবে ব্রহ্মপুত্রর তীরে, ডিব্রুগড়ের কাছে বগিবিলে। ৫০ দিনের দীর্ঘ যাত্রায় পর্যটকরা নদীতীরে অন্তত ৫০টি দর্শনীয় জায়গা দেখার সুযোগ পাবেন, যার মধ্যে থাকবে সুন্দরবনের মতো ইউনেসকো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা কাজিরাঙার মতো বিশ্ববিখ্যাত অভয়ারণ্য। আর নৌযানে বসে গঙ্গা, পদ্মা বা যমুনার (ব্রহ্মপুত্র) তীরে দৈনন্দিন জীবন যাপনের ঝলক আর সবুজ নিসর্গ তো থাকছেই!
কারা চালাচ্ছে এই রিভার ক্রুজ?
ভারতের সরকারি সংস্থা ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়া এই পথে রিভার ক্রুজ চালানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজ ও জেএম বক্সি রিভার ক্রুজ নামে দুটি সংস্থার সঙ্গে। এর মধ্যে অন্তরা ক্রুজের অপারেশনাল দিকগুলো দেখছে (অর্থাৎ এরাই প্রমোদতরীটি চালাচ্ছে), আর অন্য সংস্থাটি এর পরিচালনা, মার্কেটিং, বিমা-সহ অন্যান্য বিষয়গুলোর দায়িত্ব সামলাচ্ছে। দুটি সংস্থা পরস্পরের সহযোগীও বটে।
অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজের গঙ্গাবক্ষে ক্রুজ চালানোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাও আছে বেশ কয়েক বছরের। তারা সুন্দরবন, বারাণসী, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ-সহ নানা জায়গায় ক্রুজ অপারেট করে থাকে, তবে কোনও আন্তর্জাতিক নৌপথে বাণিজ্যিক-ভিত্তিতে ক্রুজ চালানো তাদের এই প্রথম।
বারাণসী-বাংলাদেশ-বগিবিল রুটে এই বিলাসবহুল ক্রুজ চালানোর জন্য অন্তরা বিশেষভাবে বেছে নিয়েছে একটি নৌযান, যার নাম এমভি গঙ্গা বিলাস। সম্পূর্ণ ভারতে তৈরি এই প্রমোদতরীটিতে থাকছে মোট ১৮টি লাক্সারি স্যুইট, যার প্রতিটি কক্ষ থেকেই পর্যটকরা নদীতীরের অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য দেখতে পাবেন।
কত ভাড়া হবে এই রিভার ক্রুজের?
মজার ব্যাপার হলো, আর মাত্র দিনদশেকের ভেতরে এই রিভার ক্রুজের যাত্রা শুরু হতে চললেও অন্তরা লাক্সারি ক্রুজ কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে বা অন্য কোথাও এর ভাড়ার হার বিজ্ঞাপিত করেনি। বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, ইউরোপ ও আমেরিকার বাছাই করা কিছু ট্র্যাভেল এজেন্ট ও অপারেটরের মাধ্যমে ‘এক্সক্লুসিভলি’ এই ক্রুজের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।
ভারত সরকারের সংস্থা ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই রিভার ক্রুজ চালানো হচ্ছে পিপিপি, অর্থাৎ পাবলিক-প্রাইভেট (সরকারি ও বেসরকারি) পার্টনারশিপ মডেলে। এখানে অপারেটর সংস্থাই তাদের খরচের ওপরে নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ ধরে টিকিটের দাম চূড়ান্ত করছে। সরকার সেখানে কোনওভাবে হস্তক্ষেপ করছে না।
অন্তরা লাক্সারি ক্রুজের ওয়েবসাইটেই দেখা যাচ্ছে, তাদের তিন দিনের একটি ক্রুজের জন্য (সূত্রা নদীতে) মাথাপিছু ১৮০ ডলার, চার দিনের বারাণসী ক্রুজের জন্য মাথাপিছু ১৩৫৫ ডলার, ১২ দিনের কলকাতা-বারাণসী ক্রুজের জন্য মাথাপিছু ৫৩০০ ডলার ভাড়া ধার্য করা হয়েছে। তবে এই ভাড়াগুলো সব ‘অল এক্সক্লুসিভ’, অর্থাৎ রোজকার খানাপিনার সব খরচই এর মধ্যে ধরা থাকছে।
ফলে বারাণসী-বাংলাদেশ-বগিবিল রিভার ক্রুজের ভাড়াও যে বেশ চড়াই হবে তা অনুমেয়। যদিও সংস্থার তরফে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে পুরো ৫০ দিন ক্রুজে না-কাটিয়ে অনেকে কম ভাড়ায় ৫, ১০ বা ১৫ দিনের একটা অংশও বেছে নিতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।