আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সুইডিশ জাতি ভালো অবস্থায় যখন থাকে তখন হাজারও চাওয়া পাওয়া। এটা চাই, ওটা চাই, সেটা চাই। তারপরও শত ত্রুটিবিচ্যুতি খুঁজে বের করা একটা অভ্যাস। কিন্তু যখনই এরা অসুস্থ হয় বিশেষ করে জটিল রোগে, তখন তাদের একটিই চাওয়া, একটিই আশা, একটিই প্রত্যাশা, কিভাবে সুস্থ হবে। আর কিছুই চায় না, শুধু সুস্থ হতে চায়। এটা কি শুধু সুইডেনের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? গোটা বিশ্বের মানুষেরই একই আর্তনাদ, একই প্রার্থনা সেটা হলো সবাই যেমন সুখি হতে চায়, তেমন সুস্থ থাকতে চায়।
নোবেল করোনা ভাইরাস সবার শরীরে ঢোকেনি। তারপরও বড় ধরণের আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে সবার মনে। আমাদের মধ্যে অনেকেই মরার আগে মরে আছে শুধুমাত্র ভয়ে। ভাবনার জগত বিশাল বড়। আকাশের মত খোলা, সারা দিন চিন্তা করলেও মন ভরে না। ভাসমান পৃথিবী তার মত করে সূর্যের চার পাশ দিয়ে অবিরল ঘুরছে। আর আমরা সেই ভাসমান পৃথিবীর পিঠের ওপর বসে দিব্বি চলছি।
মনে পড়ে কি ছোটবেলায় যেমন বাবার ঘাড়ে চড়ে মেলায় যেতাম। পথে যেতে যেতে কত কল্পনা, কত জল্পনা করেছি। সেই শেষ ডেসটিনেশনে গিয়ে কী কিনব, কী দেখব, আর কী করব। সে যে কী আনন্দ, হাজারও জিনিসের মাঝে চাওয়ার শেষ ছিল না, তবে পাওয়ার সীমাবদ্ধতা ছিল। যার কারণে মেলা থেকে ফেরার পথে বিরহ আর অভিমান গ্রাস করত সেই মেলায় যাবার আনন্দকে। মনে কি পড়ে সেসব কথা?
পৃথিবীতে যখন এসেছিলাম, আমি শুধু কেঁদেছিলাম, বাকি সবাই হেসেছিল। পরে বড় হলাম। নিজের মত করে যা খুশি করছি, দেখছি, মনের আনন্দে ঘুরছি। কখনও এভাবে ভাবিনি বাবার ঘাড়ে বসে যে ঘুরেছি। আবার এও ভাবিনি যে পৃথিবীর ঘাড়ে চড়ে দিব্বি যা খুশি করছি। সত্যিকার অর্থে ভেবেছি কি পৃথিবী কেমন আছে?
বাবার ঘাড়ে যখন চড়েছি তখন না হয় ছোট ছিলাম বুঝিনি। কিন্তু পৃথিবীর ঘাড়ে চড়ে যখন এত কিছু করছি, দেখছি অথচ একবারও কি তাকে বুঝতে চেষ্টা করছি? আমরা মানুষ জাতি বড় স্বার্থপর, আমরা শুধু নিতেই শিখেছি দিতে নয়।
নোবেল করোনা যেভাবে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে মনে হচ্ছে ফেসবুকের মত ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম একজনকে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম গ্লোবের সবার সঙ্গে। কিভাবে এখন করোনা ভাইরাসকে আনফ্রেন্ড করব এটাই এখন প্রশ্ন?
এত স্বল্প সময়ে কত কিছু ঘটছে তার মধ্যেও চলছে ধান্দাবাজি, চলছে দুর্নীতি, রটছে গুজব। মনে হচ্ছে শুধু যে বা যারা বিপদে ক্ষতিগ্রস্ত সে বা তারা ছাড়া অন্য কেউ বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করছে না। এখনও বেশির ভাগ মানুষ শুধু তাকে নিয়েই ব্যস্ত, কিন্তু কেন? বুঝতে পারছে না যে এরাই বর্তমান সমাজের বড় ভাইরাস।
একটি জ্বলন্ত উদাহরণ দেই। জানুয়ারি মাসে দুই জন চীনা নাগরিক ইটালি ভ্রমণে আসে। তাদের সঙ্গে নিশ্চিত অনেকেরই কোন না কোনভাবে মেলামেশা হয়েছে। যেমন যে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, টয়লেট, শপিং, বিনোদন, রাস্তা কফিশপ ইত্যাদি জায়গার যেখানেই তারা ঘুরেছে, কিছু ছুঁয়েচে, কিছু ধরেছে। বলা যায় ভিজিট কার্ড রেখে এসেছে।
অ্যালেক্স নামের যে ছেলেটির সঙ্গে তারা মিশেছিল সেই অ্যালেক্স হয়েছিল ইটালির সর্বপ্রথম করোনা রুগী, যে অসুস্থ হয়ে প্রথম হাসপাতালে ঢোকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অ্যালেক্সের ব্যবহারে এবং তার বিরক্তিকর আচরণে তেমন খুশি হয়নি। যার কারণে বা ভুলের কারণে জানিনা, কয়েকদিন হাসপাতালে অ্যালেক্স চিকিৎসা হবার পর ভালো ফিল করে।
তার শরীরে করোনা ভাইরাস তখনও রয়েছে সত্ত্বেও কোনরকম চেকিং না করেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়। অ্যালেক্স করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রুগী। দিব্যি ওই দুই চাইনিজদের মত বাইরে, ভিতরে, আড়ালে, সামনে, দিনে, দুপুরে মনের আনন্দে ভাসমান পৃথিবীর ঘাড়ে চড়ে ইটালির এক শহরে মনের মত ঘুরেছে, চলেছে খেয়েছে, ঘুমিয়েছে।
সামান্য কয়েকদিনের মধ্যে শুধু অ্যালেক্সের কারণে ছয়শোর বেশি ইটালিয়ান করোনায় আক্রান্ত হয়। তার মানে এখন বুঝতে চেষ্টা করুন বাকি ছয়শো জন আরও কত শত জনের সংস্পর্শে এসেছিল, প্লাস সেই দুই চাইনিজের কারণে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।
ইটালিয়ান জাতি ফ্যামিলি ওরিয়েন্টেড। তারপর তাদের দাদা, দাদী, নানা, নানী সবাই যেমন পরিবারের একান্নভুক্ত তেমন তারা একত্রিত হয়ে পার্কে, কফিশপে আড্ডা মারা, গসিভ করা পছন্দ করে। ইটালির লোক সংখ্যার অনেকের বয়সসীমা ৭০ বছরের বেশি।
সেখানকার আবহাওয়া চমৎকার। তারপর লম্বা একটি দেশ। যার তিনপাশে সাগর আর একপাশে পাহাড়। চমৎকার পরিবেশ করোনাভাইরাসের বংশবিস্তার করার পেছনে। সব মিলে ইটালির মানুষ পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবারের এই ছোঁয়াচে রোগে।
সবকিছু জানার পর আমরা সবাই বাংলাদেশের কথা ভাবতেই পারি। প্রচুর লোক তাই যুক্তি থাকতেই পারে সতর্কতা অবলম্বন করার পেছনে। তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেটা করার করবেন। যদিও আমরা নিজেরাও বিপদের মধ্যেই বসবাস করছি। সময়টাকে ক্রিয়েটিভভাবে পার করতে চেষ্টা করছি।
একই সঙ্গে চেষ্টা করেছি একে অপরের পাশে দাঁড়াতে, পৃথিবীকে বুঝতে, পৃথিবীর মানুষকে বুঝতে। এখন কি সময় আছে কে হিন্দু কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান আর কে ইহুদি এসব কিছু ভাবার? আমি ভাবছি আমার কথা, তোমার কথা, মানুষের কথা এবং পৃথিবীর কথা। আর তুমি?
সূত্র : যুগান্তর, লেখক : রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে, [email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।