জুমবাংলা ডেস্ক: মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন চিকিৎসক, নার্সসহ একদল মানুষ। ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়া গর্ভবর্তী নারীর পাশে দাঁড়ালেন হাতে-হাত রেখে। আর তাতে ট্রেনের মধ্যে সেই নারী অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং ট্রেনের মধ্যে রক্তপাত হয়ে তার গর্ভে থাকা চার মাসের নবজাতক মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ান ট্রেনের যাত্রীরা।
ঢাকা-চিলাহাটিগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এ ঘটনা ঘটে। ট্রেনের মধ্যে ওই নারীর প্রসব করান ট্রেনে থাকা চিকিৎসক ও নার্সরা। ট্রেনের কামরা হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার। এ যেন সিনেমার কাহিনীর বাস্তব চিত্রায়ন।
ওই ট্রেনে দায়িত্বরত পার্বতীপুর হেড কোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘‘ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিলাহাটি যাচ্ছিল। বরাবরের মতো ট্রেনের পিছনের কোচ থেকে টিকিট চেকিং শুরু করি। সঙ্গে ছিলেন আরেক টিটিই বেলাল হোসেন। রাত ৮টা নাগাদ ট্রেন তখন গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। টিকিট চেক করতে ট্রেনের ‘জ’ নম্বর কোচে যাবার পর শাহিন আলম নামে এক যাত্রী জানান ‘ঘ’ নম্বর কোচে এক গর্ভবতী নারী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে জানাই— দ্রুত পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে ঘোষণা করতে যে ‘ট্রেনের মধ্যে যদি কোনো ডাক্তার থাকেন, তাহলে জরুরিভিত্তিতে ‘ঘ’ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ মাইকিং করার পর একজন ডাক্তার (ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ) ‘জ’ কোচ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলেন। এরপর ‘চ’ কোচ থেকে ৫ম বর্ষের শিক্ষানবিশ মহিলা ডাক্তার (রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী ডা. আফসানা ইসলাম রোজা) আসলেন। মাইকিং শুনে দুই জন নার্সও দ্রুত ‘ঘ’ কোচে ছুটে গেলেন।’’
টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘চিকিৎসক গর্ভবতী ওই নারীর রক্তপাত দেখে জরুরিভাবে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। এরমধ্য ৯৯৯-এ কল দিলেন এক যাত্রী। সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। ভাগ্য সহায় হলো, চিলাহাটি এক্সপ্রেসের ক্রসিং পড়েছে সেখানে। ৯৯৯ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দেওয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সঙ্গে কথা হলো, তারাও রেডি। এদিকে গর্ভবর্তী নারীর রক্তপাত যেন থামছেই না। গর্ভে থাকা চার মাসের নবজাতক গর্ভেই মারা গেল। নারী ডাক্তার, নার্সরা ডা. সানাউল্লাহর পরামর্শ মেনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ‘ঘ’ কোচের নারী যাত্রীরা নিজেদের কাছে থাকা কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা মুহূর্তে হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার। ওই নারীর স্বামী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একজন যাত্রী জানান, তার পকেটে মাত্র ১২০০ টাকার মতো আছে। তাৎক্ষণিক সকল যাত্রী যে যার মতো টাকা সংগ্রহ করা শুরু করলেন। প্রায় ৫ হাজারের মতো টাকা রোগীর স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হলো।’
টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে ওই নারীর মৃত বাচ্চাটি বের করে ফেলা হলো ডাক্তার-নার্সসহ সবার সহযোগিতায়। ডা. সানাউল্লাহ সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, রোগী এখন অনেকটা আশংকামুক্ত। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। ট্রেনের নারী যাত্রীরা ব্যাগ থেকে কাপড় ও অন্যান্য যাবতীয় জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করলেন। রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সেই স্যালাইন, হেক্সিসল, ডেটল যাত্রীরা যার কাছে যা ছিল, তা দিয়ে সাহায্য করলেন। পরে অবশ্য তাকে আর হাসপাতালে নিতে হয়নি।’
টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘সব কিছু যখন অনেকটা স্থিতিশীল, এখন দুশ্চিন্তা শুরু হলো জরুরিভিত্তিতে কিছু ওষুধ প্রয়োজন। ডাক্তার সাহেব ওষুধ লিখে দিলেন। তখন ঈশ্বরদীর টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠুকে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হলো। ঈশ্বরদীতে তখন মুষলধারে বৃষ্টিপাত চলছে। তবুও তিনি মোবাইলে প্রেসক্রিপশন পেয়ে নিজেই ওষুধের দোকানে গিয়ে সব ওষুধ কিনে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন মাস্টারের কাছে পাঠালেন। পরে ট্রেন স্টেশনে থামলে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি রোগীর স্বামীকে ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম বুঝিয়ে দেন।’
পরে রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ ওই নারী ও তার স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশনে নামেন। আর চিকিৎসক সানাউল্লাহ সারাটা রাত, সারাটা পথ ওই রোগীর পাশে বসেছিলেন। তার সঙ্গে সহযোগিতা করেন শিক্ষানবিস চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইন্ট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলাম। এভাবে একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় বেঁচে যান একজন নারী।
এ বিষয়ে টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘আমার চাকরি জীবনে ট্রেনের মধ্যে বেশকিছু মানবিক ঘটনা দেখেছি। তবে এই ঘটনা অভূতপূর্ব। ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যরা যেভাবে একজন অসুস্থ নারীর পাশে সহযোগিতা বাড়িয়ে দিলেন তা অনন্য। স্যালুট জানাই ওই সকল মানবিক মানুষদের।’
ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমার বাড়ি দিনাজপুরে। গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। ট্রেনের মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনে একজন চিকিৎসক হিসেবে বসে থাকতে পারিনি। যদিও ট্রেনের মধ্যে কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঢাল-তলোয়ার কিছু ছিল না, যেকারণে চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মধ্যেই সবার সহযোগিতায় নারীর প্রসব করানো সম্ভব হয় এবং তিনি বেঁচে যান। বড় কোনো বিপদ হয়নি। আমরা প্রথমে টাঙ্গাইল স্টেশনে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তিনি স্বাভাবিক আছেন। এ যেন সিনেমার কাহিনীর মতো।’
ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘জীবনে একটি অনন্য ঘটনার সাক্ষী হলাম।’
তরুণদের উদ্যোগে বীর মুক্তিযোদ্ধারে নামে নির্মাণ হলো কাঠের সেতু
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।