সোহান আমিন, রাজশাহী: দিন-দুপুরে কিংবা রাতে। প্রধান সড়ক, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কিংবা অলিগলিতে। যেখানেই অপরাধ সংঘঠিত হোক না কেন অপরাধীদের নিজেদের আড়াল করার আর কোনও সুযোগ নেই। ধরা পড়তে হচ্ছে গোপন ক্যামেরার চোখে।
বলছি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শহর রাজশাহীর কথা। নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো এই শহরে এখন যে কেউ নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে। গোপন ক্যামেরায় শনাক্ত হওয়ার ভয়ে কমে গেছে দুষ্কৃতিকারীদের তৎপরতাও।
রাজশাহীকে নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার (সেন্ট্রাল সিসি ক্যামেরা ইউনিট) গঠন করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)। ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর এটি চালুর পর এই মহানগরীতে অপরাধ করে কোনো অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার আর পথ নেই। নগরীর বিভিন্ন স্থানে বসানো পাঁচ শতাধিক ক্যামেরার যে কোনও একটিতে তাদের ধরা পড়তেই হবে।
বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) এই অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার উদ্বোধন করেন। আরএমপি কমিশনার মোঃ আবু কালাম সিদ্দিকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারটি সর্বাধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ও কমিউনিকেশন টেকনোলজি ব্যবহার করে পরিচালিত হচ্ছে।
অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারে কাজ করছেন পুলিশের একদল সুযোগ্য কর্মী। একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে অপারেশন ও টেকনিক্যাল কার্যক্রমের জন্য একজন ইন্সপেক্টর, একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও ছয়জন কনস্টেবল এবং বেতার কমিউনিকেশনের জন্যে তিনজন কনস্টেবল সার্বক্ষণিক ও পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি রাতে আরএমপি’র অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টার পরিদর্শনে গেলে দেখা যায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এক রুমে বসেই পুরো রাজশাহী শহরের কোথায় কি হচ্ছে তা দেখা যাচ্ছে। দিনের আলোর চেয়ে রাতেই যেন সব পরিস্কার। স্টেশন, বাস টার্মিনাল, শহরের সব সড়ক এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে মনিটরিং সেন্টার থেকে।
২৪ জুলাই মার্কিন রাষ্ট্রদুত পিটার হাস মনিটরিং সেন্টারটি পরিদর্শন করে অপরাধীদের শনাক্তে এবং নগরবাসীকে নিরাপত্তা দিতে সেন্টারটির ভূমিকার প্রশংসা করেন।
আরএমপি কমিশনার মোঃ আবু কালাম সিদ্দিক জুমবাংলাকে জানান, ‘প্রতিষ্ঠার পর অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের চুরির ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও চোর শনাক্ত করা হয়েছে। ছিনতাই ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ অপরাধী শনাক্ত করা হয়েছে। ইভটিজিংয়ের ঘটনারও সমাধান করা হয়েছে। সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধ চক্র দমনে সার্বক্ষণিক মনিটরিং টিম কাজ করছে। হারানো ঘটনারও রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে এই সেন্টারটির সহযোগিতায়। বেশি কিছু মারামারির ঘটনায় জড়িতদের ধরা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পুরো মেট্রোপলিটন এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করতে ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আমরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আইপি ক্যামেরা ও কমিউনিকেশন টেকনোলজি সিস্টেম ব্যবহার করছি। প্রতিটি ক্যামেরা হাই রেজুলেশন ভিডিও ধারণ করতে পারে। উচ্চগতিসম্পন্ন ডাটা ট্রান্সফারের জন্য ১২ কোরের অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করা হয়েছে।’
আবু কালাম সিদ্দিক আরও বলেন বলেন, ‘আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সর্বাধুনিক এই ইউনিট প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় সংঘটিত সব ক্লু-লেস অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকরণে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। ক্লু-লেস মার্ডার মামলার রহস্য উদঘাটনসহ আসামি শনাক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই ইউনিট।’
আরএমপি কমিশনার বলেন, ‘রাজশাহী মহানগরী এখন নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। অপরাধ করে কোনো অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই। নগরবাসীকে নিরাপত্তা দিতে সদা প্রস্তুুত আরএমপি’র সদস্যরা।’
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের সহায়তায় এক শতাধিক চুরির ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও চোর শনাক্তকরণ হয়েছে। এছাড়া মনিটরিং সেন্টারের সহায়তায় ২৫টির অধিক ছিনতাই ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ অপরাধী সনাক্ত, ২০টি ইভটিজিংয়ের ঘটনায় অপরাধী সনাক্ত, ১৫টি হারানো ঘটনার রহস্য উদঘাটন, ২০টি মারামারির ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ আসামী সনাক্ত, ছেলে/মেয়ে হারানো বা হারিয়ে যাওয়া নাটক করাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি হারানোর ১৫টি ঘটনার রহস্য উদঘাটন, ১০টি অজ্ঞান পার্টির ঘটনার আসামি শনাক্ত, ৫০টির অধিক সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ সনাক্তসহ দ্রুত সংবাদ প্রেরণ, ১০টিরও বেশি ক্লু-লেস মার্ডার মামলার রহস্য উদঘাটনসহ আসামি শনাক্তকরণ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরে অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের সহায়তায় একের পর এক অপরাধী শনাক্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসছে আরএমপি।
গত ২০ মে শহরের রেলগেট থেকে নিউমার্কেটের দিকে যাওয়ার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক শাতিল সিরাজের স্ত্রী ইফফাত জাহানের ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পরে মনিটরিং সেন্টারের সহায়তায় ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ছিনতাইকারী ওয়াদুদ বুলবুলকে (৩৬) শনাক্ত করার পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর মোড় থেকে তাকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।
আরএমপি সূত্র জানায়, এই মনিটরিং সেন্টার থেকে ট্রাফিক কন্ট্রোল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিল, শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা। সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের কারণে বিগত বছরের তুলনায় মহানগরীতে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অপরাধ কমেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।