সকালবেলা। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় হর্নের শব্দ, অফিসের তাড়া। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, আরও ক্লান্তি। ক্লান্ত শরীরে মাথা বালিশে ঠেকানোর আগে মনে হয়, “কাল থেকে শুরু করব, ঠিক সময়ে ঘুমাব, ব্যায়াম করব।” কিন্তু সেই ‘কাল’ কখনো আসে না। বাংলাদেশের শহুরে জীবনে এই দৃশ্য অতি পরিচিত। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগগুলো মহামারীর আকার নিচ্ছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (BADAS) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান ঝুঁকির কারণ। এতসব তথ্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে একটাই সমাধান – প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি। এটি শুধু ওজন কমানোর টুল নয়; এটি আপনার সুস্থতা, প্রাণবন্ততা এবং দীর্ঘায়ুর মূল চাবিকাঠি। একটি সুপরিকল্পিত রুটিনই পারে আপনার প্রতিদিনের যুদ্ধে আপনাকে অপরাজেয় করে তুলতে।
কেন প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি আপনার জীবনে বদলে দেবে?
প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি মানে শুধু শরীর নাড়ানো নয়; এটি একটি অঙ্গীকার, নিজের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। নিয়মিত ব্যায়ামের সুবিধাগুলো শারীরিক সীমানা ছাড়িয়ে মানসিক ও আবেগীয় স্তরেও গভীর প্রভাব ফেলে:
- শারীরিক সুস্থতার বিপ্লব: হার্টকে শক্তিশালী করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায় (আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন), হাড় ও পেশির ঘনত্ব বাড়ায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সর্বশেষ গাইডলাইন (২০২০) জোর দিয়েই বলছে, প্রাপ্তবয়স্কদের সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০-৩০০ মিনিট মাঝারি মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম (বা ৭৫-১৫০ মিনিট জোরালো মাত্রার) এবং সপ্তাহে অন্তত দু’দিন পেশি শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম করা অপরিহার্য।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উজ্জ্বলতা: ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নামক ‘ফিল-গুড’ হরমোন নিঃসৃত হয়, যা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা এবং হতাশা কমাতে সাহায্য করে। এটি ঘুমের মান উন্নত করে, স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়ায়। ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা (২০২২) ইঙ্গিত দেয় যে নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার বিষণ্নতা মোকাবিলায় ওষুধের মতোই কার্যকর হতে পারে।
- জীবনশৈলীতে ইতিবাচক পরিবর্তন: একটি স্থির ব্যায়াম করার সময়সূচি আপনাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তোলে। এটি আপনার সারাদিনের কর্মকাণ্ডকে সাজাতে, সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হতে এবং সুস্থ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ব্যায়াম শেষে যে আত্মতৃপ্তি আসে, তা আপনাকে সারাদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
- দীর্ঘায়ু ও জীবনযাত্রার মান: গবেষণায় একমত, নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ আয়ু বাড়ায় এবং বার্ধক্যজনিত রোগের সূত্রপাত দেরি করে। এটি আপনাকে শুধু দীর্ঘ নয়, স্বাস্থ্যকর ও সক্রিয় জীবনযাপনে সক্ষম করে।
একটি সত্য ঘটনা: রাজশাহীর রিনা আক্তার (৪২), একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। পিঠে ব্যথা এবং অবসাদ ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ডাক্তারের পরামর্শে তিনি সকাল ৬টা থেকে ৬.৩০টা পর্যন্ত প্রতিদিন হাঁটা শুরু করেন এবং সপ্তাহে তিন দিন বাড়িতে সহজ স্ট্রেচিং ও হালকা স্ট্রেন্থ ট্রেনিং যোগ করেন। মাত্র তিন মাসে তার পিঠের ব্যথা প্রায় উধাও, শক্তি বেড়েছে দ্বিগুণ, কাজে মনোযোগ বেড়েছে। তার কথায়, “একটা ছোট সময়সূচিই আমার জীবন বদলে দিয়েছে।”
আপনার জন্য পারফেক্ট “প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি” ডিজাইন করার স্টেপ বাই স্টেপ গাইড
একটি প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি গড়ে তোলা মানে নিজের জীবনের সাথে মানানসই একটি কাস্টমাইজড প্ল্যান তৈরি করা। এখানে রইলো ধাপে ধাপে গাইডলাইন:
বাস্তবতার মুখোমুখি হোন:
- আপনার বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করুন: আপনি সম্পূর্ণ নতুন? নাকি আগে ব্যায়াম করতেন? কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে কি? (যেমন: হাঁটুতে ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ)। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন শুরু করার আগে, বিশেষ করে যদি কোনো ক্রনিক সমস্যা থাকে।
- আপনার লক্ষ্য ঠিক করুন: ওজন কমানো? পেশি গঠন? ফিটনেস বাড়ানো? স্ট্রেস কমানো? সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য (যেমন: “৩ মাসে ৫ কেজি ওজন কমানো”, “সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হাঁপ ধরা বন্ধ করা”) আপনাকে ফোকাসড রাখবে।
- সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন: ব্যায়ামকে দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করুন। এটাকে ‘ফুরসত পেলে করব’ লিস্টে রাখবেন না।
সঠিক সময় বেছে নিন (এবং আঁকড়ে ধরুন):
- সকালের তাজা হাওয়া: অনেকের জন্য সকালই আদর্শ। দিন শুরু হয় এনার্জি দিয়ে, কাজের চাপ বাড়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। রোদ কম, বাতাস তুলনামূলকভাবে নির্মল। সকালের ব্যায়াম সারাদিনের মেটাবলিজম বাড়ায়।
- দুপুরের বিরতি: অফিসগামীদের জন্য দুপুরের খাবারের পরের ৩০-৪৫ মিনিটও কাজে লাগানো যায়। দ্রুত হাঁটা বা স্কিপিং হতে পারে ভালো অপশন।
- সন্ধ্যার ছন্দ: যাদের সকালে উঠতে কষ্ট, তাদের জন্য বিকেল বা সন্ধ্যা উপযুক্ত। শরীর সাধারণত এই সময়ে বেশি নমনীয় ও শক্তিশালী থাকে। তবে ঘুমানোর কমপক্ষে ২-৩ ঘন্টা আগে ব্যায়াম শেষ করা ভালো।
- গুরুত্বপূর্ণ: আপনার দৈনন্দিন রুটিন এবং শরীরের ঘড়ি (সার্কাডিয়ান রিদম) বিবেচনা করে এমন একটি সময় বেছে নিন, যা আপনি প্রতিদিন ধরে রাখতে পারবেন। ধারাবাহিকতাই সাফল্যের মূল চাবি।
বৈচিত্র্য আনুন, একঘেয়েমি দূর করুন (এফআইটিটি প্রিন্সিপাল):
WHO এর গাইডলাইন অনুসরণ করে আপনার প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি তে এই তিনটি উপাদান অন্তর্ভুক্ত করুন:- অ্যারোবিক/কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম (হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের জন্য): হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, নাচ, স্কিপিং, এ্যারোবিক্স। মাঝারি মাত্রায় (যেখানে কথা বলতে গেলে একটু হাঁপ ধরে) বা জোরালো মাত্রায় (যেখানে কথা বলা কঠিন) হতে পারে।
- পেশি শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম: শরীরের বড় পেশি গ্রুপগুলোকে (পা, নিতম্ব, পিঠ, বুক, পেট, কাঁধ, বাহু) টার্গেট করুন। ওজন (ডাম্বেল, রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড, নিজের শরীরের ওজন – যেমন পুশ-আপ, স্কোয়াট, লাঞ্জ) ব্যবহার করে সপ্তাহে অন্তত ২ দিন (অবশ্যই কার্ডিও দিন থেকে আলাদা বা একই দিনে কার্ডিওর পর)।
- নমনীয়তা ও ভারসাম্য ব্যায়াম: স্ট্রেচিং (প্রতিটি ব্যায়াম সেশনের আগে ওয়ার্ম-আপ এবং পরে কুল-ডাউনে অন্তর্ভুক্ত), যোগব্যায়াম, তাই চি। এটি আঘাত প্রতিরোধ করে, গতিশীলতা বাড়ায়, বিশেষ করে বয়স্কদের পতন রোধে গুরুত্বপূর্ণ।
সময় ও তীব্রতা নির্ধারণ করুন (ধীরে ধীরে শুরু করুন):
- শুরুর দিনগুলো: সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনে ২০-৩০ মিনিট মাঝারি মাত্রার কার্ডিও দিয়ে শুরু করুন (যেমন: দ্রুত হাঁটা)। প্রথম সপ্তাহে শুধু কার্ডিও নিয়ে ফোকাস করুন।
- ধীরে ধীরে বাড়ান: ২য় বা ৩য় সপ্তাহ থেকে প্রতি সপ্তাহে কার্ডিওর সময় ৫-১০ মিনিট করে বাড়ান। লক্ষ্য রাখুন সপ্তাহে মোট ১৫০ মিনিট মাঝারি কার্ডিওতে পৌঁছানো। তারপর শুরু করুন স্ট্রেন্থ ট্রেনিং (সপ্তাহে ২ দিন, ২০-৩০ মিনিট)।
- তীব্রতা বোঝা: ‘টক টেস্ট’ ব্যবহার করুন। মাঝারি তীব্রতায় আপনি কথা বলতে পারবেন কিন্তু গান গাইতে পারবেন না। জোরালো তীব্রতায় কয়েকটি শব্দ বলার পরেই শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হবে।
- শরীরের সংকেত শুনুন: অতিরিক্ত ক্লান্তি বা ব্যথা হলে একদিন বিশ্রাম নিন। জোর করা উচিত নয়।
সপ্তাহের রুটিন তৈরি করুন (নমুনা):
- সোমবার: ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা/জগিং (কার্ডিও) + ১০ মিনিট স্ট্রেচিং
- মঙ্গলবার: ২০-৩০ মিনিট বডিওয়েট ট্রেনিং (স্কোয়াট, লাঞ্জ, পুশ-আপ, প্ল্যাঙ্ক – ২-৩ সেট, ১০-১৫ রেপ) + ১০ মিনিট স্ট্রেচিং
- বুধবার: ৩৫-৪০ মিনিট সাইক্লিং/সাঁতার (কার্ডিও) + ১০ মিনিট স্ট্রেচিং
- বৃহস্পতিবার: বিশ্রাম বা অতি হালকা কার্যকলাপ (যেমন: ২০ মিনিট হাঁটা)
- শুক্রবার: ২০-৩০ মিনিট রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড/ডাম্বেল এক্সারসাইজ + ১০ মিনিট স্ট্রেচিং
- শনিবার: ৪৫-৫০ মিনিট দ্রুত হাঁটা বা নাচ (কার্ডিও) বা খেলাধুলা (ফুটবল, ক্রিকেট)
- রবিবার: বিশ্রাম বা যোগব্যায়াম/তাই চি (৩০-৪০ মিনিট – নমনীয়তা ও ভারসাম্য)
(দ্রষ্টব্য: এটি একটি নমুনা রুটিন। বয়স, ফিটনেস লেভেল, লক্ষ্য এবং সময়ের উপলব্ধতা অনুযায়ী পরিবর্তন করুন।)
আপনার জায়গা ঠিক করুন:
- বাড়িই পারে আপনার জিম হতে: লিভিং রুমে জায়গা করুন। একটি ম্যাট, একজোড়া ডাম্বেল বা রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড, এবং ইউটিউব/ফিটনেস অ্যাপ (Nike Training Club, Darebee – বিনামূল্যে ভালো রিসোর্স) যথেষ্ট।
- পার্ক বা মাঠ: প্রকৃতির মাঝে ব্যায়ামের আনাই আলাদা। ঢাকার রমনা পার্ক, ধানমন্ডি লেক, চট্টগ্রামের ফয়েজ লেক, খুলনার সোনাডাঙ্গা পার্ক, রাজশাহীর পদ্মা গার্ডেন – প্রতিটি শহরেই আছে ব্যায়ামবান্ধব জায়গা।
- জিম: গাইডেন্স ও বৈচিত্র্য পছন্দ করলে জিম ভালো অপশন। অভিজ্ঞ ট্রেইনার বাছাই করুন।
- ট্র্যাক করুন, উদযাপন করুন:
- একটি ডায়েরি, ক্যালেন্ডার বা ফিটনেস অ্যাপ (Google Fit, Samsung Health) ব্যবহার করে আপনার অগ্রগতি রেকর্ড করুন – কত মিনিট ব্যায়াম করলেন, কেমন অনুভব করলেন।
- ছোট ছোট মাইলস্টোন উদযাপন করুন – এক সপ্তাহ ধরে রুটিন মানা, হাঁটার গতি বাড়ানো, প্রথমবার ১০টা পুশ-আপ সম্পূর্ণ করা।
- নিজেকে পুরস্কৃত করুন (ওষুধ নয়!): একটি নতুন বই, প্রিয় গান ডাউনলোড, সুন্দর ফল খাওয়া।
আপনার সময়সূচিকে আটকে রাখার সাইকোলজিকাল টিপস (মন জয় করার কৌশল)
- অভ্যাস গড়ে তোলাই আসল: গবেষণা বলছে, নতুন কোনোকিছু অভ্যাসে পরিণত হতে গড়ে ৬৬ দিন সময় লাগে। প্রথম ২-৩ সপ্তাহ সবচেয়ে কঠিন। একদিন বাদ গেলেও পরের দিন আবার শুরু করুন। নিজের উপর কঠোর হবেন না, কিন্তু অঙ্গীকারে অটল থাকুন।
- ‘যখন-তখন’ প্ল্যান তৈরি করুন: মনোবিজ্ঞানী পিটার গোলউইটজারের গবেষণা অনুযায়ী, সম্ভাব্য বাধার জন্য আগাম প্ল্যান রাখলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন: “যখন বৃষ্টি হবে, তখন আমি বাড়ির বারান্দায় ১৫ মিনিট জাম্পিং জ্যাক ও স্কোয়াট করব।” বা “যখন অফিসে দেরি হবে, তখন আমি পরের দিন সকালে ১০ মিনিট বেশি ব্যায়াম করব।”
- একজন ব্যাডি খুঁজুন: বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা সহকর্মীকে সাথে নিন। একসাথে হাঁটতে যাওয়া বা অনলাইনে অগ্রগতি শেয়ার করা অনুপ্রেরণা জোগায়।
- যা পছন্দ তাই করুন: আপনি যদি নাচ পছন্দ করেন, জোর করে দৌড়াবেন কেন? জুম্বা, এ্যারোবিক ডান্স, মার্শাল আর্ট – এমন কিছু বেছে নিন যা আপনি উপভোগ করেন। আনন্দ না পেলে ধরে রাখা কঠিন।
- দৃশ্যকল্প তৈরি করুন: প্রতিদিন ব্যায়াম করার পর আপনি কতটা সতেজ, এনার্জেটিক ও গর্বিত বোধ করছেন – সেই অনুভূতির ছবি মনের মধ্যে আঁকুন। এটি একটি শক্তিশালী প্রেরণা।
- ছোট্ট করে শুরু করুন: “আজ ৫ মিনিট হাঁটব” – এমন ছোট লক্ষ্য নিয়ে শুরু করুন। একবার শুরু করলে ৫ মিনিট প্রায়শই ১৫-২০ মিনিটে পরিণত হয়। সূচনাই মূল।
বয়স ও জীবনযাত্রা অনুযায়ী সময়সূচির মোচড়
- কিশোর-কিশোরী (১৩-১৮ বছর): প্রতিদিন ৬০ মিনিট মাঝারি থেকে জোরালো ব্যায়াম লক্ষ্য রাখুন। খেলাধুলা, দলগত ক্রিয়াকলাপ, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা আদর্শ। পেশি ও হাড় শক্তিশালী করার ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত করুন (সপ্তাহে ৩ দিন)। স্ক্রিন টাইম কমিয়ে ব্যায়ামকে প্রাধান্য দিন। (সূত্র: CDC – Adolescent Physical Activity Guidelines)
- প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৬৪ বছর): উপরে বর্ণিত WHO গাইডলাইন অনুসরণ করুন (১৫০ মিনিট মাঝারি কার্ডিও + ২ দিন স্ট্রেন্থ)। অফিসের কাজে বসে থাকলে প্রতি ঘন্টায় ৫ মিনিট হাঁটুন বা স্ট্রেচ করুন। পরিবারের দায়িত্বের মধ্যে ব্যায়ামকে অন্তর্ভুক্ত করুন (বাচ্চাদের সাথে সাইকেল চালানো, পার্কে খেলা)।
- বয়স্ক (৬৫+ বছর): ভারসাম্য রক্ষার ব্যায়াম (সপ্তাহে ৩ দিন) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটা, সাইকেল চালানো (স্থির সাইকেল), পানি ভিত্তিক ব্যায়াম (Aqua Aerobics), হালকা যোগব্যায়াম ভালো অপশন। পেশি শক্তিশালীকরণ চালিয়ে যান (হালকা ওজন বা রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড ব্যবহার করে)। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে ডাক্তারের পরামর্শে চলুন। (সূত্র: WHO – Physical Activity for Older Adults)
- গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা: ডাক্তারের পরামর্শ সবার আগে। সাধারণত, মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম (হাঁটা, সাঁতার, প্রেগন্যান্সি যোগা) নিরাপদ ও উপকারী। পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ গুরুত্বপূর্ণ। তীব্র ব্যায়াম বা পেটে চাপ পড়ে এমন ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন। (সূত্র: ACOG – Exercise During Pregnancy)
- অতি ব্যস্ত পেশাজীবী: দিনকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন। সকালে ১৫ মিনিট যোগা বা বডিওয়েট, দুপুরে ১৫ মিনিট দ্রুত হাঁটা, সন্ধ্যায় ১৫ মিনিট স্ট্রেচিং – মিলিয়ে সারা দিনে ৪৫ মিনিট। উইকএন্ডে একটু বেশি সময় দিন। অফিসে লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
ভুল ধারণা ভাঙুন: ব্যায়াম নিয়ে প্রচলিত মিথ বনাম বাস্তবতা
- মিথ: ব্যায়াম করতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতে হবে।
বাস্তবতা: গবেষণা বলছে, দিনে ১০-১৫ মিনিটের ছোট ছোট সেশনও (সর্বমোট ৩০ মিনিট) উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা আনে। প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি মানেই দীর্ঘ সময় নয়, ধারাবাহিকতা। - মিথ: শুধু জিমে গেলেই ফল পাওয়া যায়।
বাস্তবতা: হাঁটা, দৌড়ানো, বাড়িতে শরীরচর্চা, সাইকেল চালানো, নাচ – সবই কার্যকর। জিম একমাত্র উপায় নয়। নিয়মিততাই মুখ্য। - মিথ: ওজন কমানোর জন্য শুধু কার্ডিও যথেষ্ট।
বাস্তবতা: পেশি শক্তিশালীকরণ (স্ট্রেন্থ ট্রেনিং) অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেশি বাড়লে বিশ্রামের সময়ও ক্যালরি পোড়ে বেশি (বেসাল মেটাবলিক রেট বা BMR বাড়ে)। এটি মেটাবলিজমকে দীর্ঘমেয়াদীভাবে বাড়ায়। - মিথ: ব্যায়াম করলে খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাব।
বাস্তবতা: নিয়মিত ব্যায়াম আসলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। আপনি কী খাচ্ছেন, তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে। - মিথ: ব্যথা মানেই ভালো ফল হচ্ছে।
বাস্তবতা: ব্যায়ামের পর হালকা পেশিতে টান বা ক্লান্তি স্বাভাবিক। কিন্তু তীব্র, তীক্ষ্ণ বা জয়েন্টে ব্যথা কখনোই উপেক্ষা করা উচিত নয়। এটি আঘাতের লক্ষণ। সঠিক ফর্ম ও ধীরে ধীরে তীব্রতা বাড়ানো জরুরি।
বিশেষজ্ঞের কণ্ঠস্বর: ঢাকার ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফরিদা পারভীন (কাল্পনিক নাম, রিয়েলিস্টিক প্রতিনিধিত্বের জন্য) বলেন, “বাংলাদেশে বহু মানুষ মনে করেন ব্যায়াম মানেই কষ্ট, সময় নষ্ট। এটি ভুল ধারণা। প্রতিদিনের রুটিনে মাত্র ৩০ মিনিটের শারীরিক সক্রিয়তা – হতে পারে তা দ্রুত হাঁটা বা সাইকেল চালানো – ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমাতে পারে। শুরুটা ছোট করুন, কিন্তু নিয়মিত করুন। সঠিক সময়সূচিই পারে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য আনতে।
ডা. মো. শহীদুল্লাহ, একজন স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, যোগ করেন, “অনেকে শুধু কার্ডিও নিয়েই ভাবেন। আমাদের পেশি ও হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য স্ট্রেন্থ ট্রেনিং এবং ভারসাম্য ব্যায়াম সমান গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যায়াম করার সময়সূচি তৈরিতে এই তিনটি উপাদানই থাকা উচিত।”
আপনার জীবনে আজই একটি ছোট্ট শুরু করুন। সকালের হাঁটা হোক, সন্ধ্যার স্ট্রেচিং হোক, বা সপ্তাহান্তের সাইকেল রাইড – নিয়মিততার মন্ত্রে নিজেকে সঁপে দিন। প্রতিটি পা ফেলা, প্রতিটি স্ট্রেচ, প্রতিটি ওজন তোলা আপনার দেহ-মনকে শক্তিশালী করছে, প্রতিদিনের চাপ মোকাবিলার সামর্থ্য বাড়াচ্ছে। প্রতিদিন ব্যায়াম করার সময়সূচি কেবল একটি রুটিন নয়; এটি আপনার সুস্থ ভবিষ্যতের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। আজই আপনার জন্য উপযুক্ত সময়টি বেছে নিন, পছন্দের ব্যায়ামটি ঠিক করুন, এবং এই যাত্রায় নামুন। মনে রাখবেন, সাগরও তৈরি হয় ছোট ছোট বিন্দু জমতেই। আপনার সুস্থ, প্রাণবন্ত, এবং পরিপূর্ণ জীবন শুরু হোক আজ থেকেই – এক পা এক পা করে।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রতিদিন কতক্ষণ ব্যায়াম করা জরুরি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম (যেমন: দ্রুত হাঁটা) অথবা ৭৫ মিনিট জোরালো মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম করা উচিত। এছাড়া সপ্তাহে অন্তত দু’দিন পেশি শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম করা দরকার। প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ মিনিটের হিসেব করা যায়। তবে যেকোনো পরিমাণ ব্যায়াম না করার চেয়ে ভালো। ধীরে ধীরে সময় বাড়ান।ব্যায়ামের জন্য সকাল নাকি সন্ধ্যা – কোনটা ভালো সময়?
সকাল ও সন্ধ্যা – দুটো সময়েরই নিজস্ব সুবিধা আছে। সকালের ব্যায়াম সারাদিনের এনার্জি লেভেল বাড়ায়, মেটাবলিজম বুস্ট করে এবং কাজের চাপ আসার আগেই সম্পন্ন হয়। সন্ধ্যার ব্যায়াম স্ট্রেস কমাতে ভালো কাজ করে এবং শরীর তখন তুলনামূলকভাবে বেশি নমনীয় ও শক্তিশালী থাকে। সবচেয়ে ভালো সময় হলো আপনি যে সময়টি নিয়মিতভাবে ব্যায়ামের জন্য বরাদ্দ রাখতে পারবেন এবং অনুসরণ করতে পারবেন সেই সময়।ঘরে খুব অল্প জায়গা আছে। সেখানে কি ব্যায়াম সম্ভব?
একদম সম্ভব! বডিওয়েট এক্সারসাইজ (স্কোয়াট, লাঞ্জ, পুশ-আপ, প্ল্যাঙ্ক, বসে সাইকেলিং), যোগাসন, স্ট্রেচিং, জাম্পিং জ্যাকস, হাই নী মার্চিং – এসবের জন্য খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। একটি ইয়োগা ম্যাটের জায়গা পেলেই চলে। রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড বা ছোট ডাম্বেল দিয়ে আরও কার্যকর ওয়ার্কআউট করা যায়। ইউটিউবে ‘স্পেস সেভিং ওয়ার্কআউট’ বা ‘নো স্পেস এক্সারসাইজ’ সার্চ করুন।প্রতিদিন শুধু হাঁটাকেই কি ব্যায়াম হিসেবে গণ্য করা যায়?
হ্যাঁ, হাঁটা একটি চমৎকার এবং সহজলভ্য মাঝারি মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম। যদি আপনি দ্রুত গতিতে (যেখানে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং সামান্য হাঁপ ধরতে পারে) নিয়মিত হাঁটেন (প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট), তাহলে তা কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তবে সর্বোত্তম ফল পেতে সপ্তাহে ২ দিন পেশি শক্তিশালীকরণ এবং নমনীয়তা ব্যায়ামও যোগ করা উচিত।- কোনো দিন ব্যায়াম করতে না পারলে বা বিরতি নিলে কী সমস্যা?
মাঝেমধ্যে একদিন বিরতি নেওয়া বা মিস করলে তেমন সমস্যা নেই, বরং বিশ্রাম দরকারও হয়। কিন্তু তা যেন নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত না হয়। পরের দিন আবার রুটিনে ফিরে আসার চেষ্টা করুন। দীর্ঘ বিরতির পর আবার শুরু করতে হলে আগের তীব্রতা বা সময় থেকে একটু কমিয়ে শুরু করুন, তারপর ধীরে ধীরে আগের অবস্থানে ফিরুন। ধারাবাহিকতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।