চোখ বন্ধ করুন। কল্পনা করুন এক সিনেমা হল। পর্দায় জ্বলজ্বল করছে এক দৃশ্য। নায়কের চোখে শুধু এক ফোঁটা জল, কিন্তু তা দেখে গোটা হলনাটাই নিস্তব্ধ। কান্না চেপে রাখা যায় না। কিংবা ভাবুন, এক নায়িকার হাসি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনের গোটা এক গল্পের ব্যথা আর জয়। এটাই তো বলিউডের সেরা অভিনয়-এর জাদু – যা শুধু দেখায় না, অনুভব করায়। যা শুধু বিনোদন দেয় না, স্পর্শ করে যায় হৃদয়ের গভীরে, ভাবিয়ে তোলে, কখনও অশ্রু ঝরায়, কখনও উজ্জীবিত করে। বলিউড শুধু নাচ-গান আর রোমান্সের ফ্যাক্টরি নয়; এখানে জন্ম নিয়েছে এমন কিছু অভিনয় শিল্পী ও পারফরম্যান্স, যেগুলো বিশ্ব সিনেমার মানদণ্ডেও ঈর্ষণীয়, যা সময়ের স্রোতে ভেসে যায়নি, বরং ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে। চলুন, ডুব দেই সেই অনন্য অভিনয় শিল্পের জগতে, যেগুলো দেখে আপনি বারবার মুগ্ধ হবেন, আবিষ্কার করবেন বলিউডের অদেখা, অনালোচিত এক গভীরতাকে।
বলিউডের সেরা অভিনয়: সময়ের স্রোতে যারা অমলিন হয়ে রয়েছেন (অভিনয়ের ইতিহাসের মাইলফলক)
বলিউডের গল্প শুধু আজকের নয়, এর শিকড় প্রোথিত বহু গভীরে। আজকের দ্যোতনাময় অভিনয়শিল্পীদের দাঁড়াবার ভিত তৈরি করেছেন যারা, তাদের অবদানকে ভোলার নয়। তাদের অবিস্মরণীয় বলিউড পারফরম্যান্স কেবল বক্স অফিসের সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছিল, গড়ে দিয়েছিল অভিনয়ের নতুন মানদণ্ড।
দিলীপ কুমার: ‘ট্র্যাজেডি কিং’ থেকে অভিনয়ের পাঠশালা: তাঁর নামই সমার্থক পরিশ্রম ও পদ্ধতির। ‘দেবদাস’ (১৯৫৫)-এ পারো’র অপেক্ষায় ধুঁকে ধুঁকে মরার সেই চরিত্রে শারীরিক ভাষা থেকে শুরু করে চোখের দৃষ্টিতে যে বিষাদের আস্তরণ ফেলতে পারতেন, তা আজও পাঠ্য। ‘মুঘল-ই-আজম’ (১৯৬০)-এ সালিমের ভূমিকায় রাজকীয় অহংকার ও প্রেমের উন্মাদনার মিশেল, কিংবা ‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১)-এ গ্রাম্য যুবকের সরলতা – প্রতিটিই মাস্টারক্লাস। তাঁর পদ্ধতি, ‘স্ট্যানিস্লাভস্কি সিস্টেম’ এর ভারতীয়করণ, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছে অমূল্য উত্তরাধিকার। ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত এই কিংবদন্তি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন এক জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের ইতিহাস ঘাটলেই তাঁর প্রভাব স্পষ্ট।
অমিতাভ বচ্চন: ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ থেকে ‘শহনশাহ’ এবং তারও পরের যাত্রা: সত্তরের দশকে ‘জঞ্জীর’ (১৯৭৩), ‘দিওয়ার’ (১৯৭৫), ‘শোলে’ (১৯৭৫) – এই তিন ছবিতে অমিতাভ যে বিদ্রোহী, ক্ষুব্ধ যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তা গোটা দেশের তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। তাঁর উচ্চকিত কণ্ঠ, দীর্ঘদেহী কাঠামো, তীব্র দৃষ্টি এবং স্ক্রিনে প্রিজেন্স বলিউড হিরোর সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছিল। ‘শোলে’-র জয়-এর ডায়লগ (“মেরে পাস মা হ্যায়”) কিংবা ‘অগ্নিপথ’ (১৯৯০)-এ বিজয় দীনানাথ চৌহানের হিংস্রতা ও ব্যর্থতা – এই পারফরম্যান্সগুলো শুধু হিট গান বা অ্যাকশন দৃশ্যের জন্য নয়, সিনেমার ইতিহাস সৃষ্টিকারী অভিনয় হিসেবেই স্মরণীয়। আশির দশকে প্রোডাকশন কোম্পানির দেউলিয়াত্বের পর ‘মহাভারত’ টিভি সিরিজে ভীষ্মের ভূমিকায় কণ্ঠ দান, এবং পরে ‘ব্ল্যাক’ (২০০৫)-এ অন্ধ-বধির মেয়ের শিক্ষক হিসেবে ফিরে আসা প্রমাণ করে, তাঁর প্রতিভার কোনো সীমা নেই।
- নুতন ও মীনা কুমারী: নারীর জটিলতাকে রূপদানের অগ্রদূত: নারীর ভূমিকাকে শুধু ‘লিড লেডি’ বা ‘মিউজ’ এর গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেননি এরা। নুতন ‘বন্দিনী’ (১৯৬৩)-তে স্বামীর অপরাধের দায় নিজ কাঁধে তুলে নেওয়া কৌশল্যায় তাঁর অভিনয়ে যে আত্মমর্যাদা ও সংগ্রামের ছবি ফুটে উঠেছিল, তা যুগান্তকারী। অন্যদিকে মীনা কুমারী, ‘পাকিজা’ (১৯৭২)-এর সাহেবজান। একইসাথে নর্তকী ও প্রেমিকায় রূপান্তরিত হওয়া এই চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল কবিতার মতো সূক্ষ্ম ও গভীর বিষাদে ভরা। ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’ (১৯৬২)-তে মদখোর জমিদার স্বামীর প্রতি অবহেলিত, মরীয়া এক স্ত্রীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় নারী মনস্তত্ত্বের এক জটিল দলিল। এই মহীয়সী নারীরা প্রমাণ করেছিলেন, বলিউডের নায়িকাও পারেন অভিনয় দক্ষতায় অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করতে।
সমসাময়িক বলিউডের সেরা অভিনয়: গল্প বলার নতুন ভাষা
যদি বলিউডের ইতিহাসের ভিত্তি দিয়েছেন পূর্বসূরিরা, তবে বর্তমান সময়ে সেই ভিতের উপর গড়ে উঠেছে আরও সাহসী, বৈচিত্র্যময় ও বাস্তবধর্মী অভিনয়ের জগৎ। আজকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা শুধু তারকাই নন, তারা স্টোরিটেলার, যারা নিরীক্ষা করতে ভয় পান না।
মেথড অ্যাক্টিংয়ের রাজা: ইরফান খান ও মনোজ বাজপেয়ী:
ইরফান খান (‘পান সিং তোমার’, ২০১২) ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা। তাঁর অভিনয়ের বৈশিষ্ট্যই ছিল স্বল্পবাক্ কিন্তু তীব্র প্রভাব। ‘পান সিং তোমার’-এ অ্যাথলিট থেকে ডাকাত হয়ে ওঠা মানুষের যন্ত্রণা, ক্ষোভ ও অসময়ের মৃত্যুকে তিনি কয়েকটি দৃশ্য আর চোখের অভিব্যক্তিতেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ (২০১৩)-তে এক নিঃসঙ্গ ক্লার্কের ভূমিকায় তাঁর উপস্থিতিই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
মনোজ বাজপেয়ী (‘गैंग्स ऑफ़ वासेपुर’, ‘सरफरोश’, ‘अलीगढ़’) হলেন চরিত্র অভিনয়ে বলিউডের সেরা শিল্পীদের অন্যতম। ‘गैंग्स ऑफ़ वासेपुर’-এর सुल्ताना কিংবা ‘भाग मिल्खा भाग’ (2013)-এ ক্রিকেট কোচের ভূমিকায় তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে ফেলতে পারেন। তাঁর প্রতিটি চরিত্রে ভিন্ন উচ্চারণ, ভিন্ন শরীরী ভাষা, ভিন্ন চিন্তাভাবনা – যা অভিনয় কৃতিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।নারী শক্তির অভিনয়ে উত্থান: ভূমিকা চাওলা, তাবু থেকে আলিয়া ভাট:
- ভূমিকা চাওলা (‘দ্য ডার্ক হর্স’, ‘দঙ্গল’): ‘দঙ্গল’ (২০১৬)-তে গীতার বাবা মহাবীর সিং ফোগাটের ভূমিকায় তিনি শুধু শারীরিক রূপান্তরই করেননি, কড়া, দৃঢ়চেতা কিন্তু কন্যাস্নেহে ভরা এক পিতার মনস্তত্ত্বকে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের তীব্রতা পুরো ছবিটির টোন নির্ধারণ করেছিল।
- তাবু (‘হায়দার’, ‘আন্ধাধুন’, ‘চণ্ডীগড় করেঅ্যারে’): দশকের পর দশক ধরে অভিনয়ে রাজত্ব করছেন তাবু। ‘হায়দার’ (২০১৪)-তে গাজালা মীরের ভূমিকায় তিনি ছিলেন রহস্যময়ী, জটিল এবং ভয়ংকর। তাঁর ‘জবরদস্ত কথন’ মনোগ্রাফ দৃশ্য (‘हमें क्या चाहिए? आज़ादी!’) অভিনয় শিল্পের এক মাস্টারপিস। ‘আন্ধাধুন’ (২০১৮)-তে তিনি প্রমাণ করেন কমেডি ও থ্রিলারের নিখুঁত সংমিশ্রণ কীভাবে করতে হয়।
- আলিয়া ভাট (‘হাইওয়ে’, ‘উড়তা পাঞ্জাব’, ‘গঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’): অত্যন্ত কম বয়স থেকেই নিজের সীমানা ভেঙেছেন আলিয়া। ‘হাইওয়ে’ (২০১৪)-তে অপহৃত তরুণীর মানসিক যাত্রা, ‘উড়তা পাঞ্জাব’ (২০১৬)-তে মাদকাসক্ত যুবতীর পতন ও উত্থান, এবং ‘গঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’ (২০২১)-তে মুম্বাইয়ের অন্ধকার জগতের মাস্তান নেত্রীর ভূমিকায় তাঁর রূপান্তর ছিল চমকপ্রদ। তাঁর কাজে চরিত্রে ডুবে যাওয়ার দক্ষতা স্পষ্ট।
- গল্পের নায়ক নয়, গল্পের মানুষ: রজত কাপুর, নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকী, পঙ্কজ ত্রিপাঠি:
এরা হলেন সেই অভিনেতারা, যারা মুখ্য ভূমিকা হোক বা পার্শ্ব – তাদের উপস্থিতিই দৃশ্যকে স্মরণীয় করে তোলে।- রজত কাপুর (‘কাপুর অ্যান্ড সন্স’, ‘দিল ধড়কনে দো’): ‘কাপুর অ্যান্ড সন্স’ (২০১৬)-তে সন্তানদের সাথে বাবার দূরত্ব ও ভালোবাসার যে সূক্ষ্ম সমীকরণ তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা হাসি ও কান্নার সীমা মুছে দিয়েছিল।
- নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকী (‘গঞ্জ’, ‘ম্যানজি: দ্য মাউন্টেন ম্যান’, ‘স্যাক্রেড গেমস’): ‘গঞ্জ’ (২০১৮)-তে গঞ্জু ভাইয়ের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় ছিল হৃদয়বিদারক। একইসাথে ‘স্যাক্রেড গেমস’-এর গেইটস মিয়াঁ বা ‘ম্যানজি’-র দাশরথ মাঞ্জির মতো বিপরীতধর্মী চরিত্রেও তিনি সমানভাবে বিশ্বাসযোগ্য।
- পঙ্কজ ত্রিপাঠি (‘मुंडा’, ‘न्यूटन’, ‘मिर्ज़ापुर’): ‘गैंग्स ऑफ़ वासेपुर’-এর सुल्तानা থেকে ‘मिर्ज़ापुर’-এর कालीन ভাইয়া, পঙ্কজ ত্রিপাঠি প্রতিটি চরিত্রকেই অনন্য করে তোলেন। ‘न्यूटन’ (2017)-তে নির্বাচনী আধিকারিকের ভূমিকায় তাঁর সূক্ষ্ম হাস্যরস ও বাস্তবতা চিত্রণ ছিল অসাধারণ।
বলিউডের সেরা অভিনয়: যেসব পারফরম্যান্স সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে (বিশেষ দৃষ্টান্ত)
কিছু পারফরম্যান্স শুধু ভালোই নয়, তারা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, অভিনয়কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
- রানী মুখার্জি (‘ব্ল্যাক’, ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’): ‘ব্ল্যাক’ (২০০৫)-তে মিশেল ম্যাকনেলি, যে অন্ধ-বধির-বাক্প্রতিবন্ধী মেয়ে, তার ভূমিকায় রানীর অভিনয় ছিল অভূতপূর্ব। শব্দ ও আলোর জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এক মানুষের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, ক্রোধ, হতাশা ও অবশেষে জয়কে তিনি শারীরিক অভিনয়ের এক অকল্পনীয় স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এটি শুধু বলিউড নয়, বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসেই অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।
- অমিতাভ বচ্চন (‘পা’, ‘পিঙ্ক’): ‘পা’ (২০০৯)-তে প্রোজেরিয়া নিয়ে জন্মানো অরোভিন্দের চরিত্রে শুধু শারীরিক রূপান্তরই নয়, বরং সেই চরিত্রের আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও জীবনযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি এমন মমতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে দর্শক চরিত্রটিকেই ভুলে যেতেন, মনে হতো অমিতাভ বচ্চনকে দেখছেন না। ‘পিঙ্ক’ (২০১৬)-তে অবসরপ্রাপ্ত উকিলের ভূমিকায় তাঁর জোরালো, সময়োপযোগী অভিনয় পুরো ছবিটির মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছিল।
- দীপিকা পাড়ুকোন (‘পিকু’, ‘চপাক’, ‘গেহরাইয়া’): ‘পিকু’ (২০১৫)-তে গর্ভবতী মহিলার ভূমিকায় দীপিকার অভিনয় ছিল প্রাণবন্ত, হাস্যরসাত্মক এবং গভীরভাবে মানবিক। ‘চপাক’ (২০২০)-তে অ্যাসিড আক্রমণের শিকার লক্ষ্যী আগরওয়ালের বাস্তব জীবনের গল্পে তিনি শুধু শারীরিক ক্ষতই নয়, সেই ক্ষতের গভীর মানসিক ও সামাজিক প্রভাবকেও অসাধারণ সংযম ও শক্তি নিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ‘গেহরাইয়া’ (2018)-তে নেশাগ্রস্ত নারীর ভূমিকায় তাঁর রুক্ষ, কঠিন রূপও ছিল অভিনীত।
- সোয়ানন্দ কিরকিরে (‘তানহাজী’, ‘মিমি’, ‘সর্দার উদহম’): ‘তানহাজী’ (২০২০)-তে শিবাজী মহারাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি উদয়ভান এবং ‘মিমি’ (২০২১)-তে সুরক্ষিত মাতৃত্বের জন্য লড়াই করা সারোগেট মায়ের স্বামীর ভূমিকায় সোয়ানন্দের অভিনয় ছিল নিখুঁত। ‘সর্দার উদহম’ (2022)-তে তিনি স্বয়ং সর্দার উদম সিং-এর ভূমিকায় জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের সূক্ষ্মতা ও প্রাকৃতিকতা তাঁকে সমসাময়িক অভিনয় কৃতিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত করে তুলেছে।
- ভিকি কৌশল (‘মাসান’, ‘রমন রাঘব ২.0’, ‘সর্দার উদহম’): ‘মাসান’ (২০১৫)-তে ডুবন্ত মানবিকতার মাঝেও ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যুবকের ভূমিকায় ভিকির অভিনয় ছিল মর্মস্পর্শী। ‘রমন রাঘব ২.0’ (2016)-তে একজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সহিংস পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় তিনি ছিলেন ভয়ঙ্করভাবে বিশ্বাসযোগ্য। ‘সর্দার উদহম’ (2022)-তে পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়ও তাঁর উপস্থিতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাহসিকতা অবিস্মরণীয় বলিউড পারফরম্যান্স এর তালিকায় তাঁর নাম স্থায়ী করেছে।
বলিউডের সেরা অভিনয়: ক্যামেরার আড়ালের যাত্রা ও প্রস্তুতি
সিনেমার ইতিহাস সৃষ্টিকারী অভিনয় শুধু জন্মগত প্রতিভার ফল নয়; এর পেছনে থাকে অকল্পনীয় পরিশ্রম, গবেষণা, এবং চরিত্রে ডুবে যাওয়ার দক্ষতা।
- গবেষণা ও প্রস্তুতি: ইরফান খান ‘পান সিং তোমার’-এর জন্য দীর্ঘদিন রিসার্চ করেছিলেন, পান সিং-এর গ্রামে গিয়েছিলেন, স্থানীয় ভাষা ও আচরণ শিখেছিলেন। ভূমিকা চাওলা ‘দঙ্গল’-এর জন্য প্রায় দু’বছর কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। রানী মুখার্জি ‘ব্ল্যাক’-এর জন্য দেড় বছর অন্ধ ও বধির মানুষদের সাথে কাটিয়েছিলেন, তাদের সংবেদনশীলতা বুঝতে।
- শারীরিক ও মানসিক রূপান্তর: আলিয়া ভাট ‘গঙ্গুবাই’-এর জন্য মারাঠি ভাষা ও মুম্বাইয়ের ‘কথি’ ভাষা রপ্ত করেছিলেন, শারীরিক ভঙ্গিমা বদলেছিলেন। দীপিকা পাড়ুকোন ‘চপাক’-এর জন্য অ্যাসিড আক্রমণের শিকারদের সাথে সময় কাটিয়েছিলেন, তাদের যন্ত্রণা ও সংগ্রামকে অন্তরে ধারণ করার চেষ্টা করেছিলেন। অমিতাভ বচ্চন ‘পা’-তে প্রোজেরিয়া রোগীদের গতিবিধি, কথা বলার ভঙ্গি নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছিলেন।
- মানসিক চাপ মোকাবেলা: এত গভীরে চরিত্রে ডুবে যাওয়া মানসিকভাবে কঠিন হতে পারে। অনেক অভিনেতাই স্বীকার করেন যে কিছু চরিত্র ছাড়তে, তার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের সময় লেগেছে। এই মানসিক ভার বইবার ক্ষমতাও অভিনয় দক্ষতায় অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টির অপরিহার্য অংশ।
বলিউডের সেরা অভিনয়: দর্শককে কেন মুগ্ধ করে?
একটি অবিস্মরণীয় বলিউড পারফরম্যান্স কেন এতটা প্রভাব ফেলে?
- সত্যিকারের মানবিক আবেগের সন্ধান: এই অভিনয়গুলো আমাদের নিজেদের ভেতরের সুখ, দুঃখ, ক্রোধ, ভালোবাসা, ভয়, আশার প্রতিধ্বনি খুঁজে পায়। তারা চরিত্রের ভেতর দিয়ে মানুষ কে খুঁজে বের করে।
- বিশ্বাসযোগ্যতা: দর্শককে ভুলিয়ে দেওয়া যে, তারা কোনো অভিনেতাকে দেখছেন না, বরং সত্যিকারের একজন মানুষকে দেখছেন – যার নিজের গল্প, সংগ্রাম ও অনুভূতি আছে। এই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয় গভীর প্রস্তুতি ও সম্পূর্ণ চরিত্রে ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে।
- বাস্তব জীবনের প্রতিফলন: অনেক সময় এই পারফরম্যান্সগুলো সমাজের আয়না হয়ে ওঠে। ‘পিঙ্ক’ আমাদের যৌন নিগ্রহ ও সম্মতির বিষয়ে ভাবায়, ‘চপাক’ অ্যাসিড সহিংসতার ভয়াবহতা সামনে আনে, ‘আন্ধাধুন’ নৈতিকতার ধূসর এলাকাকে উন্মোচিত করে।
- কথার চেয়ে বেশি কিছু বলার ক্ষমতা: দিলীপ কুমারের চোখের ভাষা, নুতনের হাসির আড়ালে লুকানো ব্যথা, ইরফান খানের নিস্তব্ধতা – এগুলো ডায়লগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়।
- অনুপ্রেরণা ও ক্যাথারসিস: এরা আমাদের দেখায় সংগ্রামের পথ, মানবিক শক্তির উৎকর্ষ। একইসাথে, চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা নিজেদের আবেগও খালি করি – এটাই ক্যাথারসিস।
জেনে রাখুন
প্র: বলিউডের সেরা অভিনয় বলতে আসলে কী বোঝায়?
উ: বলিউডের সেরা অভিনয় বলতে বোঝায় সেইসব পারফরম্যান্স যেগুলো শুধু বিনোদন দেয় না, গভীরভাবে স্পর্শ করে, ভাবায়, আবেগ আন্দোলিত করে। এগুলো চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলে, গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে, এবং প্রায়ই অভিনয় শিল্পের নতুন মাপকাঠি তৈরি করে। এতে থাকে অপরিসীম প্রস্তুতি, চরিত্রে সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়া এবং মানবিক অনুভূতির সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ।প্র: কোন বলিউড অভিনেতার সবচেয়ে বেশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছে?
উ: বলিউডে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ের দিক থেকে শাহরুখ খান ও অমিতাভ বচ্চন উল্লেখযোগ্য। তবে, সর্বাধিকবার (সাতবার) ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে’ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা/অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন অভিনেতা অমোল পালেকর (মূলত হিন্দির বাইরে কাজের জন্য, তবে বলিউডেও সক্রিয়)। বলিউড অভিনেত্রীদের মধ্যে শ্রীদেবী ও কঙ্গনা রানাওয়াত প্রত্যেকে দু’বার করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আলিয়া ভাট (‘গঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’) ও অলঙ্কৃত শরণ (‘বাধাই হো’) জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অফিসিয়াল আর্কাইভ দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়।প্র: বলিউডের সেরা অভিনয় কি শুধু ড্রামা বা সিরিয়াস ছবিতেই দেখা যায়?
উ: একেবারেই না। বলিউডের সেরা অভিনয় বিভিন্ন ধারাতেই ছড়িয়ে আছে। কমেডিতে রাজকুমার রাও (‘বরেিল্লি কি বরফি’), আয়ুষ্মান খুরানা (‘বাধাই হো’), পরেশ রাওয়াল (‘হেরা ফেরি’) বা জনি লিভার-এর মতো শিল্পীদের পারফরম্যান্স অভিনয়ের উৎকর্ষের উজ্জ্বল উদাহরণ। থ্রিলারে (‘খোসলা কা ঘোসলা’, ‘তালবার’), রোমান্টিক ফিল্মে (‘দিল সে..’, ‘জব উই মেট’) কিংবা অ্যাকশন ফিল্মেও (‘শোলে’, ‘দিওয়ার’) অসাধারণ অভিনয় চর্চা হয়েছে। দক্ষতা যে কোনো ঘরানায় প্রকাশ পেতে পারে।প্র: একজন দর্শক হিসেবে আমি কিভাবে বলিউডের সেরা অভিনয়কে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারি?
উ: কয়েকটি উপায় আছে:- মনোযোগ দিন: শুধু গল্পের মুভমেন্ট নয়, অভিনেতার মুখের অভিব্যক্তি, চোখের ভাষা, শরীরী ভঙ্গি, হাতের নড়াচড়া, পজিশনে সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোর দিকে খেয়াল করুন।
- প্রেক্ষাপট বুঝুন: চরিত্রটির পটভূমি, তার সংগ্রাম, তার লক্ষ্য কী – তা বুঝলে অভিনয়ের গভীরতা বোঝা সহজ হয়।
- ডায়লগ শুনুন: শুধু শব্দ নয়, কীভাবে বলা হচ্ছে, কণ্ঠের টোন, উচ্চারণের ভঙ্গি – এসবেও অনেক আবেগ ও অর্থ লুকিয়ে থাকে।
- প্রতিক্রিয়া ভাবুন: চরিত্রটি কেন এমন আচরণ করল? আপনার নিজের কী অনুভূতি হল? নিজের জীবনের সাথে কি কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন?
- বিভিন্ন শিল্পী ও ঘরানা দেখুন: শুধু স্টার-ড্রাইভেন ফিল্ম নয়, স্বাধীন ধারার ছবি (Indie Films), অথবা কম পরিচিত কিন্তু দক্ষ অভিনেতাদের কাজও দেখুন।
- প্র: সাম্প্রতিক সময়ে কোন বলিউড অভিনয় আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে?
উ: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স এসেছে। সোয়ানন্দ কিরকিরে ‘সর্দার উদহম’ (২০২২)-এ সর্দার উদম সিং-এর ভূমিকায়, ভিকি কৌশল ‘সর্দার উদহম’-এ পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়, আলিয়া ভাট ‘গঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’ (২০২১)-তে, ভূমিকা চাওলা ‘দঙ্গল’ (২০১৬) ও ‘থাপড়’ (২০২১)-তে, দীপিকা পাড়ুকোন ‘চপাক’ (২০২০)-তে, সানি পওয়ার ‘শেরশাহ’ (২০২১)-তে, তাপসী পান্নু ‘থাপড়’ (২০২১)-তে, রজত কাপুর ‘কাপুর অ্যান্ড সন্স’ (২০১৬)-তে, এবং অলঙ্কৃত শরণ ‘বাধাই হো’ (২০২২) ও ‘কাথাল’ (2023)-তে তাঁদের অভিনয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। প্রত্যেকের কাজই অনন্য দক্ষতা ও গভীরতার স্বাক্ষর বহন করে।
বলিউডের ইতিহাসে যে অগণিত অভিনয় দক্ষতায় অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে, তা শুধু বিনোদন নয়, তা মানবিক আবেগ, সংগ্রাম, জয় ও সৌন্দর্যের এক জীবন্ত আর্কাইভ। দিলীপ কুমারের বিষাদ থেকে ইরফান খানের নিস্তব্ধতা, নুতনের আত্মমর্যাদা থেকে রানীর অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, ভূমিকার রূপান্তর থেকে সোয়ানন্দের নিখুঁততা – প্রতিটি বলিউডের সেরা অভিনয় আমাদের একটু একটু করে বদলে দেয়, আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের জগতকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়। পরের বার যখন আপনি কোনো বলিউড ছবি দেখবেন, শুধু গল্প বা গানেই নয়, খুঁজে দেখুন সেই অনন্য অভিনয় শিল্পকে, যা পর্দার আড়াল থেকে আপনার হৃদয়ে সরাসরি কথা বলে। কোন বলিউড অভিনয় আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল? কমেন্টে শেয়ার করুন – চলুন অভিনয়ের এই জাদুকে একসাথে উদযাপন করি!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।