রংবাহারি পাখিদের নান্দনিকতায় মুখরিত পৃথিবী। তাদের সৌন্দর্য, আকৃতি, পালকের রঙের বৈচিত্র্য আর সুর লহরীমায় আকৃষ্ট না এমন মানুষ হয়তো পৃথিবীতে নেই। পাখিদের মধ্যে টিয়া জাতীয় পাখি সবার কাছে সমাদৃত। প্রাকৃতিক পরিবেশে বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় একসময় টিয়া পাখির সৌন্দর্যে মুখরিত ছিল।
পাশাপাশি অন্যান্য সবুজে ঘেরা শহরগুলোও ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে এই পাখি। মানুষ ক্ষমতা বলে নিজের করে আবদ্ধ রাখতে চায় এ পাখিদের, যা প্রকৃতির নীতি বিরুদ্ধ। ফলে শহর থেকে ক্রমেই কমছে টিয়া পাখির সংখ্যা। পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ প্রজাতির টিয়াপাখি পাওয়া যায়। এদের মধ্যে Psittaciformes বর্গের অন্তর্গত Psittacidae পরিবারের সাত প্রজাতির টিয়ার দেখা মেলে বাংলাদেশে। এগুলোর মধ্যে শহরে দেখা যায় চার প্রজাতির টিয়া।
২০১৬ সাল। আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একা একা ঘুরে বেড়াতাম বন্যপ্রাণীর খোঁজে। ছুটতাম ফড়িংয়ের পিছু পিছু। ফজরের নামাজের ঠিক পরে আর সন্ধ্যায় শত শত টিয়াপাখির কলতানে মুখরিত থাকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
শুধু ক্যাম্পাস এলাকা নয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণে ঢাকা থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে টিয়ারা। খাদ্যাভাব, আবাসস্থলের সংকট, বড় বড় গাছের অভাব, দূষিত পরিবেশ ও চোরা শিকারের কারণে টিয়া জাতীয় পাখিদের সংখ্যা এখন অনেকটা কমে গেছে ঢাকা শহরে। বাংলাদেশে সচরাচর Rose-ringed Parakeet নামে টিয়া দেখা যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula krameri। নীলাভ সবুজ শরীর আর লাল চঞ্চু। পাশাপাশি পুরুষের শরীরে থাকে গোলাপি এবং কালো মালা।
জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে এরা প্রজনন করে। ঢাকা শহরে গাছের ফোকর, বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন গর্তে বাসা তৈরি করে। ফলভুক পাখিটি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি। এ পাখি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি থাকলেও গত একদশকে অনেকটা কমে গেছে। আগের মতো বড় ঝাঁকের দেখা মেলে না। কারণ, শহরের বড় গাছপালা কমছে। এতে পাখির আবাসস্থল কমছে। ফলে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। পাশাপাশি অবৈধ চোরাচালান, খাঁচায় আবদ্ধকরণ এ পাখিটিকে ক্রমেই ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে চন্দনা টিয়া আকারে সবচেয়ে বড়। এর Alexandrine Parakeet নামের Alexandrine এসেছে সম্রাট আলেক্সান্ডারের নাম থেকে। তাঁর সময়ে এ পাখিটি ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula eupatria। এরা একাকী এবং ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে ঘোরাফেরা করে। সাধারণত ফল, শস্য, বীজ, ফুল ও মধু খায়। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস এদের প্রজনন ঋতু।
২০০০ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশের তথ্যে টিয়াকে ক্রিটিক্যালি ইনডেঞ্জার্ড (Critically Endangered) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ২০১৫ সালের তথ্যমতে পাখিটি লিস্ট কনসার্ন (Least Concern) এর আওতায়। রাজধানীর পাশাপাশি বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চলে দেখা মেলে এই পাখির। পাখিটি বাংলাদেশে ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত। টিয়া ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
টিয়ার আরেকটি প্রজাতির নাম মদনা টিয়া (Red-breasted Parakeet)। বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula alexandri। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে স্মরণ করে তাঁর সেনাবাহিনী গ্রিক অঞ্চলে এই প্রজাতির পাখি নিয়ে এসেছিল। লালচে পেট, দেহ সবুজ। কাঁধ হলদে এবং মাথা ধূসর। হলদে চোখ এবং চোখ থেকে কপাল পর্যন্ত কালো ব্যান্ড। নিচের চঞ্চু কালো। লেজ বেগুনী-নীল এবং লেজের সামনে হলুদ। পুরুষের ওপরের চঞ্চু গাঢ় লাল আর স্ত্রী টিয়ার কালচে বাদামি।
এরাও একাকী অথবা জোড়ায় ঘুরতে পছন্দ করে। সাধারণত নরম কান্ড, ফল, বীজ, শস্যদানা ও মধু খায়। মার্চ থেকে জুন মাসে এদের প্রজনন মৌসুম। গাছের গর্তে বাসা তৈরি করে। বাংলাদেশের আবাসিক পাখি এটি। পাখিটির মূল আবাসস্থল বাংলাদেশের সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরহরিৎ বনাঞ্চলে। এছাড়া দেশের মধ্যভাগের মধুপুর বনাঞ্চলেও ও তার আশপাশের এলাকায় এদের দেখা যায়।
এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রমনা পার্ক, শেরেবাংলা নগর, মিরপুর এলাকায় এ প্রজাতির টিয়া দেখা যায়। তবে ঢাকা শহরের কোথাও প্রজননের হদিস এখনো মেলেনি। তবে চট্টগ্রামে টিয়া পাখিটির অনেক বড় ঝাঁক দেখা যায়। সিলেটে রয়েছে। মূলত পাহাড়ি পরিবেশ এই পাখিদের বেশি পছন্দ।
লালমাথা-টিয়ার (Plum-headed Parakeet) বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula cyanocephala। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিজ্ঞান কারখানার সামনের বট গাছে সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বটফল পাকলে একঝাঁক লালমাথা টিয়া বা হিরামন টিয়ার দেখা মেলে প্রতিবছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও মিরপুর, উত্তরায় এই পাখিটির দেখা মেলে। রূপকথার সেই হিরামন নামে পরিচিত পাখিটিই লাল মাথা টিয়া। তীব্র শব্দ করে ডাকে।
দেশের মধ্য ভাগ, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের বনভূমিতে এদের দেখা যায়। এটি বিরল আবাসিক পাখি। দিবাচর পাখিটি একা অথবা ছোট গ্রুপে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। সাধারণত ফল, শস্যদানা, ফুল, বীজ ও মধু খায়। গাছের কোটরে গর্ত করে বাসা তৈরি করে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এদের প্রজনন মৌসুম। তবে বর্তমানে আবাসস্থল সংকট, খাদ্যের অভাব আর অবৈধ চোরাচালানের কারণে পাখিটি প্রায় বিপন্ন।
শহরের টিয়াদের সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন স্কুল শিক্ষকরা। শৈশবেই যদি শিশুদের শেখানো হয় যে, টিয়ারা বনেই সুন্দর, খাঁচায় পোষ মানানো বিষয়টা শুধু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে নয় বরং অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাহলে তারা বড় হয়ে বাঁচাতে পারে আমাদের দেশের এই সুন্দর পাখিটি। টিয়াকে প্রাকৃতিক পরিবেশে সংরক্ষণের জন্য সর্বস্তরে সচেতনতা জরুরি। আমরা সচেতন না হলে হয়তো অচিরেই হারিয়ে ফেলব দেশের টিয়াগুলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।