করিম ইসহাক : ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা ’পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে, বাবুই হাসিয়া কহে–সন্দেহ কি তাই, কষ্ট পাই তবু থাকি নিজেরই বাসায়, পাকা হোক তবু ভাই পরের বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।’ কবি রজনীকান্ত সেনের কবিতাটি এখনো মানুষের মনে পড়ে। ‘প্রকৃতির প্রকৌশলী’ এই বাবুই পাখির বাসা শুধু নিদর্শনই নয়, মানুষের মনে উৎসাহ ও আনন্দও দিয়ে থাকে।
কিন্তু কালের বিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি। একসময় গ্রামগঞ্জের তাল, নারকেল ও খেজুরগাছে পাতা দিয়ে মোড়ানো নিপুণ কারুকার্যখচিত বাবুই পাখি বাসা বানিয়ে তাদের বাসস্থান তৈরি করত। কিন্তু তাল ও খেজুরগাছ গ্রামগঞ্জ থেকে বিলুপ্ত হওয়ায় বাবুই পাখি হারিয়ে যেতে বসেছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বারুগ্রাম ও বানিবহ আঞ্চলিক পাকা সড়কের পাশে তালগাছে খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তাল ও খেজুরগাছের কচি পাতা ও কাশবন দিয়ে নিপুণ কারুকার্যখচিত ঝুলন্ত পাতার সঙ্গে বাসা বেঁধেছে বাবুই পাখি থাকার জন্য।
কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত করে রাখে এলাকাটি। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসা বাবুই পাখি ও তার বাসা দেখার জন্য এবং কিচিরমিচির শব্দ শোনার জন্য এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী লোকজন একটু সময়ের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করেন।
স্থানীয় রহিম শেখ, সাত্তার মিয়া, খবির মন্ডল ও সুবোধ দাস জানান, একসময় এলাকায় অনেক তাল ও খেজুরগাছ ছিল। তখন প্রচুর পরিমাণ বাবুই পাখি এসে বাসা করেছে। কিন্তু সেসব তাল ও খেজুরগাছ বিপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থান সংকটের কারণে বাবুই পাখি বিলুপ্তপ্রায়। বাবুই পাখি ফসলের ক্ষেত থেকে পোকামাকড় ধরে খাওয়ার কারণে ফসলের অনেক উপকার হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে প্রায় ২০ বছর পর হারিয়ে যাওয়া বাবুই পাখি ও বাসা এলাকায় আবার দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। প্রকৃতির ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য বাবুই পাখিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজবাড়ি সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. নুরুজ্জামান জানান, বাবুই পাখিকে ‘শিল্পী পাখি’ বলা হয়। এরা সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। এরা কখনো কখনো দলবদ্ধভাবে আখক্ষেতে রাত যাপন করে। সবার সচেতনতার মাধ্যমে বাবুই পাখিকে রক্ষা করার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা ও তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক জোহরা মিলা জানান, সারা বিশ্বে ১১৭ প্রকার বাবুই পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে মাত্র তিন প্রজাতির বাবুই পাখির দেখা মেলে। যদিও এই তিন প্রজাতির বাবুই পাখির দেখা পাওয়াও এখন দুষ্কর। সাধারণত তালগাছ, নারকেল, খেজুর ইত্যাদি গাছে ঝুলিয়ে বাসা তৈরি করে ‘দেশি বাবুই’ (Baye Weaver)। বরিশাল অঞ্চলে দেশি বাবুই বেশি দেখা যায়। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচার শিকার ইত্যাদি কারণে সুন্দর এই পাখি দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতির সুন্দর এই পাখিটিকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বন বিভাগের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশি বাবুইকে প্রায়ই ফসল ক্ষেতে দেখা যায়। অনেকে ধারণা করেন পাখিটি ফসল খায়। কিছু ফসল হয়তো খায়ও; কিন্তু ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়ই তার প্রধান খাদ্য। তাই প্রকৃতপক্ষে কৃষকের ক্ষতির চেয়ে উপকার অনেক বেশি করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের এক নম্বর তফসিল অনুযায়ী এই পাখিটি সংরক্ষিত। তাই এটি শিকার, হত্যা বা এর কোনো ক্ষতি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।