মা-বাবা জমি বেচে ছেলেকে পড়িয়েছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে তিনি চাকরি নিয়েছিলেন দেশের নামকরা টেক্সটাইল কোম্পানিতে। সেই মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল ইসলাম পুলিশের চোখে এখন ‘মস্তবড়’ ছিনতাইকারী। রাজধানীর ছিনতাই চক্রের হোতা। ‘ঈগল বাহিনী’ নামে তার রয়েছে ছিনতাইয়ের দল।
রোজার আগে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় হওয়া বড় দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে নেমে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুলের অন্ধকার ভুবনের খোঁজ পায়। সম্প্রতি তিন সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ডিবি জানতে পারে, ২০১৯ সাল থেকে প্রায় প্রতিদিনই আশরাফুলের দলের সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পথচারী ও রিকশাযাত্রীদের কাছ থেকে টান দিয়ে ব্যাগ ছিনিয়ে নিচ্ছিল।
গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন- লেলিন শেখ, জিল্লুর রহমান খান ও সাইফুল ইসলাম শাওন। তাদের মধ্যে লেলিন আশরাফুলের সঙ্গেই টেক্সটাইল মিলের পিকআপ ভ্যানের চালক ছিলেন। জিল্লুর ও শাওন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইয়ের টাকা দিয়ে আশরাফুল তার শ্বশুরকে নিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা করতেন। সাইফুল ছিনতাইয়ের টাকা বিনিয়োগ করে রীতিমতো গ্রামের বাড়ি বরিশালে ঠিকাদারিও করতেন।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার থেকে যেভাবে ছিনতাই চক্রের হোতা: ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, আশরাফুল ৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। ২০১৯ সালে করোনা শুরুর পর চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেন আশরাফুল। এরপর নিজের কর্মস্থলের পিকআপ চালক লেলিনের প্ররোচনায় তিনি এই অপকর্মে নামেন। তারা দামি মোটরসাইকেলে ঘুরে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া বা টাকা উত্তোলন করে ফেরার সময়ে লোকজনকে টার্গেট করতেন। এরপর টান দিয়ে ব্যাগ নিয়ে নিতেন।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল দাবি করেছেন, চাকরির চেয়ে ছিনতাই করে আয় ভালোই হতো। এতে লোভে পড়ে যান তিনি। শুরুর দিকে ব্যাংককেন্দ্রিক টার্গেট থাকলেও ‘নেশা’ হয়ে যাওয়ায় ব্যাগ দেখলেই প্রায় প্রতিদিনই টান দিয়ে ছিনিয়ে নিতেন।
ডিবি ডিসি মশিউর বলেন, আশরাফুলের তিন বছরের এক ছেলে রয়েছে। স্ত্রী-সন্তান ও অন্যান্য স্বজন জানতেন, তিনি টেক্সটাইল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। আড়ালে হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর ছিনতাইকারী। আশরাফুলের বেশভুষা ভালো হওয়ায় একবার ব্যাগ টান দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে আড়ালে চলে যেতে পারলে তাকে আর কেউ সন্দেহ করত না।
করোনাকালে চাকরি হারিয়ে ছিনতাইয়ে নামেন বলে আশরাফুল দাবি করলেও ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত বেশি টাকার লোভে মেধাবী আশরাফুল এই অপকর্মে নেমেছিলেন। তদন্ত করে তারা দেখেছেন, আসলে করোনা কোনো বিষয় ছিল না, এতে তার চাকরিতেও প্রভাব পড়েনি। অনেক আগে থেকেই লেলিনের মাধ্যমে ছিনতাই চক্রের সঙ্গে আশরাফুলের যোগাযোগ। লেলিন মূলত টেক্সটাইল কোম্পানির পিকআপ ভ্যান চালানোর ফাঁকে ফাঁকে সাইফুল ও শাওনের সঙ্গে বহু বছর ধরেই ছিনতাই করে আসছিল।
ঈগলের মতো ছোঁ দেয় তারা: ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, আশরাফুলের চক্রের সদস্যরা সবাই দামি মোটরসাইকেল নিয়ে ছিনতাই করে আসছিল। দলের যে সদস্য মোটরসাইকেলের পেছনে বসত, তাকে তাদের ভাষায় ‘ঈগল’ আর মোটরসাইকেল চালককে ‘পাইলট’ বলা হতো। পেছনে বসা ব্যক্তি চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে রিকশা আরোহী বা পথচারীর হাতে থাকা ব্যাগটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। আশরাফুল সব সময়েই ঈগলের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
ডিবি ডিসি মশিউর রহমান বলেন, এরা মূলত সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে ছিনতাই করত। তবে শুক্র ও শনিবার তারা সাধারণত ‘কাজে’ যেত না। রোজার আগে মিরপুরের পল্লবীতে আলাদা দুটি ঘটনায় ১১ লাখ টাকা ও চার লাখ টাকা ছিনতাই হয়। ওই দুটি ঘটনার ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রযুক্তিগত তদন্তে সন্ধান মেলে এদের। এর মধ্যে ১১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ে সরাসরি ঈগলের দায়িত্বে ছিল আশরাফুল। চার লাখ টাকা ছিনতাইয়ে ছিল সাইফুল ও শাওন।
ডিবির গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের টিম লিডার এডিসি এস.এম রেজাউল হক বলেন, ওই চারজনকে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। ঈদের ছুটি থাকায় তারা কারাগারে রয়েছে। শিগগিরই তাদের কারাগার থেকে এনে ছিনতাই বিষয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চারজন দাবি করেছে, তিন বছরে তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক ছিনতাই করেছে। লেলিন, শাওন ও সাইফুলের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের কয়েকটি মামলাও রয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।