ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশ। জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। ৮৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৭৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি। এটি আমেরিকার একমাত্র এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্তুগিজভাষী দেশ।
ব্রাজিলের সংখ্যালঘু মুসলিম : ইসলাম ব্রাজিলের একটি সংখ্যালঘু ধর্ম। আফ্রিকান, লেবানীয় ও সিরিয়ান অভিবাসী দাসদের মাধ্যমে ব্রাজিলে ইসলামের আগমন হয়েছিল। পিউ রিসার্চ সেন্টারের পরিসংখ্যান মতে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে মুসলিমের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ০.১ ভাগ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২ লাখ ২৭ হাজার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তবে ব্রাজিলের মুসলিম সংগঠনগুলো দেশটির মুসলিমদের সংখ্যা চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ বলে জানিয়েছে।
মুসলিম দাসদের ইসলাম প্রচার : ব্রাজিলের জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, দেশটিতে মুসলিমদের ইতিহাস আফ্রিকান দাস আমদানির মাধ্যমে শুরু হয়। ১৫৩৮ সালে পর্তুগিজরা আফ্রিকান দাসদের আমদানি শুরু করে। চিনি তৈরির বৃক্ষ রোপণে অনেক দাসের দরকার ছিল। অন্যান্য দেশের মতো ব্রাজিলেও আফ্রিকান দাসের ব্যাপক চাহিদা ছিল। দাস ব্যবসার শতকরা ৩৭ ভাগ ব্রাজিলে আমদানি হতো। তাই এসময় ব্রাজিলে ৩০ লাখের বেশি আমদানি করা হয়েছিল। ঔপনিবেশিক আমলের আগে স্থানীয় টুপি জনগণ এই কাজ করত। তাঁরা ছিল ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ আদিবাসী। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ব্রাজিলে মুসলিম দাস আমদানি সবচেয়ে বেশি ছিল। এমনকি তারা বিশুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও আরবি ভাষায় কথা বলত।
ব্রাজিল আবিষ্কারে মুসলিম নাবিকদের অবদান : ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫০০ সালে বিখ্যাত পর্তুগিজ নাবিক পেদ্রো আলভারেজ কাবরাল (Pedro Álvares Cabral) ব্রাজিল আবিষ্কারকালে অনেক মুসলিম নাবিকও তাঁর সঙ্গে ছিল। ‘লায়ন অব সি’’ নামে জগদ্বিখ্যাত আরব নাবিক ও কার্টোগ্রাফার আহমদ বিন মাজিদ এবং মুসা বিন সাতি ছিলেন পেদ্রোর সঙ্গে। অপরদিকে মরিস্কো সম্প্রদায়ের লোক যারা স্পেনের সরকারি তদন্ত থেকে রক্ষা পেতে অনেক মুসলিম পরিচয় গোপন করে নিজেদের খ্রিস্টান বলে প্রকাশ করত, তাদের বিশাল একটি অংশ ব্রাজিলে পাড়ি জমায়।
উনবিংশ শতাব্দিতে ব্রাজিলের বিভিন্ন স্থানের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বিশেষত উপকূলীয় বাহিয়া এলাকায় হাউসার মুসলিম নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। কিন্তু পর্তুগিজরা তা কঠোরভাবে দমন করে এবং তাদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করে। ১৮৩৫ সালে আরেকবার বিদ্রোহ হয়। সেটাও ব্যর্থ হয়। এরপর অসংখ্য মুসলিমকে হত্যা করা হয়। অনেক মুসলিম খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসলামী শিক্ষার প্রসার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আরব ও মুসলিম দেশ থেকে অনেক মুসলিম ব্রাজিলে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমায়। বিশেষত ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবাননসহ বিভিন্ন আরব দেশের মুসলিমরা সেখানকার অভিবাসী হয়। ১৯২৬ সালে ব্রাজিলের সাও পাওলো এলাকায় সর্বপ্রথম একটি ইসলামী দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এর ধারাবিহকতায় ব্রাজিলে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৩ সাল থেকে এর তত্ত্বাবধানে ‘আন নাশরাহ’ এবং পরবর্তীতে ‘আজ জিকরা’ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৭ সালে মুসলিমদের জন্য সংস্থাটি প্রথম মসজিদ স্থাপন করে। এরপর ইসলামী শিক্ষা প্রসারে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি গেয়ারুলহোস (Guarulhos) এলাকায় মুসলিমদের জন্য করবস্থান তৈরি করা হয়।
ব্রাজিলের প্রথম ইসলামী সম্মেলন : গত শতাব্দির ৭০-এর দশকে ব্রাজিলে প্রথম ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তা শুধু ব্রাজিলে নয়, বরং দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম ইসলামী সম্মেলন ছিল। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় মিসরের ধর্ম ও ওয়াক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর আয়োজন করেছিল। এরপর থেকে ব্রাজিলের ইসলাম ও মুসলিম কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশিষ্ট আলেম ও পাকিস্তানের সাবেক বিচারক মুফতি তকি উসমানি বলেন, ব্রাজিলে ১০ জনকে ইসলামের দাওয়াত দিলে আটজনই দাওয়াত গ্রহণ করেন। তবে দাওয়াতের কাজ চালু থাকলেও বিশ্বের অন্য কিছু অমুসলিম দেশের মতো বিভিন্ন অসুবিধা সেখানে আছে।
বাড়ছে ইসলাম গ্রহণের হার : ব্রাজিলের ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রাজিলে আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার নও-মুসলিম বাস করছে। বর্তমানে দেশটিতে ১৫০টির বেশি মসজিদ বিদ্যমান। মূলত লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল ইসলামের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। গত তিন দশকে ব্রাজিলের সমাজব্যবস্থায় ইসলাম গ্রহণের হার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। কেবল মসজিদই নয়, বরং গ্রন্থাগার নির্মাণ, শিল্পকলা স্থাপন, স্কুল নির্মাণ ও সংবাদপত্র প্রকাশসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক কাজে অর্থায়নের মাধ্যমেও মুসলিমরা বড় ভূমিকা পালন করছে।
সূত্র : মারিফা ডটকম, মুসলিম পপুলেশন ডটকম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।