মরিয়ম চম্পা : রোমানা আমিন মহাখালীতে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। থাকতেন ছাত্রী হোস্টেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং থেকে সহপাঠী শাকিলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে কিছুদিন চলার পর তারা খরচ ভাগাভাগি করতে এবং সহজে বাসা ভাড়া নিতে সমঝোতায় বিয়ে করেন। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একটি বাসা ভাড়া নেন। ৪ বছর একসঙ্গে কাটান। বিষয়টি তাদের দুই পরিবারের কেউই জানতেন না। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পর সম্প্রতি সমঝোতা অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এ আসেন ডিভোর্সের জন্য।
রোমানা আমিন ও শাকিলের ঘটনাটি ব্যতিক্রম। তবে সমাজে তালাক বাড়ছে রীতিমতো জ্যামিতিক হারে। তারকা থেকে সাধারণ মানুষ।
উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত। তালাক এখন একেবারেই নিয়মিত ঘটনা। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে রোমানা আমিন কিংবা শাকিলের প্রকৃত নাম আমরা ব্যবহার করছি না। তবে তাদের বিবাহ এবং তালাক সংক্রান্ত নথি আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। তারা নিজেরাও তালাক ও বিয়ের কারণ বলেছেন। সমঝোতার বিয়ের কথা বলেছেন। রোমানা আমিনের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। বর্তমানে ঢাকাতেই বসবাস করছেন। অন্যদিকে, শাকিলের বাড়ি টঙ্গীর এরশাদ নগরে। তাদের বিয়েতে দেনমোহর ছিল এক লাখ টাকা। কেন তারা বিয়ে করেছিলেন, কেনই বা তালাক জানতে চাইলে বলেন, ব্যাচেলর শিক্ষার্থীদের বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন। তাছাড়া খরচও বেশি। এজন্য আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিয়ে করে এক বাসায় উঠি। শুনানির তারিখে তাদের পরিবারকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানাতে বলা হয়। কিন্তু তারা সংশ্লিষ্টদের হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেন যেন পরিবারকে বিয়ে-তালাকের কথা জানানো না হয়। এতে করে তাদের এবং পরিবারের সন্মানহানী হবে। পরবর্তীতে তাদের অনেক বোঝানো হলেও কোনোভাবেই দাম্পত্য জীবন নিয়মিত করতে রাজি হননি। তাদের একটিই কথা সামনে উজ্জ্বল ভবিষৎ। তাছাড়া তারা নিজেরাও বিয়ের সম্পর্কটা নিয়মিত করতে চান না। কারণ হিসেবে জানান, একটা সময় তাদের মধ্যে এক ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করলেও এখন সেই আকর্ষণবোধটা নেই। তারা নিজেদের মতো নতুন করে জীবনটা সাজাতে চান। এটাকে চলার পথে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে তারা উল্লেখ করেন।
প্রেম, বিয়ে, পরকীয়া, ডিভোর্স: ফার্মগেটে অবস্থিত একটি কলেজের শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। বড় ভাই লন্ডন থাকেন। বোনের সকল আবদার পূরণে মরিয়া বড় ভাই। কলেজের এক পলিটিক্যাল বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। বিষয়টি পরবর্তীতে বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। নারী শিক্ষার্থী একটি বেসরকারি হোস্টেলে বসবাস করতেন। সেখান থেকে স্বামীর ভাড়া বাসায় মাঝেমধ্যে গিয়ে থাকতেন। বিষয়টি পরিবারের সদস্যরা জানতেন না। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান নারী শিক্ষার্থী। একইভাবে তার স্বামীও আরেক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান। বন্ধুদের মাধ্যমে অবৈধ প্রেমের বিষয়টি উভয়য়েই জেনে যান এক বছরের মাথায় তারা সিদ্ধান্ত নেন উভয়ের সম্মতিতে তালাক দিবেন। তাদের অপরিণত বিয়ে এভাবেই তালাকে সমাপ্তি ঘটে।
৫৫ বছর সংসার করেও তালাক: ৫০ থেকে ৫৫ বছর সংসার করেও যেন পরস্পর পরস্পরের অজানাই রয়ে গেছেন। স্বামীর বয়স ৭৫ বছর। স্ত্রীর বয়স ৬৫ বছর। ছেলে-মেয়ে চিকিৎসক এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। হঠাৎ করে স্ত্রীর প্রতি সন্ধিহান হয়ে ওঠেন ৭৫ বছর বয়স্ক স্বামী। সিদ্ধান্ত নেন স্ত্রীকে তালাক দিবেন। পরে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর অঞ্চলে তালাকের আবেদন করেন। সূত্র জানায়, কেন তালাক দেবেন শুনানিতে জানতে চাইলে স্বামীর একটিই কথা তিনি ৬৫ বছর বয়সী স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হতে দেখেছেন। এবং তাদেরকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছেন। যেটা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তালাকের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় স্ত্রী বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। ৬৫ বছর বয়সে এসে তিনি কীভাবে পরকীয়ায় জড়াবেন। তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরেই একা বসবাস করতে চান। তিনি স্বাধীন জীবনযাপন করতে চান। বিভিন্ন সময় স্ত্রীর কাজের খুঁত ধরতে থাকেন। ছেলে-মেয়েরা বিষয়টি মীমাংসার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু সমাধান হয়নি। এ সময় ৬৫ বছর বয়স্কা স্ত্রী ৭৫ বছরের স্বামীর অন্যত্র পরকীয়া রয়েছে বলে জানান। পরে তাদের অনেক বোঝানো হলেও তালাক থেকে আপস মীমাংসা করাতে পারেনি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ৬০ বছর বয়সী আরেক নারী থাকেন বনানীতে। স্বামীর মৃত্যুর পর একাকীত্ব কাটাতে তার চেয়ে ১০ বছরের বড় ৭০ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধকে বিয়ে করেন। ভুক্তভোগী নারীর নামে একটি ফ্ল্যাট, ব্যাংকে নগদ টাকাসহ আরও অনেক সম্পদ ছিল। শেষ বয়সে এসে বিয়ে করে যার সঙ্গে বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছেন সেই স্বামী এক সময় নিজের নামে ফ্ল্যাট লিখিয়ে নেন। নগদ অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। পরে এই নারী সিটি করপোরেশনের স্থানীয় অফিসে হাজির হয়ে স্বামীকে তালাক দেন।
৭ মাসে তমিজি হকের দুই তালাক: ৭ মাসের ব্যবধানে ব্যবসায়ী আদম তমিজী হকের ২টি তালাক হয়! ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৪ মাস এবং ৩ মাসের ব্যবধানে দুই স্ত্রীকে তালাক দেন আদম তমিজী হক। সূত্র জানায়, প্রথমে ৪ মাসের মাথায় এক স্ত্রীকে তালাক দেন। পরে আবার ৩ মাসের মাথায় আরেক স্ত্রীকে তালাক দেন। দুটি তালাকই ছিল মিউচ্যুয়াল তালাকের শুনানিতে দুই স্ত্রী কিংবা আদম তমিজী কেউ উপস্থিত ছিলেন না। পরবর্তীতে তাদের অনুপস্থিতিতে দুটি তালাকই কার্যকর হয়।
তালাকের ১২ আবেদন বিশ্লেষণ: সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, তালাকের দিক থেকে পুরুষদের তুলনায় নারীরা এগিয়ে। রাজধানীর একটি নির্দিষ্ট কর অঞ্চলের ১২টি তালাকের আবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তালাকের আবেদনে পরকীয়ায় আসক্ত, বনিবনা না হওয়া, স্বামী মাদকাসক্ত এসব অভিযোগই বেশি। রাজধানীর ডিওএইচএস বারিধারার বাসিন্দা স্বামী তার তালাকের নোটিশে উল্লেখ করেন ২০১০ সালে তাদের বিয়ে হয়। বনিবনা ও মনের মিল না হওয়া, স্বামীর সঙ্গে ভালো আচরণ না করা, টাকা পয়সা ও জায়গা জমি আত্মসাৎ এবং প্রতারণাসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তালাকের আবেদন করেন। স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকের আরেক নোটিশে দেখা গেছে, মগবাজার দিলু রোডের বাসিন্দা নারীর সঙ্গে ২০২৩ সালে আলী নামে এক ব্যক্তির বিয়ে হয়। তালাকের কারণ হিসেবে বলা হয়, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, মতের অমিল, স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এবং নেশাগ্রস্ত। চলতি বছরের জানুয়ারিতে স্ত্রী এই তালাকের আবেদন করেন। তালাকের হলফনামায় বলা হয় ১০ লাখ টাকা কাবিনে গাইবান্ধার এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়। তার স্বামী চরিত্রহীন পুরুষ। পর নারীর সঙ্গে অবাধে মেলামেশা এবং বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন স্থানে যান। সংসারের প্রতি তিনি একদম উদাসীন। স্বামীর এই আচরণে তিনি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। সকল কিছু বিবেচনা করে তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করা হলো। ভবিষ্যতে স্ত্রী স্বামীকে কিংবা স্বামী স্ত্রীকে স্ত্রী দাবি করতে পারবে না। সুস্থ মস্তিষ্কে, সজ্ঞানে অত্র হলফনামা প্রদান করা হলো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের জুন মাসে প্রকাশ করা জরিপের ফল অনুযায়ী, তালাকের হার বেড়েছে ১.৪ শতাংশ। যা আগে ছিল ০.৭ শতাংশ। এ সময় ঢাকায় গড়ে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে একটি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট তালাক হয়েছে ৬৫০টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাকের ঘটনা ৪৫০টি আর স্বামীর মাধ্যমে ২০০টি। অন্যদিকে, পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত শেষ না হলেও খসড়া হিসাবে গত বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৭০০টি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এখানেও তালাক প্রদানে এগিয়ে নারীরা। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এখানে মোট তালাকের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৯৯৯টি। ঢাকা দক্ষিণের মতো উত্তর সিটি করপোরেশনেও পুরুষের তুলনায় নারীদের পক্ষ থেকে তালাক দেয়ার সংখ্যাটা বেশি।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ-সচিব) অঞ্চল-২ এর মো. জিয়াউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ধৈর্য্যরে অভাবে সমাজে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ উভয়ের স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রয়েছে। তবে সেটা যখন চরম আকার ধারণ করবে তখন ডিভোর্সের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেছেন, এখন বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগ। এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তির শীর্ষে অবস্থান করছি আমরা। এ ছাড়া পাশ্চাত্য একটি প্রভাব বা সাংস্কৃতিক বিষয়তো রয়েছেই। এ ছাড়া মেয়েরা এখন সাবলম্বী হয়েছে। এতে করে একটি নো কেয়ার ভাব চলে এসেছে। সে কারণে এখন ব্যক্তি স্বাধীনতা মানুষের মধ্যে জেগেছে বলে এটা হচ্ছে। এর সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির একটি প্রভাব আছে। এসব নানান কারণে ডিভোর্স বাড়ছে। আমাদের সমাজে নিম্নবিত্তদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। উচ্চবিত্তদের মধ্যে হলেও সেটা কম প্রকাশ পায়। বয়স্কদের মধ্যে ডিভোর্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটা সময় শেষে মানুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণবোধটা কমে যায়। সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা দেখা দেয়। এটি প্রকৃতিগত এবং মজ্জাগত। আইন করে এটা কমানো যাবে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।