সবুজ মাঠে শিশুরা দৌড়াচ্ছে, তরুণরা ক্রিকেট খেলছে, বয়স্করা হাঁটছেন সকালের হাওয়ায় – এ দৃশ্য শুধু শারীরিক সক্রিয়তারই নয়, জীবনীশক্তিরও প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই দৌড়ানো, হাঁটা, ব্যায়ামের পিছনে কি শুধুই দেহের সুস্থতা নিহিত? নাকি এর গভীরে আছে এক ঐশী দর্শন, এক মহান দায়িত্ববোধ? যখন জীবনযাত্রা যান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন, যখন স্ক্রিনের আলো চোখে-মনে আধিপত্য বিস্তার করে, ঠিক তখনই ফিরে তাকানো জরুরি আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যের দিকে। ইসলাম শুধু নামাজ-রোজা-হজ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ধর্ম নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে শরীরচর্চার ইসলামিক নির্দেশনা:জানুন কেন জরুরি – এই উপলব্ধিই পারে আমাদের দেহ ও আত্মার সামগ্রিক সুস্থতার পথ দেখাতে। রাসূল (সা.)-এর বলিষ্ঠ দেহ, সাহাবায়ে কেরামের অদম্য শক্তি শুধু ইতিহাসের পাতা নয়, তা বর্তমান মুসলিম উম্মাহর জন্য এক জ্বলন্ত আদর্শ।
Table of Contents
শরীরচর্চার ইসলামিক নির্দেশনা: ঈমান ও শারীরিক সুস্থতার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন
ইসলামে শরীরচর্চাকে কখনই নিছক শখ বা বিনোদন হিসেবে দেখা হয়নি। এটি সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছে ঈমানের সাথে, আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের সাথে এবং দুনিয়ার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হওয়ার সাথে। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, “বিশ্বাসী মুমিনের জন্য শক্তিশালী দেহ দুর্বল দেহের মুমিনের চেয়ে উত্তম ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।” (সহীহ মুসলিম)। এই হাদীসটি কেবল শারীরিক শক্তির প্রশংসা করে না; এটি ঈমানদার ব্যক্তির জন্য সুস্থ ও শক্তিশালী দেহবৃত্তিকে ঈমানেরই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কেননা, একটি সুস্থ দেহই পারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সঠিকভাবে রুকু-সিজদা আদায় করতে, রোজা রাখার কষ্ট সহ্য করতে, হজ্বের কঠিন মুহূর্তগুলো অতিক্রম করতে এবং পরিবার-সমাজের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেহকে একটি ‘আমানত’ হিসেবে দিয়েছেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আর তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।” (সূরা বাকারা, আয়াত ২৩১)। দৈনন্দিন জীবনে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অলসতা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব – এগুলোই তো দেহের প্রতি জুলুমের শামিল। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরীরচর্চা তাই শুধু সুস্থ থাকার উপায় নয়; এটি দেহের হক আদায়ের একটি মৌলিক কর্তব্য, আমানতের খেয়ানত না করার একটি বাস্তব প্রয়াস। রাসূল (সা.) নিজে যেমন কুস্তি লড়েছেন, দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজীর প্রতি উৎসাহিত করেছেন, তেমনি তিনি সাহাবীদের নিয়মিত দৌড়াদৌড়ি, সাঁতার কাটা ও অন্যান্য শারীরিক কসরতের অনুশীলন করতে বলেছেন। হযরত আলী (রা.)-এর অগাধ জ্ঞান যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনি তাঁর অপরাজেয় শারীরিক শক্তিও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। এটি প্রমাণ করে ইসলাম জ্ঞানচর্চা ও শরীরচর্চার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব দেখে না; বরং এ দুটিকে পরিপূর্ণ মুমিন জীবনের দুইটি অবিচ্ছেদ্য স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নির্দেশনার তাৎপর্য আরও গভীর: শহুরে জীবনের ভিড়, দূষণ, ফাস্ট ফুডের সংস্কৃতি, ডেস্ক জবের প্রভাব – এসব মিলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ওবেসিটির মতো রোগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। ইসলামিক নির্দেশনা মেনে নিয়মিত শরীরচর্চা শুধু ব্যক্তিকেই রক্ষা করবে না; এটি জাতীয় স্বাস্থ্য খাতের বোঝাও কমাবে, কর্মক্ষমতা বাড়াবে, যা দেশের উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব শুধু আখেরাতের পাথেয় জমা করা নয়; দুনিয়াতেও সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে, আল্লাহর খলিফা হিসেবে সুস্থ, সক্ষম ও গতিশীল জীবনযাপন করা।
বর্তমান যুগে শরীরচর্চার ইসলামিক অনুশীলন: চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
আধুনিক জীবনযাত্রা, বিশেষ করে বাংলাদেশের নাগরিক প্রেক্ষাপটে, ইসলামিক নীতিমালা মেনে শরীরচর্চাকে নিত্যদিনের অংশ করে তোলা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে। অফিসের কাজের চাপ, যানজটে কাটানো দীর্ঘ সময়, ঘরের দায়িত্ব – এসবের মাঝে জিমে যাওয়া বা খেলাধুলার সময় বের করা দুষ্কর। তদুপরি, অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে: “মহিলাদের জন্য শরীরচর্চার ইসলামিক পদ্ধতি কী?”, “কোন ধরনের ব্যায়াম ইসলামসম্মত?”, “মিক্সড জিম বা প্রকাশ্য স্থানে ব্যায়ামের বিধান কী?”
ইসলামের সৌন্দর্য হলো এর নমনীয়তা ও বাস্তবতা বোধ। শরীরচর্চার উদ্দেশ্য পূরণ হলে ঘরেই তার ব্যবস্থা করা যায়। ইসলাম মহিলাদের জন্য তাদের গৃহের অভ্যন্তরে বা নারী-কেন্দ্রিক নিরাপদ ও পর্দার ব্যবস্থাযুক্ত স্থানে (যেমন বাসায়, মহিলা-শুধু জিম বা পার্কের নির্দিষ্ট নারী কর্নারে) ব্যায়াম, ইয়োগা, অ্যারোবিক্স, ওজন তোলা, ট্রেডমিলে দৌড়ানো – সবই উৎসাহিত করে, যদি তা শালীন পোশাকে ও শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যে থেকে করা হয়। রাসূল (সা.) তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.)-এর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতার কথা সুপ্রসিদ্ধ (সুনানে আবু দাউদ)। এটি প্রমাণ করে নারীদের জন্যও শরীরচর্চা গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘরের অভ্যন্তরেও তা সম্ভব।
পুরুষদের জন্য মসজিদের পরেই স্থানীয় মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা, পার্কে হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, বাসায় পুশ-আপ, সিট-আপ, স্কিপিং বা স্ট্রেচিং করা – এসবই উত্তম শরীরচর্চা হতে পারে। মূল নীতি হলো:
- পর্দা ও শালীনতা রক্ষা: মহিলাদের ক্ষেত্রে পূর্ণ পর্দা (লুজ, অস্বচ্ছ নয় এমন পোশাক), পুরুষদের ক্ষেত্রে নাভি থেকে হাঁটু ঢাকা। প্রকাশ্যে এমন কোন ব্যায়াম না করা যা শালীনতাবিরোধী।
- সময় ব্যবস্থাপনা: ফজরের নামাজের পর বা মাগরিবের পরের সময়, সাপ্তাহিক ছুটি – সময় বের করা সম্ভব। দিনে মাত্র ৩০ মিনিট নিয়মিত হাঁটলেও বিরাট উপকার পাওয়া যায়।
- উদ্দেশ্য পরিষ্কার: দেহকে আল্লাহর ইবাদত ও দায়িত্ব পালনে সক্ষম রাখা, অহংকার বা শুধু দৈহিক প্রদর্শনী নয়।
- ধর্মীয় দায়িত্বে ব্যাঘাত না ঘটানো: শরীরচর্চার নামে ফরজ নামাজ, রোজা, পরিবারের অধিকার আদায়ে অবহেলা করা যাবে না।
বাংলাদেশে এখন ইসলামিক নীতিমালা মেনে চলা অনেক জিম ও ফিটনেস সেন্টার গড়ে উঠেছে, যেখানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা এবং শরীয়াহসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। অনলাইনেও রয়েছে অসংখ্য রিসোর্স যেখানে ঘরে বসে পর্দারীতির সাথে ব্যায়াম শেখা যায়।
শরীরচর্চার ইসলামিক পদ্ধতি: কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা
ইসলাম শুধু শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তাই বলে না, এর কিছু আদর্শ পদ্ধতি ও নৈতিক দিকনির্দেশনাও প্রদান করে। আসুন দেখি কিভাবে ইসলামিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শরীরচর্চাকে আমাদের জীবনের অঙ্গ করে তুলতে পারি:
- নিয়তের বিশুদ্ধতা: প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। শরীরচর্চার শুরুতেই নিয়ত করুন: “হে আল্লাহ, আমি আমার শরীরকে আপনার দেওয়া আমানত হিসেবে সুস্থ, সবল ও আপনার ইবাদত ও সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত রাখার জন্য এই প্রচেষ্টা করছি।” এতে একটি সাধারণ কাজও ইবাদতে পরিণত হবে।
- সুন্নাহতে উৎসাহিত ক্রীড়া ও অনুশীলন:
- দৌড়ানো: রাসূল (সা.) নিজে দৌড়াতেন এবং সাহাবীদের দৌড় প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহ দিতেন। এটি কার্ডিওভাস্কুলার স্বাস্থ্যের জন্য সর্বোত্তম।
- সাঁতার: রাসূল (সা.) বলেছেন, “সব সন্তানের অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া, সাঁতার কাটা ও তীর নিক্ষেপ শেখানো।” (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)। এটি পূর্ণাঙ্গ ব্যায়াম।
- ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজী: রাসূল (সা.) এগুলোকে প্রশংসনীয় ক্রীড়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন (সহীহ বুখারী, মুসলিম)। আধুনিক যুগে এগুলোর বিকল্প হতে পারে সাইক্লিং, আর্চারি ক্লাবে যোগদান বা এমন খেলাধুলা যা দৃষ্টিশক্তি, সমন্বয় ও শক্তি বাড়ায়।
- কুস্তি: রাসূল (সা.) রুকানা (রা.)-এর সাথে কুস্তি লড়েছিলেন। এটি শারীরিক শক্তি ও আত্মরক্ষার কৌশল শেখায়।
- প্রকৃতির সংস্পর্শ: বাগান করা, পাহাড়ে হাঁটা, নদীর ধারে ব্যায়াম – প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে শরীরচর্চা ইসলামের পরিবেশ ও সৃষ্টির প্রতি সম্মানবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী।
- সামষ্টিক ক্রীড়া ও ভ্রাতৃত্ববোধ: দলগত খেলাধুলা (যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল – শরীয়াহর সীমার মধ্যে) ভ্রাতৃত্ববোধ, দলগত কাজ, সহনশীলতা ও শৃঙ্খলা শেখায় – যা মুসলিম সমাজের জন্য অপরিহার্য গুণ।
- খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব: শরীরচর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হলো হালাল ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস। রাসূল (সা.) আহারে সংযম, ধীরে খাওয়া, প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবার (খেজুর, জলপাই, মধু, দুধ, ফলমূল) গ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন। অতিভোজন বা হারাম খাদ্য শরীরচর্চার সুফল নষ্ট করে দেয়।
- বিপদের সময় আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ: বর্তমান সমাজে নিরাপত্তাহীনতা বিবেচনায় ইসলামসম্মত উপায়ে (কারাতে, তাইকোন্ডো, জুডো ইত্যাদি) আত্মরক্ষার মৌলিক প্রশিক্ষণ নেওয়াও শরীরচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে, যার উদ্দেশ্য হবে আত্মরক্ষা ও দুর্বলকে রক্ষা করা, আক্রমণ বা উসকানি দেওয়া নয়।
বাংলাদেশের মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরীরচর্চার গুরুত্ব প্রচারে মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজে বাধ্যতামূলক শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রম, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সাঁতার, তীরন্দাজী বা মার্শাল আর্টের মতো সুন্নাহ ভিত্তিক ক্রীড়ার বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে নতুন প্রজন্ম ইসলাম ও আধুনিকতার সমন্বয়ে বেড়ে উঠবে। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন এরকম উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
শরীরচর্চার অভাবে ইসলামিক জীবনে প্রভাব: একটি সতর্কবার্তা
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে শরীরচর্চাকে উপেক্ষা করার অর্থ শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়; এর গভীরতর ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে:
- ইবাদতে অক্ষমতা: স্থূলতা, শ্বাসকষ্ট, জয়েন্টের ব্যথা নামাজে দাঁড়ানো, রুকু-সিজদা করা, রোজা রাখা বা হজ্বের কষ্টসাধ্য রীতিগুলো পালনকে কঠিন বা কখনো অসম্ভব করে তোলে। এটি সরাসরি ফরজ ইবাদত পালনে বাধা সৃষ্টি করে।
- পরিবারের দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত: একজন পিতা/মাতা হিসেবে সন্তানদের লালন-পালন, শিক্ষাদান, তাদের সাথে সময় কাটানো, পরিবারের জন্য রোজগার করা – এসবের জন্য শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা প্রয়োজন। দুর্বল স্বাস্থ্য এসব দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
- মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি: অলসতা, শরীরচর্চার অভাব ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, মনোযোগের অভাব এবং রাগ নিয়ন্ত্রণহীনতার মতো মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। ইসলাম সুস্থ মনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, কেননা ঈমান ও ইবাদতের জন্য প্রসন্ন চিত্ত অপরিহার্য।
- আল্লাহর নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা: সুস্থ দেহ আল্লাহর এক মহান নিয়ামত। এই নিয়ামতকে অবহেলা করে নষ্ট করা অকৃতজ্ঞতার শামিল। রাসূল (সা.) বলেছেন, “দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত: সুস্থতা ও অবসর সময়।” (সহীহ বুখারী)।
- সমাজের বোঝা হয়ে ওঠা: অসুস্থ ব্যক্তি শুধু নিজেই কষ্টভোগ করে না, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরও চাপ সৃষ্টি করে। একজন মুসলিমের দায়িত্ব নিজেকে সক্ষম করে গড়ে তোলা যাতে সে সমাজের জন্য সম্পদ হয়, বোঝা নয়।
আধুনিক গবেষণাও প্রমাণ করে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিছু ক্যান্সার এবং হাড়ক্ষয় রোগের ঝুঁকি কমায়, যা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ।
শরীরচর্চাকে ইসলামিক রুটিনের অংশ করুন: সহজ টিপস
শরীরচর্চাকে ইসলামিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলতে কিছু ব্যবহারিক ও সহজলভ্য উপায়:
- ফজরের পর হাঁটা: ফজরের নামাজের পরের সময়টি শান্ত ও সুন্দর। এই সময়ে ২০-৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা (ব্রিস্ক ওয়াকিং) শরীর ও মন দুইটির জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ। এটি দিন শুরু করার উত্তম পদ্ধতি।
- মসজিদে হেঁটে যাওয়া: সম্ভব হলে নামাজের জন্য মসজিদে হেঁটে যাওয়া-আসা করুন। এটি অতিরিক্ত কদম ও ইবাদতের সওয়াব দুইই অর্জনের সুযোগ।
- ঘরের কাজকে ব্যায়াম হিসেবে ভাবা: সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, বাসন মাজা, ঘর মুছা, ঝাড়ু দেওয়া – এসব কাজও শারীরিক শ্রমের অন্তর্ভুক্ত। নিয়ত করুন, এগুলোও দেহ সচল রাখার মাধ্যম।
- সাপ্তাহিক পরিবারিক ক্রীড়া: সপ্তাহে একদিন পার্কে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলা, ফুটবল খেলা বা দল বেঁধে হাঁটাহাঁটি করুন। এটি পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করারও উপায়।
- টিভি/মোবাইলের সময় কমিয়ে ব্যায়াম: যে সময়টা আমরা প্যাসিভলি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাটাই, তার কিছু অংশ সক্রিয় শরীরচর্চায় ব্যয় করুন।
- সুন্নাহ ভিত্তিক অনুশীলনের চেষ্টা: সপ্তাহে একদিন সাঁতার কাটার চেষ্টা করুন, বা বাড়িতে বসে তীরন্দাজীর প্রাথমিক অনুশীলন (প্রোপার গাইডেন্সে), বা বাচ্চাদের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করুন।
- ইবাদতের মধ্যেই লুকানো ব্যায়াম: নামাজের রুকু-সিজদা, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ বা নফল নামাজে কিছুটা দীর্ঘ সময় ধরে রুকু-সিজদা করলে তা উল্লেখযোগ্য শারীরিক উপকার দেয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: ধারাবাহিকতা। প্রতিদিন সামান্য পরিশ্রমও দীর্ঘমেয়াদে বিশাল পার্থক্য গড়ে দেবে। শুরুটা ছোট করেই করুন।
জেনে রাখুন (FAQs)
১। ইসলামে শরীরচর্চা কি ফরজ বা ওয়াজিব?
- শরীরচর্চা সরাসরি ফরজ বা ওয়াজিব হিসেবে উল্লেখিত না হলেও, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত ও মুস্তাহাব (প্রশংসিত) আমল। দেহকে সুস্থ ও সক্ষম রাখা ফরজ ইবাদত (নামাজ, রোজা, হজ্ব) পালন, পরিবারের দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদন এবং আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের জন্য অপরিহার্য। দেহের হক আদায়ের অংশ হিসেবেই ইসলাম এটিকে অত্যন্ত উৎসাহিত করে।
২। মহিলারা ইসলামিক পদ্ধতিতে শরীরচর্চা কিভাবে করতে পারেন?
- ইসলাম মহিলাদের শরীরচর্চাকে পুরোপুরি সমর্থন করে, তবে পর্দা ও শালীনতার শর্ত সাপেক্ষে। উত্তম পদ্ধতি হলো নিজ বাসায় ব্যায়াম করা। বর্তমানে ইনডোর সাইকেল (Exercise Bike), ট্রেডমিল, ইয়োগা ম্যাট, হালকা ডাম্বেল, রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড ব্যবহার করে বা অনলাইনে নারী প্রশিক্ষকদের ভিডিও অনুসরণ করে ঘরেই পূর্ণাঙ্গ ব্যায়াম সম্ভব। মহিলা-শুধু জিম বা ফিটনেস সেন্টারও ভালো বিকল্প, যেখানে পূর্ণ পর্দার ব্যবস্থা থাকে। পার্কে হাঁটতে হলে ভিড় কম থাকে এমন সময় বেছে নেওয়া এবং লুঙ্গি-ব্লাউজ/বুর্কা বা লুজ ফিট শালীন ট্র্যাকস্যুটের মতো পোশাক পরা উচিত। মূল লক্ষ্য স্বাস্থ্য, প্রদর্শনী নয়।
৩। শরীরচর্চার জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় ইসলামে উল্লেখ আছে কি?
- ইসলাম শরীরচর্চার জন্য কোন কঠোর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়নি। তবে ফরজ ইবাদত (নামাজের সময়) এবং পরিবারের অধিকার (স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-মাতাপিতা) যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফজরের পর, মাগরিবের পর, বা দিনের যে কোন অবসর সময় ব্যবহার করা যেতে পারে। রোজার দিনে ইফতারের আগের কষ্টকর সময়ে কঠোর ব্যায়াম না করে হালকা স্ট্রেচিং বা হাঁটাই ভালো। রাত জেগে ব্যায়াম করে ফজরের নামাজে ঘাটতি করা অনুচিত।
৪। জিমে যাওয়া বা ফিটনেস সেন্টারে অনুশীলন ইসলামসম্মত কি?
- হ্যাঁ, জিমে যাওয়া ইসলামসম্মত, তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে:
- পোশাক: পুরুষদের নাভি থেকে হাঁটু ঢাকা, টাইট বা শরীর প্রদর্শনকারী পোশাক পরিহার করা। মহিলাদের জন্য তো পর্দার শর্তই প্রযোজ্য (অতএব, মিক্সড জিম সাধারণত অনুপযুক্ত)।
- পরিবেশ: অশ্লীলতা, মিউজিক বা এমন কোন কাজকর্ম না হওয়া যা ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী।
- নিয়ত: শুধু দৈহিক প্রদর্শনী, অহংকার বা অন্যদের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব না রাখা।
- প্রাধান্য: ফরজ ইবাদতে যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে।
- মহিলাদের জন্য: নারী-শুধু জিম বা সেন্টার নির্বাচন করা উচিত যেখানে পূর্ণ গোপনীয়তা ও পর্দার ব্যবস্থা আছে।
৫। ইসলামে কোন ধরনের খেলাধুলা বা ব্যায়ামকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?
- রাসূলুল্লাহ (সা.) সরাসরি যেসব ক্রীড়া ও অনুশীলনের উল্লেখ করেছেন বা অনুশীলন করেছেন, সেগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- দৌড়ানো/Foot Racing
- সাঁতার/Swimming
- ঘোড়সওয়ারী/Horse Riding (আধুনিক সমতুল্য: সাইক্লিং/Cycling)
- তীরন্দাজী/Archery (যা দৃষ্টিশক্তি, ধৈর্য ও সমন্বয়ের প্রশিক্ষণ দেয়)
- কুস্তি/Wrestling (আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের ভিত্তি)
এই ক্রীড়াগুলো শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জীবনদক্ষতা ও প্রস্তুতিও শেখায়।
৬। শরীরচর্চা করতে গিয়ে নামাজের ওয়াক্ত চলে গেলে বা ক্লান্তিতে ইবাদতে অনীহা আসলে কী করণীয়?
- শরীরচর্চার উদ্দেশ্য তো ইবাদতের জন্যই দেহকে সক্ষম করা। তাই শরীরচর্চাই যদি ইবাদতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার সময় ও ধরন পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। ফরজ নামাজের ওয়াক্ত মিস করা কঠিন গুনাহ। তাই ব্যায়ামের সময় এমনভাবে সেট করুন যেন তা নামাজের ওয়াক্তের সাথে সঙ্ঘাত না করে। খুব ক্লান্তিকর ব্যায়াম এমন সময় না করা উচিত যার প্রভাব পড়ে পরের নামাজে (যেমন আসরের ঠিক আগে অতিরিক্ত কঠিন ওয়ার্কআউট যা জোহর বা আসরের নামাজে দাঁড়াতে কষ্টকর করে তোলে)। হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম সাধারণত ইবাদতে সহায়ক হয়। ব্যায়ামের পর দ্রুত গোসল করে নামাজ আদায় করলে সতেজতা ফিরে আসে।
ইসলামের দৃষ্টিতে এই দেহ শুধু মাংস-হাড়ের পিণ্ড নয়; এটি আল্লাহর দেওয়া এক মহান আমানত, এক নেয়ামত, যার মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অর্জন করি। শরীরচর্চার ইসলামিক নির্দেশনা মেনে চলা তাই শুধু ফিটনেস ট্রেন্ড নয়; এটি ঈমানের দাবি, আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের এক বাস্তব রূপ, এবং পরিপূর্ণ মুসলিম জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শরীরচর্চার ইসলামিক নির্দেশনা:জানুন কেন জরুরি – এই উপলব্ধি আমাদের দেহকে ইবাদত ও দায়িত্ব পালনের সর্বোত্তম যন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। আপনার এই দেহের হক আদায় করুন, নিয়মিত হালকা হাঁটা, সাঁতার বা ঘরোয়া ব্যায়াম শুরু করুন, পুষ্টিকর হালাল খাবার গ্রহণ করুন এবং আল্লাহর এই অমূল্য নিয়ামতের যথাযথ কদর ও যত্ন করুন। আপনার সুস্থতা আপনার পরিবার, সমাজ ও উম্মাহর শক্তি। আজই একটি পদক্ষেপ নিন – আপনার শরীরের যত্ন নিন, ঈমানী দায়িত্ব পালন করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।