জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন ত্রিপুরা নারীর মৃত্যুর সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশানে এই ঘটনায় চালকের আসনে ছিলেন ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। খবর বিবিসি বাংলার।
ঘটনার পর ঐ কিশোরের পরিবার নিহতের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশে অর্থ দিয়ে অপরাধের দায় এড়ানোর প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এই প্রবণতার নৈতিকতার দিকটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছে।
আইনজীবীরা বলছেন, খুব আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনা না হলে ক্ষতিপূরণ ও বিচার পাওয়াও কঠিন।
পপি ত্রিপুরার মৃত্যু :
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গুলশান আবাসিক এলাকার ভেতরে রিক্সায় করে একটি চৌরাস্তার মোড় পার হচ্ছিলেন বিউটি পার্লারের কর্মী পপি ত্রিপুরা।
বাঁদিক দিয়ে একসাথে আসছিলো তিনটি গাড়ি। যার একটি খুব দ্রুত বেগে তার রিক্সাকে ধাক্কা দেয়। রিকসা থেকে ছিটকে পড়ে যান পপি। থামার বদলে আরও দ্রুত বেগে গাড়িটি চলে যায় তার শরীরের উপর দিয়ে।
এই দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে তার প্রাণ আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা তার পরিবারের স্বপ্ন- বলছিলেন তার ভাই জয়ন্ত ত্রিপুরা।
“ওনার স্বপ্ন ছিল পার্লারের ব্যবসা করবেন। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি যেহেতু ছোটভাই। তার স্বপ্ন ছিল আমাকে লেখাপড়া করাবেন। সে খুব কর্মঠ ছিল। নিজে পার্লারে কাজ করতেন। ওনার ইচ্ছা ছিল কাজটি শিখে যদি নিজে একটা পার্লার দিতে পারেন।”
জয়ন্ত ত্রিপুরা বলছেন, বান্দরবানের থানচিতে তাদের গ্রামের বাড়িতে যেদিন তার দিদির মরদেহ সৎকার করা হয়েছে, সেদিনই গাড়িটির চালক, ১৭ বছর বয়সী সেই কিশোরের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিল।
“আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার বোনের সৎকার হয়েছিলো সকাল এগারোটার দিকে। আর ওনাদের প্রতিনিধি আসেন সন্ধ্যার দিকে। এটা সত্যি যে তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। আমি সেসময় সেটা নিতে অস্বীকার করি। একটা জীবনের মূল্য কোন ক্ষতিপূরণ দিয়ে হয় না। আমার বোনকে তো আর ফিরে পাবো না,” বলেছেন জয়ন্ত ত্রিপুরা।
জীবনের দাম ৫০ হাজার টাকা
এই ঘটনায় জয়ন্ত ত্রিপুরার করা মামলায় চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তার বয়স ১৮র নিচে হওয়ার কারণে তার বিচার কিশোর আদালতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান।
তবে সেদিন ১৮ই অক্টোবর যেভাবে দুর্ঘটনার পর গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেছেন চালক, আর একটি জীবনের মূল্য হিসেবে ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে, সেটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসার পর।
যদিও ওই কিশোরের বাবা আনোয়ার ঊন নবী জানিয়েছেন তারা শুরুতে ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে না পেরে প্রাথমিকভাবে ওই অর্থ পাঠিয়েছিলেন।
তিনি বলছেন, “এটা হিট অফ দ্যা মোমেন্ট। ওই সময় কিছু অ্যাবনরমাল ডিসিশন হয়েছিলো। তখন আমাদের অনেক দু:শ্চিন্তা ছিল। এটা অনিচ্ছাকৃত একটা ঘটনা। আমরা খুবই অনুতপ্ত। আমরা এখন কীভাবে ওদের সংগে পারিবারিকভাবে হোক, সন্তুষ্ট করে যেভাবে এটা মিউচুয়াল করে, ক্ষতিপূরণ দেয়া যায়, আমরা এরকম চিন্তাভাবনা করছি।”
অর্থ দিয়ে অপরাধের দায় এড়ানোর চেষ্টা
বাংলাদেশে খুব আলোচিত এবং গণমাধ্যমের মনোযোগ পাওয়া কিছু সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় দ্রুত ক্ষতিপূরণের আদেশ হয়েছে। রাজধানীর কুর্মিটোলায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর যখন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হয়, তখন ওই শিক্ষার্থীদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিশাল অংকের অর্থ সঞ্চয়পত্র আকারে দেয়া হয়েছে।
রাজীব হোসেন নামে এক কলেজ ছাত্রের বাসের চাপায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাতের ঝুলে থাকা ছবি গণমাধ্যমে আসার পর খুব দ্রুতই ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়েছিলো উচ্চ আদালত।
ক্ষতিপূরণ মামলা নিয়ে কাজ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা। তিনি বলছেন, আলোচিত ঘটনা না হলে দুর্ঘটনার শিকার সাধারণ মানুষের পক্ষে বিচার ও ক্ষতিপূরণ আদায় খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
তিনি মনে করছেন, অপরাধের পর অর্থ দিয়ে একটা সমাধান করার বিষয়টির নৈতিকতার প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
“আমরা ভিআইপি নিয়ে আছি। আমরা টাকা দিয়ে সবকিছু গুনি। যার অনেক টাকা আছে সে ভিআইপি। আর যার টাকা নেই সে কোন পর্যায়ে পড়ে না। সবকিছু টাকা দিয়ে সেটল হচ্ছে। রেপ কেস, মার্ডার কেস, অ্যাকসিডেন্ট কেস সেটল হচ্ছে। এটা দুর্নীতির আর একটা রূপ। এখানে বিচারটাও ব্যাহত হচ্ছে,” বলছেন আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা ও আপোষ
এসব কারণে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, গৃহকর্মী নির্যাতন সহ অন্য অনেক অপরাধে আদালতের বাইরে আপোষ করার প্রবণতা রয়েছে বলে মনে করেন আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
অন্যদিকে মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলে বলে সেগুলো নিয়ে এগুতে পারেন না সাধারণ অনেক মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক উম্মে ওয়ারা বলছেন মামলা না করার পেছনে অন্য আরও কারণ থাকে।
“যেমন আপনি যখন পুলিশের কাছে যাচ্ছেন সেখানে শুরুতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। পুলিশের কাছ থেকে আমরা সবসময় সহযোগিতা পাই না। থানায় যাবো কিনা, গিয়ে কী ধরনের ব্যবহার পাবো এটা একটা বিষয় থাকে।”
তিনি আরও বলছেন, “আপনি যখন বিচার ব্যবস্থায় যাবেন, সেখানে মামলার অনেক জট আছে। মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন নিয়মনীতি সাধারণ মানুষ বোঝেন না। একজন আইনজীবী লাগছে, তার ফি দিতে হচ্ছে। এবং বছরের পর বছর একটি মামলা টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সেটা করতে হলে আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকা খুব প্রয়োজন।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।