জুমবাংলা ডেস্ক: সবজি বীজ উৎপাদন করে ভাগ্য বদলেছে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পাঁচ শতাধিক কৃষকের। কয়েক বছর আগেও যারা অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করতেন, তারাই এখন বীজ আবাদ করে অর্থনৈতিকভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। অধিক লাভের আশায় প্রতিবছর অন্য ফসল আবাদ ছেড়ে বীজ আবাদের দিকে ঝুঁকছেন স্থানীয় অনেক কৃষক।
পীরগাছা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, পীরগাছা উপজেলায় ছোট বড় প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক বছরের দুই মৌসুমে শাক-সবজি বীজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ জনের মতো কৃষক রয়েছেন উপজেলার পারুল ইউনিয়নে । চলতি মৌসুমে এসব কৃষক প্রায় ৭০ হেক্টর জমিতে ‘বিএডিসি’সহ ৮-১০টি বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে বীজ আবাদ করেছেন। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০-৯০ মেট্রিকটন। এই বীজ বিক্রি করে কৃষকের ঘরে টাকা আসার সম্ভাবনা রয়েছে ১০-১২ কোটি টাকা। এছাড়া বীজ উৎপাদনের কাজে কৃষকের সঙ্গে উপজেলায় ৮-১০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের মৌসুমে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, এবার জেলায় প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে সবজি বীজের চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়ন এবং মিঠাপুকুর উপজেলার লতিফপুর ও পায়রাবন্দ ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি বীজ উৎপাদন হচ্ছে।
পারুল ইউনিয়নের ছিদাম গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত বিস্তৃত নানা জাতের সবজির ক্ষেত। এসব ক্ষেতে বাঁশের জাংলা বা মাচা করে করলা, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, লাউ, বরবটি মিষ্টি কুমড়ার, শসা, বরবটিসহ আরও কয়েক প্রকার সবজির বীজ চাষ করছেন কৃষকরা। এই ভরা মৌসুমে প্রচণ্ড রোদের মধ্যেই তাদের সবজি ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে।
বসন্তের শেষে- চৈত্র মাসে ক্ষেত থেকে আলু তোলার পরপরই জমি প্রস্তুত করা হয়। সারিবদ্ধভাবে রোপন করা হয় সবজি ফসলের ভিত্তি বীজ। এরপর দুই থেকে আড়াই ফুট উঁচু মাচা তৈরি করা হয়। এসব মাচায় ফল ধরার পর তাতে চলে প্যাকেটিংসহ নানা ধরনের পরিচর্যা। এতে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেন বেসরকারি কোম্পানি, কৃষি বিভাগ ও বিএডিসির মাঠ কর্মকর্তারা।
পরামর্শের পাশাপাশি কৃষকের নিবিড় পরিচর্যায় পরিপক্ক সবজিগুলো জমি থেকে হারভেস্ট বা ঘরে তোলার পর সেগুলো থেকে বীজ বের করে নেন কৃষকেরা। লাভের আশায় কঠিন পরিশ্রমে হাইব্রিড জাতের এসব ফসলের বীজ উৎপাদনে রোদ বৃষ্টিতেও যেন তাদের কোন ক্লান্তি থাকে না।
উপজেলার পারুল ইউনিয়নের বীজ উৎপাদন খ্যাত ‘নাগদহ ছিদাম’ গ্রাম ঘুরে কথা হয় কৃষক মনতাজুর রহমান জিল্লালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লাল তীর ও বিএডিসি কোম্পানি থেকে ২৫ শতকের হাইব্রিড জাতের মিষ্টি কুমড়া, এক একর লাউ এবং ৫০ শতক গজ করলার বীজ রোপণ করেছিলাম। শেষ সময়ে এসেও ফসলগুলো খুব ভালো আছে। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে মিষ্টি কুমড়ার ২৫ শতক থেকে প্রায় ৩০-৩৫ কেজি বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বিক্রয় মূল্য প্রতি কেজি ১০ হাজার টাকা দরে তিন লাখ টাকা হবে। এছাড়াও করলা আর লাউয়ে একর প্রতি লাখ টাকা করে লাভ থাকবে বলে আশা করছি।’
একই এলাকার চাষি বাবু রাম নিজের ৫০ শতক জমিতে মেটাল কোম্পানির দেয়া হাইব্রিড জাতের লাউ, ২৫ শতকে শসা এবং লীজকৃত ২৫ শতকে ধুন্দুল আবাদ করেছেন। হারভেস্ট মৌসুমে সেগুলো থেকে বীজ সংরক্ষণ চলছে। সংরক্ষিত বীজগুলো রোদে শুকিয়ে নির্ধারিত দামে চুক্তি মোতাবেক কোম্পানিতে দেওয়ার জন্য চলছে অন্যান্য প্রস্তুতিও তার।
ধুন্দুল ক্ষেতে ফল হারভেষ্টকালে বাবু বলেন, এবার বীজের আবাদ বেশ ভালো হয়েছে। ফলন দেখে আশা করছি ধুন্দুল ক্ষেত থেকে ৮০-১০০ কেজি বীজ হবে। এই ক্ষেতে আমার খরচ হয়েছে ২৫-২৮ হাজার টাকা। আর এর বিপরীতে কোম্পানির দেওয়া বীজের এক হাজার টাকা কেজি দরে আমার প্রায় এক লাখ টাকার বীজ হবে। এই ২৫ শতকে খরচ বাদে তার লাভ থাকবে ৫০-৬০ হাজার টাকা। বাকি ফসলগুলোতেও এই লাভের আশা করছে বাবু।
ওই এলাকার আরও কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএডিসির পাশাপাশি লালতীর, সুপ্রিম সিড, মেটাল, এসিআই, ম্যাকডোনাল্ডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন জাতের সবজির ভিত্তি বীজ ও তাদের মাঠ কর্মকর্তা দিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে উৎপাদিত বীজগুলোর গুণগত মান নির্ণয় করে কোম্পানি নির্ধারিত দামে কিনে নেন। ক্রয়কৃত বীজের মূল্য শর্তসাপেক্ষে জমাদানের তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে কৃষককে পরিশোধ করেন ওইসব কোম্পানি বা চুক্তিবদ্ধ ওই প্রতিষ্ঠান।
মেটাল কোম্পানির ফিল্ড কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের নির্ধারিত কৃষকদের মাঠ পর্যায়ের ফসলগুলোর খোঁজ রাখছি। উন্নমানের ভিত্তিবীজ উৎপাদনে জমিতে গিয়েও কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। হারভেস্টকৃত বীজগুলো সঠিক তাপমাত্রার শুকানো হচ্ছে কিনা সে বিষয়েও আমরা খেয়াল রাখছি। সর্বোপরি হাইব্রিডসহ উন্নত জাতের সবজি বীজ উৎপাদনের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে আমরা কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শের পাশাপাশি ভালোমানের বীজ উৎপাদনে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।’
পীরগাছা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পারুল ইউনিয়নের নাগদাহ, ছিদাম, দেউতি, শরিফ সুন্দর, কিং সেচাকান্দি গ্রামসহ উপজেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক এই বীজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এবছর উপজেলায় প্রায় ৭০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি বীজ চাষ করা হয়েছে। বীজ উৎপাদনে অধিক লাভ হওয়ায় প্রতিবছর বীজ আবাদে এই এলাকায় কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। এসব চাষিদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।’
এদিকে, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ ফলনশীল জাতের সবজি বীজ উৎপাদন ভবিষ্যৎ ভালো ফলনের সহায়ক। রংপুরে বিশেষ করে পীরগাছার পারুল ইউনিয়নের কৃষকরা বীজ উৎপাদন করে একদিকে যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে বাজার বা দেশে ভালো মানের ভিত্তি বীজেরও নিশ্চয়তা করে দিচ্ছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সবজি উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে সবজিতে উচ্চ ফলনশীলতা। সেই লক্ষেই বিএডিসি ও কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।