মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব: সমাজের সদস্যরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কারও একার পক্ষে প্রয়োজনীয় যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহতায়ালা ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসার মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় ও মুনাফা লাভের বিধান প্রবর্তন করেছেন।
খ্যাতনামা ফকিহ ইবনু কুদামা (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সার্বিকভাবে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে সব ফিকাহবিদ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। আর প্রজ্ঞার দাবিও তাই। কেননা মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অন্যের কাছে রয়েছে। আর কেউ বিনিময় ছাড়া তা দেবেও না। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয় বিধিসম্মত ও জায়েজ করে তাদের উভয়েরই উদ্দেশ্যে পৌঁছানো ও প্রয়োজন পূরণ করার পথ প্রবর্তন করা হয়েছে।’ (ইবনু কুদামা, আল-মুগনি : ৬/৭)
সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য সুসংবাদ
ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা অবলম্বন করতে এবং সর্বপ্রকার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সুসংবাদ। অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৫২; সুনানে দারেমি, হাদিস : ২৫৩৯)
অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী সততার সঙ্গে পণ্য ক্রয় করে বিক্রয় করে, সে কিয়ামতের দিন ওই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে। এটি ব্যবসায়ীর জন্য বড় ধরনের মর্যাদা ও সম্মান।
মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহকে ভয় করে এবং ব্যবসায় সততা ও সত্যবাদিতা অবলম্বন করে তারা ব্যতীত কিয়ামতের দিন অন্য ব্যবসায়ীরা পাপিষ্ঠ রূপে উত্থিত হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১২১০; ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২১৪৬)
এক হাদিসে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন উপার্জন সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং নিষ্ঠাপূর্ণ বেচাকেনা।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭২৬৫; মিশকাত, হাদিস : ২৭৮৩)
যে ব্যবসায় মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা ও সংশয় থাকে না, তাকে শরিয়তের ভাষায় ‘বায়য়ে মাবরুর’ বা নিষ্ঠাপূর্ণ ব্যবসা বলে।
কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ব্যবসা করে, তার জন্য ব্যবসা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক ও হালালকৃত একটি বিষয়। (আস-সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি, হাদিস : ৫/৪৩২)
মুনাফাখোরি ইসলামে নিষিদ্ধ
ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে জাতীয় ও সামষ্টিক স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়েছে। এজন্য যেসব কারবারের ফলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের অনৈতিক মুনাফা হয় এবং আপামর জনসাধারণের নাভিশ্বাস ওঠে ইসলাম সেসব কারবারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য পণ্যে ভেজাল দিয়ে মুনাফা লুটে নেওয়াও নিষিদ্ধ। উপরন্তু এগুলো অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করার শামিল।
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ব্যতীত তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। আর তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।’
(সুরা নিসা, আয়াত : ২৯)
বিখ্যাত মুসলিম মনীষী সাইয়িদ কুতুব (রহ.) বলেন, ‘সম্পদ বৃদ্ধির যেসব পদ্ধতির অনুমতি আল্লাহতায়ালা দেননি বা তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন, তার সবই অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণ করার শামিল। যেমনÑ প্রতারণা, ঘুষ, জুয়া, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করা এবং সব ধরনের অবৈধ ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি।
(তাফসির ফি জিলালিল কোরআন : ৫/৬৩৯)
ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফা ও মুনাফাখোরি
মুনাফার সংজ্ঞা : মুনাফা শব্দের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে রিবহুন। এর অর্থ ব্যবসায় লাভ করা। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ২২/৮৩; আল-মুজামুল ওয়াসিত, পৃষ্ঠা : ৩২২)
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ অর্থে শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ফামা রাবিহাত তিজারাতু হুম…। অর্থাৎ : তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত হয়নি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৬)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা দেখবে কেউ মসজিদে বিক্রয় বা ক্রয় করছে, তখন বলবেÑ আল্লাহ তোমার ব্যবসাকে লাভজনক না করুন! (তিরমিজি, হাদিস : ১৩২১; হাকেম, হাদিস : ২/৬৫; মিশকাত, হাদিস : ৭৩৩) এখানে মহানবী (সা.) ‘রিবহুন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
আর মুনাফার ইংরেজি প্রতিশব্দ প্রফিট। মুনাফার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহমুদ আবদুর রহমান আবদুল মুনঈম বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে সম্পদ বা মূলধন বৃদ্ধি হওয়া।’
(মুজামুল মুসতালাহাত ওয়াল আলফাজ আল-ফিকহিয়্যাহ : ২/১২০)
ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, ‘ব্যবসা হলো স্বল্প দামে পণ্য ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রি করে মূলধনের প্রবৃদ্ধি ঘটানোর মাধ্যমে উপার্জনের প্রচেষ্টা। আর ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত এ বাড়তি পরিমাণটাকেই বলা হয় মুনাফা।’ (মুকাদ্দামাতু ইবনে খালদুন, পৃষ্ঠা : ৩২৮)
ইমাম রাগিব ইস্পাহানি মুনাফার সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত বাড়তি সম্পদকে মুনাফা বলা হয়। পরে তা পরোক্ষ অর্থে কর্মের ফল হিসেবে যা পাওয়া যায়, সেটিকে বোঝায়।’ (আল-মুফরাদাতু ফি গারিবিল কোরআন, পৃষ্ঠা : ১৯১)
মোদ্দাকথা, হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত লভ্যাংশকে বলা হয় মুনাফা। আর মিথ্যা, ধোঁকাবাজি ও অবৈধ উপায়ে লাভ করার নেশায় যে মত্ত থাকেÑ তাকে বলা হয় মুনাফাখোর (চৎড়ভরঃববৎ)।
সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য
অনেকে সুদ ও মুনাফাকে একই মনে করেন। এমনকি ‘সুদ তো মুনাফার মতোই’ বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। অথচ এই দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
ক. সুদ হলো একই ধরনের জিনিসের বিনিময়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করা, যেটি ইসলামে হারাম। আর মুনাফা হলো হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত লভ্যাংশ। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫; মুসলিম, হাদিস : ১৫৮৮)
খ. সুদ হলো ঋণের শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে মূল অর্থের সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে ঋণ যা লাভ নিয়ে আসে, সেটিই সুদ।’ পক্ষান্তরে মুনাফা হলো উৎপাদনের মূল্য ও উৎপাদন খরচের পার্থক্য। (ইরওয়া, হাদিস : ১৩৯৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।)
গ. সুদ পূর্বনির্ধারিত। অন্যপক্ষে মুনাফা পরে অর্জিত হয়।
ঘ. সুদে কোনো ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা নেই। অন্যপক্ষে কোনো উদ্যোগে বা কারবারে মুনাফা না হয়ে লোকসানও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মূলধন সরবরাহকারী এবং উদ্যোক্তা উভয়ের ক্ষেত্রেই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ঙ. সুদ কখনো-ই ঋণাত্মক হতে পারে না। বড়জোর খুবই কম বা তাত্ত্বিকভাবে শূন্য হতে পারে। মুনাফা ধনাত্মক, শূন্য এমনকি ঋণাত্মক (অর্থাৎ লোকসান) হতে পারে।
চ. সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে না। পক্ষান্তরে মুনাফা হলো উদ্যোক্তা ও পুঁজির জোগানদাতা সময় ও শ্রম বিনিয়োগের ফল। (সুদ, প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান; পৃষ্ঠা : ১০-১১)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।