ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: বিশ্ব যখন একটি অতিমারিতে জর্জরিত, বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভালো নয়। প্রতি সপ্তাহে করোনা ভাঙছে নতুন রোগী শনাক্ত বা মৃত্যুর রেকর্ড। ঈদের আগে আমাদের যে বেপরোয়া ছোটাছুটি, তাতে ভেস্তে গেছে মাসের প্রথম ১৪টি দিনের কঠোর লকডাউনের সব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এখন ঈদের পর কভিডের ধাক্কাটা কত জোরে এসে লাগে আর সে ধাক্কায় আমরা ধরাশায়ী হব, না সামলে নিতে পারব, সেই শঙ্কায় আমরা।
এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক এমনই সময় ক্যালেন্ডারের পাতায় মাসটি আবার জুলাই আর তারিখটি ২৮ জুলাই। এই দিনটি হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের আবিষ্কারক মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ব্লুমবার্গের জন্মদিন। অধ্যাপক ব্লুমবার্গ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকারও আবিষ্কারক। এই টিকাটি সারা পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, অনেক মানুষের লিভারের ক্যান্সার ঠেকিয়েছে। কারণ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই, বিশেষ করে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে লিভার ক্যান্সারের প্রধানতম কারণই হচ্ছে এই ভাইরাসটি। অথচ এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি ব্লুমবার্গ পেটেন্ট করেননি। এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর জন্মদিনটিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই বেছে নিয়েছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস হিসেবে, যা সংস্থাটির অনুমোদিত আটটি মাত্র দিবসের অন্যতম।
এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘হেপাটাইটিস : আর অপেক্ষা নয়’। প্রশ্ন হচ্ছে, চলমান প্যানডেমিকের মধ্যে কী এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াল হেপাটাইটিস যে আর একটি মুহূর্তও অপেক্ষা করার সময় নেই আমাদের ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ে। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের সংক্রমণ আছে আর হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত আরো প্রায় ১ শতাংশের কাছাকাছি। এখানেই শেষ নয়, এ দেশের আরো প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের জীবদ্দশায় কোনো এক সময় হেপাটাইটিস ভাইরাসে এক্সপোজড হয়েছে।
আর এসব মানুষের অনেকেই কোনো এক সময় লিভার সিরোসিস বা এমনকি লিভার ক্যান্সারেও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এ দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর মেডিসিন বিভাগগুলোতে প্রতিবছর যত রোগী ভর্তি হয় তার প্রায় ১২ শতাংশ ভুগছে লিভার রোগে। আর যারা মারা যাচ্ছে, হিসাব করলে দেখা যাবে সেখানেও লিভারের রোগগুলো আছে একেবারে ওপরের দিকে। বৈজ্ঞানিক প্রকাশনাগুলো থেকেই দেখা যাচ্ছে, এ দেশের ৮০ শতাংশ লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সার হচ্ছে এই দুটি ঘাতক ভাইরাসের কারণেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলদেশে প্রতিবছর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ২০ হাজার মানুষ, যা এই প্যানডেমিকে এ পর্যন্ত এ দেশে যতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। আর কভিড অতিমারিতে যখন বিঘ্নিত হচ্ছে নন-কভিড স্বাস্থ্যসেবা, তখন এই সংখ্যা যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
মৃত্যুর এই মিছিল যদি কমিয়ে আনতে হয়, তাহলে সবার আগে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো মানুষকে সচেতন করা; তারা যেন পরীক্ষা করে জেনে নেয় তাদের হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাস ইনফেকশন আছে কি না। কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে যারা ইনফেকটেড, তাদের ৫ শতাংশও জানে না যে তাদের লিভারে জ্বলছে এই ‘তুষের আগুন’। এর কারণটিও অবশ্য সংগত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তো ভাইরাস দুটি রোগের কোনো লক্ষণই তৈরি করে না, এমনকি লিভার অনেকখানি আক্রান্ত হয়ে গেলেও না।
আর এই সচেতনতা তৈরির কাজটি যে কী পাহাড়সম, তা তো কভিডই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। তবে শুধু সচেতনতা সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়। যারা সচেতন হয়ে এগিয়ে আসবে, তাদের জন্য সহজে আর সুলভে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা নেগেটিভ রিপোর্ট পাবে, তাদের জন্য চাই সুলভে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভ্যাকসিন এবং পজিটিভ হলে লাগবে সস্তায় ওষুধ আর সহজে লিভার বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ।
এ ক্ষেত্রে যে আমাদের প্রস্তুতি একেবারেই খারাপ, তা-ও কিন্তু নয়। প্যানডেমিকটি শুরু হওয়ার আগেই আমরা আমাদের পাঁচ বছর বয়সীদের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’র সংক্রমণ ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম, যা একটি বড় অর্জন আর এর স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। আমাদের রয়েছে একটি অত্যন্ত সফল টিকাদান কর্মসূচি আর সঙ্গে সরকারের হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নির্মূলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে আছে একটি অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপিও।
দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে লিভার রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্র। ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, সেদিন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের লিভার বিভাগে সহকারী অধ্যাপকের একটি শূন্যপদ ছিল আর আজ তা বেড়ে গিয়ে সারা দেশে ৩০ ছুঁই ছুঁই। একসময় শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই হেপাটোলজিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ ছিল আর এখন এ বিষয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করা যায় বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস এবং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজেও।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সব সেক্টরে যে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, তার ছোঁয়া যেহেতু লেগেছে আমাদের ওষুধশিল্পেও। এ দেশে তৈরি ওষুধ একদিকে যেমন রপ্তানি হচ্ছে পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে, তেমনি অন্যদিকে দেশের মানুষও হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’, লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারের যাবতীয় আধুনিক ওষুধ পাচ্ছে দেশে বসে, অনেক কম খরচে।
তার পরও এ কথা মানতেই হবে, আমাদের এখনো যেতে হবে অনেকটা পথ। কারণ সময় হাতে মাত্র ৯ বছর। এসডিজির অন্যতম গোল হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নির্মূল করা। এমডিজিগুলো অর্জনের সাফল্যের কথা মাথায় রেখে আমাদেরও এই কাজটি করতে হবে। কাজটি এমনিতেই কত কঠিন আর তার ওপর বাড়তি ঝামেলা হিসেবে জেঁকে বসেছে কভিড প্যানডেমিক। আর এই যে চিত্র, এটি কিন্তু বিশ্বব্যাপী মোটামুটি কমবেশি একই রকম। এই প্রেক্ষাপটেই এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্যে—তাই হেপাটাইটিস নিয়ে এত তাড়াহুড়া।
এ দেশে লিভার রোগের স্টেকহোল্ডার কারা, সে হিসাব করতে বসলে বাদ যাবে না কেউই। আমরা কেউ হেপাটাইটিসের রোগী, তো কেউ চিকিৎসক আর কেউ বা ওষুধ বা ডায়াগনস্টিক বা হাসপাতাল সেবার সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে যারা, তারা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছি। কাজেই আমাদের সাবধান হতে হবে। আর এই সাবধানতা তৈরি করার চেষ্টায়ই আজকের এই দিনে বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।