দারুণ সম্ভাবনাময় আমাদের তরুন প্রজন্ম। অথচ রুটিন মানতে তাদের যত অনীহা। বিশেষ করে রাত জাগায় তাদের ক্লান্তি নেই। কিন্তু অনিদ্রা ক্ষতি করছে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বলা হয় সবচেয়ে বেশি ঘুম পালানো প্রজন্ম। ওরা জেনারেশন জি। ডিজিটাল ডিভাইস, টেকনোলজি, সোশ্যাল মিডিয়া, স্মার্টফোন, স্মার্ট টেলিভিশন, অনলাইন পড়াশোনা, অনলাইন চাকরি, ভিডিও গেমস ইত্যাদির ওপর নির্ভরতার কারণে তারা রাত জেগে থাকে এবং ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়।
রাত জেগে থাকা, না ঘুমিয়ে পরদিন কাজ করা বা কম ঘুমানো এবং ঘুম থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কারণে তাদের মস্তিষ্কে নানান ধরনের পরিবর্তন এসেছে। রাতের গভীরতার সঙ্গে ঘুমের গভীরতা জড়িত রয়েছে। ঘুমের গভীরতার সঙ্গে মস্তিষ্ক আলফা, বিটা, থিটা, ডেলটা স্তরগুলো পার করে।
ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক প্রধান যে দুটো কাজ করে, তা হলো কগনিটিভ রিপেয়ার এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস বের করে দেওয়া। খুব ভালো ঘুম হওয়ার পর মানুষ সকালবেলা খুব সতেজ অনুভব করে এবং ভালো ঘুমের কারণে স্মরণশক্তি বেড়ে যায়, মনোযোগের ক্ষমতাও বেড়ে যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্ক এসব ক্ষমতা হারাতে শুরু করে।
ঘুম না হওয়াটাই জেন–জিদের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা। এই অনিদ্রার কারণে ওজন বাড়ে, ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়, পট বেলি হয়, রক্তচাপ বাড়ে, ডায়াবেটিস, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি হয়। এ তো গেল শারীরিক। এর সঙ্গে জুটি বাঁধে মানসিক সংকট। মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, সরাসরি যোগ হয়। খাবার নিয়মিত না খেলে যেমন শরীরের ক্ষতি হয়, তেমনি ঘুম নিয়মিত না হয় মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঠিকমতো না ঘুমানোর কারণে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ হোয়াইট ম্যাটার ও গ্রে ম্যাটারে সরাসরি প্রভাব পড়ে। এতে করে অসামাজিক ও অবন্ধুত্বসুলভ আচরণ, মুড সুইং, ধৈর্য কমে যাওয়া, দ্রুত রেগে যাওয়া, সৃষ্টিশীলতা কমে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়।
আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডে জেন–জিদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে তাদের সম্ভাবনার তুলনায় প্রোডাকটিভিটি অনেক কমে গেছে। জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ হেলথ–এ ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, ৬০ ভাগ ছাত্রছাত্রী খারাপ ফল করেছে পরিমাণের তুলনায় কম ঘুমানোর কারণে। জার্নাল অব বিহেভিয়ার এডিকশন্স–এ ২০১৯ সালে প্রকাশিত গবেষণায় প্রকাশ, ২০ ভাগ জেন–জির পড়াশোনা খারাপ হওয়া বা খারাপ ফলাফলের কারণ ছিল স্মার্ট ডিভাইসে আসক্তি।
ওই বছরের দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে কেবল ঘুমের সমস্যা এবং ডিভাইস আসক্তির কারণে ১৬ থেকে ২৪ বছরের ৫ শতাংশ জেন–জি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালে কানাডা থেকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ১৮ থেকে ২৪ বছরের জেন-জিদের ৪৩ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদি নিদ্রাহীনতার সমস্যায় ভুগছে। ২০২২ সালে দ্য জার্নাল অব স্লিপ রিসার্চ জেন–জিদের সম্পর্কে লিখেছে, স্ক্রিনটাইম বেড়ে যাওয়ার কারণে তরুণদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে।
রাত জাগার কারণে বা দেরিতে ঘুমের কারণে বা সকালে ঘুমানোর কারণে বা ঘুম থেকে সকালবেলা উঠতে না পারার কারণে স্কুল ও কলেজ ছেড়ে দেওয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তাই আমেরিকার অনেক স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালায় সকালে শুরুর সময় পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে যে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম হচ্ছে না।
প্রতি ৯৬ সেকেন্ড পরপর মস্তিষ্ক চোখকে সিগন্যাল পাঠায় মোবাইলের দিকে তাকানোর জন্য। দিনের বেলা এই সাইকেল চলতে থাকে, ঘুমের আগে এবং ঘুমের ভেতরও এই সাইকেল চলে। ফলে ঘুমের গভীরতা কমে যায়। এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। আমি সেই চেষ্টা করে থাকি।
আমার কাছে সেবা নিতে আসা রোগীদের নানাভাবে সাহায্য করে এই বৃত্ত থেকে বের করে আনার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবার, বিভিন্ন হারবাল ও সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পাশাপাশি মেডিটেশন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের বিভিন্ন কৌশল অভ্যাসের পরামর্শ দিয়ে থাকি। মস্তিষ্কের প্রি–ফ্রন্টাল কর্টেক্সের কগনিটিভ পাওয়ার বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের ইম্পালসকে নিয়ন্ত্রণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। ফলে ঘুমের সারকাডিয়ান রিদম আবার ফিরে আসে। তরুণেরা আবার ফিরে পায় মস্তিষ্কের সতেজতা। জেন-জিরা অনেক সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্ম। আশা করি তারা এ সমস্যাগুলো সহজেই কাটিয়ে উঠবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।