তাপমাত্রা চেক করে দেখি ৩৩ ডিগ্রি, কিন্তু অনুভব হচ্ছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হিসেবে। অর্থাৎ গ্রীষ্মের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ৮ ডিগ্রি বেশি গরম আপনাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে এই মুহূর্তে। কেন এমন হচ্ছে? প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে নিজেকে একটা চুল্লির ভেতর আবিষ্কার করি। ঘরের ভেতর গনগনে তাপ, ফ্যানের বাতাস যেন লু হাওয়া। অদ্ভুত হচ্ছে এই সেদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা দিনে রাতে সবসময়ই চলছে। ঠোট ফেটে গেছে, গতকাল রক্ত বের হচ্ছিল। কিন্তু ঘাম নাই তেমন। স্রেফ মনে হচ্ছে ভেতরে সব জ্বলছে। এই যে অতিরিক্ত গরমে রীতিমতো সেদ্ধ হচ্ছি আমরা, এর পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে কি ভেবেছি সেভাবে?
না, বন ধ্বংস বা গাছপালা লাগানোর অনীহা কিংবা জলাশয়-নিচু জমি ভরাট করে কংক্রিটের জঞ্জাল তৈরি ইত্যাদি সকল কারণের ব্যাপারে বলছি না আপাতত। এগুলো তো আছেই, চলতেই থাকবে আমরা নিজেদের পুরোপুরি ধ্বংস না করে ফেলা পর্যন্ত। কিন্তু গত কমপক্ষে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আরেকটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ঘটে চলেছে আমাদের একদম সামনেই, সেটার ব্যাপারে বরাবরের মতোই নিদারুণ উদাসীন আমরা। সেটার দিকেই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছিলাম।
বিশ্বখ্যাত ব্লুমবার্গ নিউজে গত ৮ এপ্রিল একটা খবর প্রকাশিত হয় জিএইচজিস্যাটের বরাত দিয়ে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখা গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর একটা, মিথেন গ্যাসের একটা বিশাল নিঃসরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার কোনো এক অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে মিথেন গ্যাসের অন্যতম প্রধান কন্ট্রিবিউটর বানিয়ে দিয়েছে।
তো বায়ুদূষণ নতুন কিছু না, আমেরিকা-চীন-ব্রাজিল-ভারত তো পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এইটা এত বড় ঘটনা কেন হচ্ছে? এমন প্রশ্ন মাথায় আসা অস্বাভাবিক না। মুশকিলটা হচ্ছে মিথেন গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ডেডলিয়েস্ট গ্যাস, যা কিনা গত দুই দশকে কার্বন ডাই অক্সাইড (যেটাকে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়) এর চেয়েও ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের। এই ঘ্রাণহীন বর্ণহীন গ্যাস সূর্যের যে তাপ পৃথিবীতে আসছে, সেটাকে পৃথিবীতেই ধরে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে এবং খুব দ্রুত। ফলে বাড়তি তাপমাত্রা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের মতো সমুদ্র তীরবর্তী দেশের জন্য যা অনিবার্য অভিশাপ। ক্লাইমেট চেঞ্জের ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর মাধ্যমে এভাবেই আমরা সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছি।
এখন মিথেন যেহেতু সূর্যের তাপটা পৃথিবীতে ধরে রাখে, ফলে যে স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসের উৎপত্তি ঘটবে, সেখানে গ্রীষ্মের গরমের সময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে। সম্ভবত ঠিক সেটাই ঘটছে এখন। জিএইচজিস্যাট-এর স্টিফেন জারমেইন জানিয়েছেন, গত ১৭ এপ্রিল তাদের হুগো স্যাটেলাইট দেখিয়েছে যে, এই মুহূর্তে রাজধানী ঢাকার মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড় থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৪ হাজার কেজি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে, যা এক লাখ ৯০ হাজার গাড়ির বায়ুদূষণের সমান দূষণ। পৃথিবীর ১২টা মিথেন এমিসন হটস্পটের একটি বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু স্রেফ একটা স্থান থেকে এই বিপুল পরিমাণে মিথেন নিঃসরণের উদাহরণ এই মুহূর্তে খুবই বিরল। জিএইচজিস্যাট অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের মিথেন হটস্পট নিয়ে কাজ করছিল, এই প্রথমবারের মতো তারা পিনপয়েন্ট করতে পেরেছে নির্দিষ্ট কোন জায়গা থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হচ্ছে। এখন গ্যাসের নির্গমন এতই শক্তিশালী যে সেটা স্যাটেলাইটে ধরা পড়ার মতো যথেষ্ট, এবং মোটামুটি অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চাইতেও এই ক্লাস্টার অনেক বড়।
যদিও স্টিফেন জানিয়েছেন, মাতুয়াইল থেকে নিঃসরণ অনেক বড় একটা মিথেন সোর্স, কিন্তু এরপরেও এটা পুরো শহরের উপরের বায়ুমণ্ডলে এমন দীর্ঘস্থায়ী এবং বিশাল মিথেন নিঃসরণ এক্সপ্লেইন করার জন্য যথেষ্ট না। তারা এই বিশাল মিথেন উৎপত্তির সব উৎস খুঁজে বের করার জন্য মনিটরিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৮১ একরের মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশন বা মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে অফিসিয়ালিই প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য এনে ফেলা হয়। দুই সিটি কর্পোরেশনে বাসাবাড়ির ময়লা থেকে শুরু করে সব ধরনের বর্জ্যের অ্যাপ্রোক্সিমেট অ্যামাউন্টটা ছিল ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টন। এটা ২০১৮-২০১৯ সালের হিসাব।
২০১৯ সালে তৎকালীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। প্রতিদিন ৭ হাজার টনের উপরে এত পরিমাণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত লোকবল বা ব্যবস্থা এবং জায়গা না থাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই বিপুল বর্জ্য কাজে লাগাতে এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ৭২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণসহ ভূমি উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য ৮১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার কার্যক্রমও চূড়ান্ত অবস্থায় ছিল। ২০১৯ সালে এ নিয়ে একটা সংবাদে বিস্তারিত যা জানলাম-
‘জানা গেছে, ডিএসসিসি এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। নতুন করে ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় এর পরিমাণ আরও বেড়েছে। এদিকে বর্জ্য ফেলার স্থান মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলেও পর্যাপ্ত সংকুলান নেই। এ অবস্থায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মাতুয়াইলে বড় ধরনের একটি দগ্ধকরণ প্লেস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে পৃথক দুটি ভাগ থাকবে। একটিতে সাধারণ বর্জ্য এবং অন্যটিতে ইলেকট্রনিক বর্জ্য দগ্ধ করা হবে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য পোড়ানোর পর যে নির্যাস থাকবে, তা দিয়ে কয়লাজাতীয় দ্রব্য উৎপাদন করা হবে জ্বালানির কাজে। পাশাপাশি বর্জ্য দগ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় যে তাপ বা শক্তি উৎপাদন হবে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।’
তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন সংসদে বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণে ভূমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে এবং এই প্রকল্পের আওতায় ল্যান্ডফিলের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে এত দিনে সেটা বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার কথা। আর তাহলে বর্জ্য পোড়ানোর কার্যক্রমও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ঘণ্টায় ৪ হাজার কেজি মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে কিনা বা এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা এগুলো বিস্তারিত তদন্ত ও নিরীক্ষা খুব জরুরি। কারণ মাতুয়াইল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে জাইকার সহায়তায় অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা থাকলেও কি পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে সেটার ডাটা রাখা হয় না।
পরিবেশমন্ত্রী ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন, মাতুয়াইল থেকে বিপুল পরিমাণে মিথেন নিঃসরণের ব্যাপারে তিনি জেনেছেন এবং ইতিমধ্যে একটা টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছেন বিস্তারিত জানার জন্য এবং কীভাবে এই মিথেন নিঃসরণ কমানো যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। কমিটির এক মাসের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয়ার কথা। মুশকিল হচ্ছে আমাদের দেশের তদন্ত কমিটির তদন্তে অনেক ক্ষেত্রেই কয়েক জনম পেরিয়ে যায়, যথাসময়ে তদন্ত শেষ হওয়ার মতো অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলেও তদন্ত রিপোর্ট আমলে নিয়ে বাস্তবায়নের মতো অসম্ভব ঘটনা প্রায় কখনোই ঘটে না বললেই চলে।
সে জন্য দরকার ছিল মিডিয়ার প্রেশার। পত্রিকায় খবর, নিউজ চ্যানেলে নিউজ, বিস্তারিত এবং প্রতিদিন ফলোআপ, প্রেশারে রাখা। আপনার দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ যে দেশের অর্ধেকেরও বেশি আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে গবেষণায় বারবার, যে দেশ দুনিয়ার ১২টা মিথেন গ্যাস নিঃসরণের হটস্পট, যে দেশ শিল্পক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ ইনডেক্সে ১১১টা দেশের মধ্যে ৯৫তম, যেখানে কমপক্ষে টানা ৩ সপ্তাহ ধরে স্যাটেলাইট ঘণ্টায় ৪ হাজার কেজি মিথেন নিঃসরণের বিপর্যয়ের খবর জানাচ্ছে, যে মিথেন কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও ভয়াবহ। যে খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসছে, টানা ৩ সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহেই একবার করে ফলোআপ করা হচ্ছে, এমনকি সেই পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিরলস মনিটরিং চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেই দেশের একটা মিডিয়াতেও এত বড় খবরটা এল না, কোনো সংবাদমাধ্যম এই ঘটনায় ন্যূনতম একটা রিপোর্ট করার মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করল না, এটা নিদারুণ হতাশার। আফসোসের।
জানি অন্য আরও হাজারটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে এই মুহূর্তে, কিন্তু কোনোভাবে কি তার ভেতরেও এই ইস্যুটা নিয়ে কিছু কথা বলা যায়? গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ সমুদ্রে দেশ ডুবে যাওয়ার আগে গণগণে তাপে যে ফুল বয়েল হয়ে যাচ্ছি আমরা, টের পাচ্ছি?
লেখক: রাতিন রহমান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।