জুমবাংলা ডেস্ক : দুই বছর আগের কথা। হাতে কোনো কাজ না থাকায় মুদির দোকানে গল্পে আড্ডায় ব্যস্ত থাকতেন এক তরুণ। মাঝে মাঝে মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক ও ইউটিউবে বিভিন্ন সফল উদ্যোক্তার ভিডিও দেখে ভালো লাগতো তার। হঠাৎ করেই তার নজরে আসে ড্রাগন নিয়ে এক সফল উদ্যোক্তার ভিডিও।
ইউটিউব দেখতে দেখতেই শেখা হয় ড্রাগন ফল চাষের খুঁটিনাটি। এরপর বাস্তবে কেমন হয় এই ড্রাগন, তা দেখতে ছুটে যান জামালপুরে এক চাষির বাগানে। সেখানে বাগান ঘুরে দেখে ও তাদের সাথে কথা বলেই মনে মনে স্থির করেন, বাড়ির সামনে পতিত জায়গায় করবেন ড্রাগন চাষ। যেই ভাবা সেই কাজ।
বাড়ির সামনে পতিত থাকা ৮০ শতক জমিতে শুরু করেন ড্রাগন চাষ। ইচ্ছা আর অদম্য চেষ্টা থাকলে কোনো কাজই যে অসম্ভব নয় তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার দড়িনগুয়া গ্রামের ড্রাগন সফল তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আমির হামজা। তার সফলতা দেখে উপজেলার অনেকেই এখন ড্রাগন ফল চাষে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। দুই বছরের অদম্য চেষ্টায় বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ করে পেয়েছেন ব্যাপক সফলতা।
পরিচিত বিভিন্ন ফসল চাষের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে, ব্যতিক্রমী ড্রাগন ফলের চাষ করে উপজেলার দড়িনগুয়া এলাকায় আলোড়ন তুলেছেন তিনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আমির হামজার বাড়ির চারদিকে সবুজের সমারোহ। সারিবদ্ধভাবে খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ড্রাগন গাছ। গাছে সবুজ পাতার মাঝে শোভা পাচ্ছে গোলাপি, লাল আর সবুজ ফল। কোনো গাছে মাত্রই ফুটেছে ফুল।
সাড়ে তিনশ পিলার সাড়ে এক হাজার ৪০০ ড্রাগন গাছ রয়েছে তার। সবুজ ক্যাকটাসের মতো কাঁটাযুক্ত প্রতিটি গাছেই ঝুলে আছে অসংখ্য ফুল ও ফল। কিছু ফল পেকে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। আর কিছু ফল পাকার অপেক্ষায়। যে তরুণ গেলো দুই বছর আগেও বেকার ছিলেন, এখন তারই বাগানে প্রতিদিন কাজ করছে আটজন শ্রমিক। রোগ-বালাই কম হওয়ার পাশাপাশি চাষ পদ্বতি সহজ হওয়ায় এবং বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় বিদেশি এ ফল চাষে এরইমধ্যে আশেপাশের অনেকেই ড্রাগন চাষ করার জন্য আমির হামজার কাছ থেকে নিচ্ছেন পরামর্শ।
উদ্যোক্তা আমির হামজা বলেন, ড্রাগন ফল মানেই ভিন্ন আমেজের এক রঙিন রসালো ফল। ড্রাগন সম্পর্কে আমার এর আগে কোনো ধারণাই ছিল না। এ ফলটি কোনদিন খেয়েও দেখিনি। ইউটিউবে দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হই। আসলে ব্যতিক্রমী অচেনা একটি ফল নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। জামালপুরে যে বাগানে আমি ভিজিড করতে যাই, সেখানে গিয়ে দেখি বাগানের মালিক নেই। একজন ম্যানেজার বসে আছে। সে বললো আমরা এক একর জায়গা ভাড়া নিয়ে ড্রাগনের চাষ করছি। আমি তখনি সিদ্ধান্ত নিই, এক একর জায়গা ভাড়া নিয়ে যদি ম্যানেজার ও কর্মচারী রেখে ড্রাগন চাষ করতে পারে, তাহলে আমার এখানে তো আর ভাড়া লাগবে না। আমার নিজেরাই এর চেয়ে ভালো পতিত জায়গা পড়ে আছে। তখনই শেরপুর থেকে ড্রাগনের চাষা সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। আমার বাগানে প্রতিটি খুঁটিতে চারটি করে ড্রাগন ফলের গাছ রোপন করেছি। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৮-১০ ফুট দূরত্বে এ ড্রাগন ফলের গাছগুলো রোপন করেছি। এ গাছ যেকোনো মাটিতেই জন্মায়। তবে উঁচু জমি হতে হবে। পানি জমে থাকে এমন জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করা যায় না। আর একেকটি মাতৃগাছ থেকে এক বছরের মাথায় ফল পাওয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ এখন ড্রগন খুবই পছন্দ করে। প্রায় ফলের দোকানি ও পাইকাররা আমার বাগান থেকে ফল নিয়ে যান। চাহিদা এতো বেশি, আসলে আমি দিয়ে শেষ করতে পারি না। আমি বর্তমানে ২৫০ টাকা কেজি ধরে ড্রাগন বিক্রি করছি। গত বছর আমার আয় হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা, এর মধ্যে সবকিছু মিলিয়ে খরচ হয় এক লক্ষ টাকা। এ বছর আরো বেশি লাভ করতে পারবো বলে আশা করছি। এই ফলে কোন লোকসান নেই। গাছের প্রধান খাবার হলো গোবর। আর কিছুই দেওয়া লাগে না। শুধু পরিচর্যা করলেই হয়। আমাদের অঞ্চলে ড্রাগনের সম্ভাবনা খুবই বেশি। এখন অনেকেই আমার বাগান দেখতে আসে, আমিও তাদের পরামর্শ দিই। মাঠপর্যায়ে কৃষক ও খামারিদের বিদেশি এ ফল চাষের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারলে একদিকে যেমন বিদেশি ফলের আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে, অন্যদিকে ফল চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হতে পারবেন।
স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ আবেদ আলী বলেন, প্রথমে যখন বাড়ির সামনে গাছগুলো রোপন করা হয়, তখন ভেবেছিলাম এগুলো মনে হয় ঔষধি কোনো গাছ হবে। আস্তে আস্তে দেখি, গাছগুলোতে ফল আসা শুরু করেছে। আমি বৃদ্ধ মানুষ, নিজেও কখনো এমন ফল খাওয়া তো দূরের কথা, কোনদিন দেখিনি। ফলটি খেতে খুবই ভালো। এখন তো আমির হামজার বাড়িতে বিভিন্ন ফলের পাইকাররা এই ফল নেওয়ার জন্য ভিড় করেন। ছেলেটির এমন উদ্যোগে আমাদের গ্রামবাসীও খুবই খুশি।
বাগানের শ্রমিক বাদশা মিয়া বলেন, এক সময় ইটভাটায় কাজ করতাম। বেশিরভাগ সময় বাড়িতে বেকার বসে থাকতে হতো। তবে আমির হামজা যখন এখানে ড্রাগন বাগান শুরু করলো তার পর থেকেই আমরা মোট আটজন শ্রমিক প্রতিদিন তার এখানে কাজ করি। আমাদের এখন আর কাজের জন্য ছুটতে হয় না। বেকার বাড়িতে বসেও থাকতে হয় না। আমরা গত দুই বছর ধরে নিয়মিত এ বাগানে কাজ করে আমাদের সংসার সুন্দরমতো চালাতে পারছি।
এ বিষয়ে হালুয়াঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ড্রাগন ফল থেকে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। এগুলো মানবদেহের সুস্থতার জন্য খুবই অপরিহার্য। এ ফল ফাইবারসমৃদ্ধ ও ফ্যাট ফ্রি। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে ফলটিতে। আমির হামজা পতিত জায়গায় ড্রাগন চাষ করেছেন, আমরা তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমির হামজার মতো ড্রাগন ফল চাষের জন্য অন্যদেরও যেন উদ্বুদ্ধ হয় আমরা সে বিষয়েও কাজ করছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।