এইচ এম শরিফুল হাসান: ২০০৩ সালে ভারতের বিহার রাজ্যের আনন্দ কুমার নামের একজন গণিতের শিক্ষক, Super 30, বা চৌকস ৩০ – এই নামে ত্রিশজন গরীব এবং মেধাবী ছেলেমেয়েদের একটা ব্যাচ তৈরি করে তাদেরকে বিনামূল্যে কোচিং করিয়ে আইআইটিগুলোতে ভর্তি করানোর কঠিন মিশনে নেমেছিলেন।
আনন্দ কুমার নিজে গরীব ঘরের সন্তান ছিলেন। তার বাবা ছিলেন পাটনা পোস্ট অফিসের একজন ডাক হরকরা, ডেলিভারি পিয়ন।
ম্যাথের ইকুয়েশন সলভ করার প্রতি ছিল তার নিদারুণ আগ্রহ। নিজের রেগুলার সিলেবাসের বাইরের গাণিতিক সমস্যা সমাধান করার জন্য তিনি চুরি করে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যেতেন৷
সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে বিদেশি ম্যাথ জার্নাল থেকে সমস্যা খুঁজে সেগুলোর সমাধান করতেন। একদিন সেখানের লাইব্রেরিয়ান তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং তার ওই জায়গায় প্রবেশাধিকার নাই বলে অপমান করে বের করে দেয়।
তখন সেই লাইব্রেরির এক কর্মচারী আনন্দকে পরামর্শ দেয় যে তিনি যদি এই জার্নালে তার নিজের কোনো পেপার পাবলিশ করতে পারেন, তাহলে তিনি ওই ম্যাথেমেটিকাল সোসাইটির আজীবন সদস্য হইতে পারবেন এবং ফ্রিতে সারাজীবন ধরে সেই জার্নাল পেতে থাকবে ন৷
এই ঘটনার পরে আনন্দ অনেক খেটেখুটে একটা কঠিন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে লন্ডনে সেই জার্নালের ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করেন, যেটার সমাধান তখন পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি। ওই সমস্যা সমাধানের জন্য আনন্দ কুমারের লিখিত প্রবন্ধ সেই জার্নালে প্রকাশিত হয়।
এবং ঘটনাক্রমে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক রিচার্ড আনন্দ’কে একটি ইনভাইটেশন লেটার পাঠান, তার সাথে গবেষণার কাজে এসিস্ট্যান্টশিপের অফার করে। কিন্তু টাকার অভাব এবং পারিবারিক ঝুটঝামেলার কারণে আনন্দ কুমারের আর বিলেতে যাওয়া হয় না শেষ পর্যন্ত।
পরবর্তীতে তার অর্থকষ্টের সুযোগে এক পরিচিত জনের প্ররোচনায় তিনি একটি কোচিং সেন্টারে যোগ দেন এবং সেই কোচিং সেন্টার খুবই সুনাম অর্জন করে। সর্বত্র রটে যায় যে আনন্দ কুমারের কাছে পড়লে আইআইটিতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়।
আনন্দ কুমার আগে যেই কোচিংয়ের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা উচ্চহারে মাসিক ফি নিয়ে ছাত্রদের আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার প্রলোভন দেখাতেন। আর সেক্ষেত্রে ‘গণিতের জাহাজ’ আনন্দ কুমার ছিলেন তাদের তুরুপের তাস।
কিন্তু একদিন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দ বাবুর চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয়। তিনি মনস্থির করেন ধনীঘরের সন্তানদের আর টাকার বিনিময়ে না পড়িয়ে নিজের মতো গরীবদের জন্য কিছু একটা করবেন।
এই ধারণা থেকেই সুপার ৩০ এর যাত্রা শুরু। ২০০৩ এ শুরুর সেই বছরে আনন্দ কুমারের ৩০ জন স্টুডেন্টের মধ্যে ১৮ জন IIT-JEE (আইআইটি জয়েন্ট এন্ট্রান্স একজামিনেশন) বৈতরণী পার করে আইআইটি নামক স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পেরেছিল।
এই ৩০ জন ছাত্রছাত্রীদের সিলেকশন করা হয়েছিল আরেকটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নিয়ে। নির্বাচিত হওয়ার পরে তাদেরকে একটা হোস্টেলের মতো জায়গায় আবাসিক হিসেবে রেখে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রিপেয়ার করতেন আনন্দ কুমার।
বেসিক্যালি, এই ফ্রি ভর্তি কোচিং আনন্দ কুমার করালেও এর আইডিয়া ছিল তৎকালীন বিহারের পুলিশ প্রধান (ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বিহার) শ্রী অভয়ানন্দ সাহেবের।
তিনিই প্রথমে ম্যাথেমেটিক্স জিনিয়াস আনন্দ কুমারকে এই গরীব মেধাবী বাচ্চাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার কনসেপ্ট শেয়ার করেন। আনন্দ কুমার সেটা লুফে নেন। আর বাকীটা তো ইতিহাস।
২০০৩ সালের প্রাথমিক সাফল্যের পরে ২০০৪ সালে Super 30 ব্যাচ থেকে ২২ জন, ২০০৫ এ ২৬ জন এবং ২০০৬ এ ২৮ জন,২০০৭ ও ০৮ সালে ৩০ জনের প্রত্যেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আইআইটিতে চান্স পায়।
এই কাহিনি নিয়ে ২০১৯ সালে একটা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল হৃতিক রোশানের, নাম “Super 30”! হৃতিকের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে নন-গ্ল্যামারাস সিনেমা এটা এখন পর্যন্ত। এই ছবিতে আনন্দ কুমার সেজেছিলেন হৃতিক নিজে। বিহারের অ্যাকসেন্টে তাকে হিন্দি বলতে শোনা যথেষ্টই রোমাঞ্চকর।
তবে সিনেমায় যেটা উপেক্ষা করা হয়েছিল সেটা হচ্ছে এই পুরো ব্যাপারটায় পুলিশ অফিসার অভয়ানন্দ সাহেবের ভূমিকা। তিনি আইনী সহায়তা না দিলে কোচিং মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আনন্দ কুমার একা টিকে থাকতে পারতেন না।
হয়তো সিনেম্যাটিক নাটকীয়তার প্রয়োজনে আনন্দ কুমারের চরিত্রকে অসহায়ভাবে দেখিয়ে গ্লোরিফাই করা হয়েছিল। কারণ উচ্চপদস্থ কারও ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ হওয়াটা পর্দায় দেখালে সেটা আদৌ দর্শকদের পর্যাপ্ত সিমপ্যাথি পাবে কি-না সেটা নিয়ে ডিরেক্টর প্রডিউসারদের সন্দেহ জেগেছিল।
২০০৮ সালের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টে ১০০% সাফল্য লাভ করার পরে আইপিএস অফিসার অভয়ানন্দ এই প্রজেক্ট থেকে সরে যান এই বলে, “The Experiment is Over.”
লেখক: যুগ্ম কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।