গাজামুখী মানবিক সহায়তাবাহী ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়ার সময় ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করা আন্তর্জাতিক কর্মী, সাংবাদিক ও আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, আটকের পর ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।তারা জানান, আটক অবস্থায় তাদের ঘুম ও ওষুধ থেকে বঞ্চিত করা হয়, মারধর করা হয়, মাথায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করা হয়, কুকুর ছেড়ে দেওয়া হয়, মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়, গালাগালি করা হয়, এমনকি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলার ভিডিও দেখতেও বাধ্য করা হয়।
ইতালির সাংবাদিক সাভেরিও তোম্মাসি বলেন, “বন্দরেই আমাদের মারধর শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। পিঠে, মাথায় ঘুষি, আর সৈন্যরা হাসছিল, মজা নিচ্ছিল। কেউ যদি চোখ নিচু না রাখত, সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আঘাত করা হতো।”
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা (জিএসএফ)–এর সব নৌযান আটক করে, যেগুলোতে ৪০০ জনের বেশি মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে সংসদ সদস্য এবং পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গও ছিলেন। বেশিরভাগকে নেওয়া হয় নেগেভ মরুভূমির উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত কেটসিওত কারাগারে, যা সাধারণত ফিলিস্তিনি বন্দিদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব নির্যাতনের অভিযোগ “নির্লজ্জ মিথ্যা” বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ এক পোস্টে বলা হয়, “সব বন্দির আইনগত অধিকার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা হয়েছে।”
তবে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতমার বেন-গভির বলেছেন, তিনি কারাগারের কর্মীদের আচরণে “গর্বিত”। তাঁর ভাষায়, “ওদের উচিত কেটসিওতের পরিবেশটা ভালোভাবে অনুভব করা, যেন ভবিষ্যতে আর কখনো ইসরায়েলের দিকে না আসে।”
স্পেনের কর্মী ও আইনজীবী রাফায়েল বোরেগো রয়টার্সকে বলেন, “আমরা কেউ পুলিশ ডেকেই ফেললে সাতজন বা তার বেশি সশস্ত্র ব্যক্তি বন্দুক তাক করে ঘরে ঢুকত, কুকুর প্রস্তুত থাকত আক্রমণের জন্য, এবং আমাদের মেঝেতে টেনে ফেলা হতো। এমনটা প্রতিদিনই ঘটেছে।”
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা জানায়, অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তর (ডিএফএটি) তাদের এক সদস্যের পরিবারকে জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি নৌযান আটকানোর সময় হামলার শিকার হয়ে কাঁধ ও পাঁজরে আঘাত পান। পরবর্তীতে কারাগারেও তাঁকে মারধর, চড় ও গালাগালি করা হয়, পরিষ্কার পানি দেওয়া হয়নি এবং রাতে প্রহরীদের চিৎকারে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি।
বার্সেলোনার সাবেক মেয়র আদা কোলাউ বলেন, স্পেনে ফেরার পর তিনি দেখেছেন, তাঁর সেলের পাশের কারাগারের দেয়ালে এক বিশাল ছবি টানানো—ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা শহরের ছবি, তাতে আরবি ভাষায় লেখা “নতুন গাজায় স্বাগতম।” তিনি বলেন, “এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, এটা এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের কারাগার।”
ইতালীয় সাংবাদিক লোরেঞ্জো দ’আগোস্তিনো বলেন, “আমাদের মধ্যে কেউ কেউ জরুরি ওষুধের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ইসরায়েলিরা তা উপেক্ষা করেছে। আমরা প্রতিবাদ করলে তারা দাঙ্গা-বিরোধী পোশাক পরে আসে, কুকুর ছেড়ে দেয়, আর বন্দুকের নিশানা আমাদের মাথায় ধরে।”
তিনি আরও বলেন, “তারা আমাদের জামা খুলে নেয়, কেফিয়াসহ ফিলিস্তিনি প্রতীকের জিনিস মাটিতে ফেলে পায়ে পিষে দেয়।”
দ’আগোস্তিনো এবং অন্য কয়েকজন বলেন, গ্রেটা থুনবার্গকে অন্যদের চেয়ে আরও কঠোরভাবে আচরণ করা হয়। “আমি নিজ চোখে দেখেছি, সৈন্যরা তাঁর ওপর ইসরায়েলি পতাকা ঢেলে সেলফি তুলছিল। গ্রেটা সাহসী ও দৃঢ়চেতা, কিন্তু বন্দিদশায় তাঁকে গভীরভাবে ভীত দেখাচ্ছিল,” বলেন তিনি।
‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর হাতে পাওয়া সুইডেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ইমেইলে নিশ্চিত করা হয়েছে, থুনবার্গকে “পতাকা ধরে রাখতে বাধ্য করা হয়েছিল” এবং তাঁকে এমন এক সেলে রাখা হয়েছিল যেখানে “বিছানার পোকায় ভরা, খাবার ও পানি খুব অপ্রতুল”।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ “অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন” বলে দাবি করেছে এবং জানায়, “থুনবার্গ নিজেই এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেননি, কারণ এসব কখনো ঘটেনি।”
এই কর্মীসহ বিভিন্ন দেশের ৭০ জনেরও বেশি ব্যক্তি সোমবার ইসরায়েল ছেড়ে এথেন্সে পৌঁছান। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল অন্তত ১৭০ জন কর্মীকে বহিষ্কার করেছে। স্পেনের ৪৯ নাগরিকের শেষ দলটিও সোমবার দেশে ফেরার কথা ছিল।
গ্রিসের ২৭ নাগরিক—এর মধ্যে বামপন্থী সংসদ সদস্য পেটি পার্কাও আছেন—তাঁরাও সোমবার রাতে দেশে ফেরার কথা, গ্রিস সরকার দক্ষিণ ইসরায়েলের এলাত-রামন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাদের আনতে বিশেষ চার্টার ফ্লাইট পাঠাচ্ছে।
তবে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থানে ধীরগতি রাখায় গ্রিসের মধ্য-ডানপন্থী সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিরোধী দল ও বন্দি কর্মীদের পরিবার অভিযোগ করেছে, প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোটাকিস দুই দেশের “কৌশলগত জোট” রক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
গ্রিসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার ইসরায়েলের কাছে “লিখিত প্রতিবাদ” জানায় এবং দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও নাগরিকদের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানায়। তবে সমালোচকেরা বলেন, এটি এসেছে কেবল বন্দিদের পরিবারগুলোর অভিযোগের পর।
বেন-গভিরের নাম না নিয়েও মন্ত্রণালয় ইসরায়েলি মন্ত্রীর “গ্রিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অগ্রহণযোগ্য ও অনুপযুক্ত আচরণ” এর নিন্দা জানিয়েছে।
এদিকে, নতুন একটি ফ্লোটিলা তুরস্ক থেকে রওনা দিয়েছে, যা বর্তমানে গাজা উপকূল থেকে প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে। এতে প্রায় ২৫০ জন চিকিৎসক, নার্স ও সাংবাদিক রয়েছেন এবং জাহাজটি একটি ভাসমান হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।