বিবিসি বাংলা: গাযা ভূখন্ডে ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি সেনা বাহিনীর মধ্যে হামলা পাল্টা হামলা তীব্র আকার নিয়েছে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে পরিস্থিতি “একটা পূর্ণাঙ্গ মাত্রার” যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস ৩৮ ঘন্টা ধরে এক হাজারের ওপর রকেট ছুঁড়েছে বলে জানাচ্ছে ইসরায়েল। তারা বলছে বেশির ভাগ আক্রমণ হয়েছে তেল আবিবের ওপর।
ইসরায়েলও ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা চালিয়েছে। মঙ্গলবার চালানো ইসরায়েলি হামলায় গাযার দুটি উঁচু টাওয়ার ব্লক বিধ্বস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলের বেশ কিছু শহরে ইসরায়েলি আরবরা সহিংস বিক্ষোভ করেছে।
তেল আবিবের কাছে লড শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন চলমান সহিংসতায় তিনি “গভীরভাবে উদ্বিগ্ন”।
ছয়জন ইসরায়েলি মারা গেছে এবং গাযায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে সোমবার থেকে সেখানে হামলায় এ পর্যন্ত ১৪টি শিশু সহ মোট ৫৩ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরো ৩০০ জনেরও বেশি।
সবশেষ ঘটনায় মারা গেছে একজন ইসরায়েলি নাগরিক। গাযা ভূখন্ডের উত্তরাঞ্চল থেকে ছোঁড়া একটি ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সীমান্ত এলাকায় একটি জিপে আঘাত করলে ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। আহত হয়েছে আরও দুজন।
জেরুসালেমের একটি এলাকায় ইসরায়েলি পুলিশ এবং ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের জেরে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বিরাজ করার পর এই লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছে। ওই এলাকা মুসলিম এবং ইহুদি দুই ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র।
ফিলিস্তিনি চিকিৎসা কর্মীরা জেরুসালেমের পুরনো শহরে লায়নস গেইটে স্ট্রেচারে করে একজন আহতকে নিয়ে যাচ্ছেন ।
ফিলিস্তিনি চিকিৎসকরা বলছেন সংঘর্ষের পর বহু ফিলিস্তিনিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। ফিলিস্তিনি চিকিৎসা কর্মীরা জেরুসালেমের পুরনো শহরে লায়নস গেইটে স্ট্রেচারে করে একজন আহতকে নিয়ে যাচ্ছেন ।
গাযায় ‘যা ঘটছে তা অবিশ্বাস্য’
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে ২০১৪র পর এটাই দু পক্ষের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র গোলাগুলি বিনিময়ের ঘটনা।
গাযা লক্ষ্য করে যে ১,০৫০ রকেট এবং মর্টার শেল ছোঁড়া হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ৮৫০টি হয় ইসরায়েলের ভেতরে গিয়ে পড়েছে নয়ত ইসরায়েলের আয়রন-ডোম নামে আকাশপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেগুলোকে প্রতিহত করেছে। বাকি ২০০টি গাযার সীমান্ত পার হতে পারেনি এবং গাযার ভেতরেই পড়েছে বলে জানাচ্ছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ।
শহরের ভিডিও ফুটেজে রাতের আকাশ চিরে রকেটের আগুন দেখা যাচ্ছে। কোন কোন রকেট ইসরোয়েলের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আকাশে বিস্ফোরিত হতেও দেখা গেছে।
ফিলিস্তিনি মিসাইল ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কাবু করতে যখন ঘনঘন ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছিল, তখন তেল আবিব, আশকেল, মদিইন এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় বিয়ারশেবা-সহ যেসব শহরকে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে সেখান থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ এবং বিমান হামলার সাইরেন সঙ্কেতের শব্দ শোনা যায়।
জেরুসালেম পোস্ট পত্রিকার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা আনা আহরনহেইম বিবিসিকে বলেন: “রকেট হামলা ঠেকাতে শ’য়ে শ’য়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা আক্রমণ এবং আমাদের আশেপাশে রকেট আঘাত হানার আওয়াজ ছিল রীতিমত ভয়াবহ।”
জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করবে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা, এ রকম হুমকির কারণে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ার জের ধরে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত
গাযায় দুটি বহুতল ভবন ইসরায়েল গুঁড়িয়ে দেয়ার পর রকেট হামলার তীব্রতা বেড়ে যায়। ইসরায়েল বলছে তারা গাযায় রকেট নিক্ষেপ করার স্থানগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তাদের বক্তব্য গাযা নিয়ন্ত্রণকারী হামাস গোষ্ঠী রকেট ছোঁড়ার জন্য উঁচু ভবন, আবাসিক ভবন এবং অফিস ভবনগুলো ব্যবহার করছে।
হামাস বলেছে, “শত্রু পক্ষ আবাসিক ভবনগুলো টার্গেট করায়” তারা ক্ষুব্ধ।
জঙ্গী বিমান হামলা চালানোর আগে এই ভবনগুলো থেকে মানুষদের চলে যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে তার পরেও বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
গাযায় সাংবাদিক ফ্যাডি হানোনা টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করে দেখিয়েছেন কীভাবে বুধবার সকালে গাযায় একটার পর একটা বিস্ফোরণ হয়েছে।
“যা ঘটছে তা অবিশ্বাস্য,” তিনি বলেছেন। “আজ সকালে আমাদের যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা গত তিনটি যুদ্ধের সময় আমরা যেধরনের অবস্থার মধ্যে কাটিয়েছে তার থেকেও ভয়ানক যুদ্ধাবস্থা।”
গাযা ভূখন্ড থেকে ছোঁড়া রকেট প্রতিহত করার জন্য ইসরায়েল তাদের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে মিসাইল ধ্বংস করে
গাযা ভূখন্ড থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া রকেট প্রতিহত করতে ইসরায়েল তাদের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে মিসাইল ধ্বংস করে
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই পক্ষকেই উত্তেজনা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত টোর ওয়েন্সল্যান্ড বলেছেন দু পক্ষেই “পরিস্থিতি পুর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে”।
মহাসচিব মি. গুতেরেস “শান্তি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়াস দ্বিগুণ করার” আহ্বান জানিয়েছেন।
আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, তবে ফিলিস্তিনের মানুষেরও নিরাপত্তা ও নিরাপদে থাকার অধিকার আছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গাঞ্জ বলেছেন ইসরায়েলি আক্রমণ “সবে শুরু হয়েছে”।
তিনি বলেছেন: “সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানা হয়েছে, এবং ইসরায়েলের ওপর হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাদের ওপর আঘাত অব্যাহত রাখা হবে।
“দীর্ঘমেয়াদে শান্তি ফিরিয়ে আনা হবে,” তিনি বলেন।
হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ে এক টিভি ভাষণে বলেছেন, “যদি ইসরাইল সংঘাত তীব্রতর করতে চায় আমরা তার জন্য তৈরি আছি। আর তারা যদি থামতে চায় , তার জন্যও আমরা তৈরি।”
ইসরায়েলের লড শহরে ইসরায়েলি আরবদের বিক্ষোভ পুরো মাত্রার দাঙ্গায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুঁড়তে থাকে এবং পুলিশ জবাবে স্টেন গান চালায়।
সংঘর্ষে ৫২ বছর বয়সী এক বাবা এবং তার ১৬ বছরের কন্যা নিহত হয়। একটা রকেট এসে তাদের গাড়িকে আঘাত করলে তারা মারা যায়। ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারিৎজ-এর খবরে বলা হয় সংঘর্ষে আহত হয়েছে আরও প্রচুর মানুষ।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামন নেতানিয়াহু লড শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন মঙ্গলবার রাতে। ১৯৬৬ সালের পর এই প্রথম সরকার আরব সম্প্রদায়ের ওপর জরুরি আইন প্রয়োগ করল বলে জানাচ্ছে টাইমস অফ ইসরায়েল পত্রিকা।
মি. নেতানিয়াহু শহরে শান্তি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাতে সেখানে গেছেন। তিনি বলেন প্রয়োজনে তিনি কারফিউ জারি করবেন।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে শহরে ইহুদিদের প্রার্থনাস্থল সিনাগগ এবং দোকানে আগুন দেয়া হয়েছে। রয়টার্স সংবাদ সংস্থা খবর দিয়েছে একজন আরব বাসিন্দা তার গাড়ি নিয়ে বের হলে তাতে পাথর ছোঁড়া হয়েছে।
লড শহরের মেয়রকে উদ্ধৃত করে টাইমস অফ ইসরায়েল বলছে, “সেখানে পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে”। তিনি বলেছেন, “লড-এ গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেছে।”
ইসরায়েলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কেন্দ্র বেন গুরিয়ান বিমানবন্দর থেকে মঙ্গলবার বিমান চলাচল কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়।
ইসরায়েলের যেসব শহরে বড় আরব জনগোষ্ঠী বসবাস করেন সেসব শহর এবং পূর্ব জেরুসালেম এবং পশ্চিম তীরেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।
বিবিসির মধ্য প্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক জেরেমি বোওয়েন বলছেন পরিস্থিতি বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে এবং ইসরায়েল পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে গাযায় সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত বিবেচনা করতে পারে।
তিনি বলছেন যুদ্ধবিরতি এখন আসতে পারে একমাত্র বাইরের হস্তক্ষেপে, সম্ভবত সবচেয়ে ভাল ফল আসতে পারে মিশর হস্তক্ষেপ করলে।
মি. বোওয়েন বলছেন ইসরায়েলের নাগরিকদের বিশ শতাংশ আরব। যেসব শহরে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিরা পাশাপাশি বাস করেন সেসব শহরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং সম্পদের ওপর হামলায় উদ্বেগ বাড়ছে।
সহিংসতার পেছনে কারণ
পূর্ব জেরুসালেমে পাহাড়ের ওপর পবিত্র একটি স্থানে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পুলিশের মধ্যে কয়েকদিন ধরে সহিংসতা বৃদ্ধির জেরেই ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে এই সংঘাত শুরু হয়।
এই স্থানটি মুসলিম এবং ইহুদি দুই ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র। মুসলিমদের কাছে এটি হারাম আল-শরিফ এবং ইহুদিদের কাছে এটি টেম্পল মাউন্ট।
হামাসের দাবি ইসরায়েল সেখান থেকে এবং নিকটবর্তী মূলত আরব অধ্যুষিত শেখ জারাহ থেকে পুলিশ সরিয়ে নিক। সেখান থেকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে চায়।
হামাস এই পদক্ষেপ বন্ধ করার যে আলটিমেটাম দিয়েছিল, ইসরায়েল তা উপেক্ষা করলে হামাস রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
জেরুসালেমের পবিত্র স্থাপনাগুলো
পূর্ব জেরুসালেমে পুলিশের সাথে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলা উপর্যুপরি সংঘাতের ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ক্রমশই বাড়ছিল। এপ্রিলের মাঝামাঝি রমজান শুরু হবার সময় থেকেই এই উত্তেজনা শুরু হয়।
এরপর শেখ জারাহ-র কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারের ভাগ্য নিয়ে আদালতের প্রত্যাশিত রায় এই ক্ষোভের আগুনে ইন্ধন যোগায়।
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা জেরেমি বোওয়েন বলছেন দশকের পর দশক ধরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধের মূলে যেসব কারণ, সেগুলোর কোনো সমাধান এতদিনেও হয়নি বলেই ঘুরে ফিরে এই সংঘাত ঘটে।
তিনি বলেন, “এবারের সংঘাতের কেন্দ্রে জেরুসালেম। রমজানের সময় পুলিশের বাড়াবাড়ি এবং আদালতের মাধ্যমে কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উৎখাতের বিতর্কিত একটি তৎপরতা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দফার এই বিরোধ।”
বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে যে ইসারায়েলি দক্ষিণপন্থীরা জেরুসালেম থেকে ছলেবলে তাদের উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর, এবং শেখ জারাহ থেকে ঐ পরিবারগুলোকে বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত সেই ছকেরই অংশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।