১৯শে মার্চ, বৃহস্পতিবার। রাত ৯.৩৫/৪০ মিনিট। ডেটলাইন ফার্মগেট, কাওরান বাজার। যারা নিয়মিত এ পথের যাত্রী তাদের কাছে একেবারেই অচেনা। এই সময়টা সব সময়ই এখানে ভিড় লেগে থাকে। পরিবহন এবং মানুষের। বিশেষ করে ফার্মগেটে রীতিমতো লড়াই চলে যাত্রীদের মধ্যে। কে কার আগে উঠতে পারবেন।
চালক আর তার সহযোগীরা চেষ্টা চালান কী করে আরেকটু জায়গা বের করা যায়। বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে এমন দৃশ্যের। অথচ এদিন তার কিছুই দেখা গেল না। লোকজন নেই বললেই চলে। গাড়ি আছে। তবে বেশির ভাগই ব্যক্তিগত। ২০শে মার্চ, শুক্রবার। ঘড়িতে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। রোগী-সঙ্গীদের বেশির ভাগের মুখেই মাস্ক পরা। টিকিট কাউন্টারে লাইন নেই। একজন রোগী ১০ টাকায় টিকিট কাটার পর তাকে পরামর্শ দেয়া হলো এক নাম্বার কক্ষে যাওয়ার। সে কক্ষের সামনে ছোট লাইন। যাদের মুখে মাস্ক নেই তাদের বলা হলো মাস্ক নিয়ে আসার। না হয় চিকিৎসক দেখবেন না । কক্ষে ঢুকামাত্র চিকিৎসক সমস্যা শুনলেন। পরামর্শ দিলেন মেডিসিন বিভাগে যাওয়া জন্য। মেডিসিন বিভাগে প্রবেশমাত্রই কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসক খুব উদ্বেগের সঙ্গে ইশারা করলেন দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য। সবার মধ্যেই কেমন যেন আতঙ্ক। দূর থেকেই জানতে চাইলেন কী সমস্যা। বলার পর নির্ধারিত ফরমে ওষুধ লিখে দিলেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, করোনার কারণেই চিকিৎসকদের মধ্যে এ উদ্বেগ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক এরই মধ্যে হোম কোয়ারেন্টিনে গেছেন। জানানো হয়েছে, তাদের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন, এমন ৩-৪ জনের পরবর্তী সময়ে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে। এটাও বলা হচ্ছে, অনেক হাসপাতালেই চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নেই।
ইতিহাসের শহর ঢাকা। চারশ’ বছরের ইতিহাসে নানা ঘটনার সাক্ষী এ শহরের মানুষ। ২৫শে মার্চের ভয়াল কাল রাত দেখেছেন এমন অনেক মানুষ আজো বেঁচে আছেন। লাশ আর লাশ, আগুন আর আগুন। যারা বেঁচে ছিলেন তারাও ছিলেন নরকে। যে যেভাবে পারেন পালিয়েছেন। পালাতে না পারারা ছিলেন নিজ বাসায় বন্দি। সেই অন্ধকার দিনগুলোতেও মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা অভয় দিয়েছিলেন ঢাকার মানুষকে। অন্ধকার শেষে আলোর দেখা মিলেছিল। নানা রোগে, দুর্বিপাকে মানুষের মৃত্যুর মিছিলও নতুন নয় এই ভূমে। কিন্তু করোনা সম্ভবত একেবারে অভিনব এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে বাংলাদেশকে। এই পরীক্ষার মুখোমুখি এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশ, মহানগর। দুনিয়ার মেগাসিটিগুলো এখন রীতিমতো মৃত। আতঙ্কগ্রস্ত কোটি কোটি মানুষ বন্দি তাদের ঘরে। কেউবা ছুটছেন কিন্তু কোথায় যাবেন জানেন না। সিনেমা কিংবা কল্পকাহিনীর কালরাত পৃথিবীতে এসে গেছে। শুরুটা উহানে। এরপর ছোট্ট ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায়। গ্লোবাল ভিলেজ আজ ছিন্নভিন্ন। কোনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধান একে বলছেন, মেডিকেল ওয়ার। কেউ বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকট। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ইতালির মতো উন্নত দেশ তার নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা দিতে পারছে না। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে মানুষ।
জানিয়ে রাখা দরকার, বাংলাদেশে অনেকেই সংকটের গুরুত্ব বুঝে ওঠতে পারেননি। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হলেও কেউ কেউ রীতিমতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ আবার বিয়েও করছেন। কোয়ারেন্টিনে থাকা কাউকে দেখতে আসছেন গ্রামবাসী। একদিকে এমন পরিস্থিতি। অন্যদিকে, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাও দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পর অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঢাকার রাস্তায় মানুষের দেখা মিলছে কম। করোনা নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু অনেকেই বলছেন, এসব যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই আতঙ্কগ্রস্ত। তাদের এই পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে ট্রেনিং এবং সুরক্ষা সামগ্রীর ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ আসছে।
বিপন্ন সময়। মানুষ তার নিজ হাতকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সংকটের দিনগুলোতে মানুষকে মানুষের কাছে থাকতে বলা হয়। কিন্তু এ এমন এক মহাবিপদ, মানুষকে মানুষ থেকে দূরে রাখতে হয়। এই দুঃসহ সময়েও ভালোবাসার কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। কোনো বিশেষ শ্রেণি, জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি যেন বিদ্বেষ না ছড়াই। চিকিৎসা নির্দেশনা যেন মেনে চলি। প্রিয়জনকে যেন সহায়তা করি নির্দেশনা মেনে চলতে। আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা। আগেই বলেছি, পরীক্ষার মুখোমুখি দুনিয়া। সব জায়গায় কেবল ইয়া নাফ্সি, নাফ্সি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি কবে শেষ হবে?
সুত্র: মানবজমিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।