শীতকালে রাজধানীতে দিব্যি ফুলহাতা শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু মাত্র ৬ ঘণ্টা ভ্রমণ করে দিনাজপুর বা পঞ্চগড়ে গেলে শুধু শার্ট কেন, জ্যাকেট পড়েও শীত মানানো কঠিন হয়ে যাবে। আরেকটু এগিয়ে যদি নেপাল বা ভুটানে চলে যান, তাহলে তো কথাই নেই। শীত কাকে বলে সেটা বুঝতে পারবেন হাড়ে হাড়ে।
আরেকটু এগিয়ে চীন বা ইউরোপের মধ্যে ঢুকে গেলে সাধারণ কাপড়ে আর শীত মানবে না। পড়তে হবে মোটা, লম্বা ঝুলওয়ালা ওভারকোট। কিন্তু কেন? সূর্য থেকে লাখ লাখ মাইল দূরে থাকা ছোট্ট বিন্দুর মতো গ্রহের বিভিন্ন জায়গার তাপমাত্রা ভিন্ন হওয়ার কারণ কী?
শীতকাল কেন আসে তা আমরা কমবেশি জানি। সূর্যের চারপাশে বছরে একবার চক্কর দিচ্ছে পৃথিবী। পাশাপাশি চলার পথে নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘোরে লাটিমের মতো। খুব ভদ্রভাবে যে ঘোরে এমনটা বলার সুযোগ নেই। লাটিম পড়ে যাওয়ার আগে যেমন একটু দোল দেয়, নিজ অক্ষে পৃথিবীর ঘোরার সময় সেরকম এদিক ওদিক দোলে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ ২৩.৫ ডিগ্রি সূর্যের বিপরীতে হেলে থেকে।
ফলে উত্তর গোলার্ধে সূর্যের আলো তীর্যকভাবে পড়ে। উত্তর গোলার্ধ জুড়ে চলে শীতকাল। এমনকি বিষুব অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে আগালেও শীত বাড়ে। সেটাও ওই সূর্যের কারণে। পৃথিবীর অক্ষরেখার (Latitude) ভিত্তিতে তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হয়। উত্তর মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলে সূর্যের কিরণ বেশি তীর্যকভাবে পড়ে, ফলে শীতকালে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা অত্যন্ত কমে যায়। অন্যদিকে নিরক্ষীয় বা বিষুবীয় অঞ্চলে সূর্যের কিরণ সরাসরি পড়ে বলে সেখানে শীতকালেও তুলনামূলক উষ্ণতা বজায় থাকে।
তবে নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থানভেদে শীতের তীব্রতা কম-বেশি কেন হয়, তা সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের আরও কিছু বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের দূরত্ব, জলবায়ু ইত্যাদি। প্রথমে ভূতাত্ত্বিক অবস্থার কথা বলা যায়। আমরা জানি পৃথিবীর পৃষ্ঠ সমতল নয়। এখানে যেমন সমুদ্র, নদ-নদী ও গিরিখাত আছে, তেমনি আছে বিশাল সব পাহাড়-পর্বত এবং মালভূমি। সমুদ্র বা গিরিখাতের প্রসঙ্গে পরে আসছি। উঁচুভূমি সম্পর্কে বলা যাক।
তাপমাত্রার সঙ্গে উঁচুভূমি বা উচ্চতার সম্পর্ক ঠিক উল্টো। ভূমি থেকে যত ওপরে যাওয়া হয় তত কমে তাপমাত্রা। পাহাড়ি এলাকায় তাপমাত্রা সমতল ভূমির চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম হয়। কারণ, সমুদ্রপৃষ্ঠ ও ভূপৃষ্ঠ সরাসরি সূর্যের তাপ গ্রহণ করে ওপরের দিকে ফেরত পাঠায়। পৃথিবীর মাটি বায়ুমন্ডলের জন্য অনেকটা চুলার মতো কাজ করে। এই চুলার যত ওপরে ওঠা যাবে, তত কমতে থাকবে তাপের পরিমাণ। এ কারণে হিমালয়সহ বড় বড় পর্বতমালার চূড়ায় গ্রীষ্মকালেও প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। একই কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশি হয়।
স্থলভাগের আবহাওয়া কেমন হবে তা অনেকটা নির্ভর করে সাগরের ওপর। সমুদ্রের পানি এর আশেপাশের অঞ্চলের তাপ শোষণ করে ও নিঃসরণ করে। ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে তাপমাত্রা খুব একটা ওঠানামা করে না। অন্যদিকে স্থলভাগ সমুদ্রের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয় সূর্যের আলোতে। আবার রাতে খুব দ্রুত তাপ নিঃসরণ করে। ফলে সমুদ্র থেকে দূরের অঞ্চলে দিন-রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান অনেক বেশি হয়। এসব এলাকায় বেশি হয় শীত বা গরমের তীব্রতা।
অঞ্চলভেদে শীতের তীব্রতা কমবেশি হওয়ার আরেকটা বড় কারণ বায়ুপ্রবাহ। উত্তর গোলার্ধে মেরু অঞ্চলের ঠান্ডা বায়ু দক্ষিণ দিকে সরে এসে স্থলভাগের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে হিমালয় থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসের কারণে শীতকালে হঠাৎ নেমে যায় তাপমাত্রা। তৈরি হয় শৈত্যপ্রবাহ।
এছাড়া কৃষি জমি, বনাঞ্চল এবং শহুরে অঞ্চলে আবহাওয়ার ভিন্নচিত্র দেখা যায় পরিবেশগত কারণে। উদাহরণ হিসেবে আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্টের কথা বলা যেতে পারে। শহরের জনসংখ্যা, শিল্পকারখানা, যানবাহন ইত্যাদি বনাঞ্চল বা গ্রাম অঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকে। কম থাকে গাছপালার পরিমাণ। ফলে শহর অঞ্চলে উত্তপ্ত আবহাওয়া বিরাজ করে। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট। শহরে শীত কম হওয়ার এটি একটি কারণ।
এছাড়া আবহাওয়াগত আরও নানান ঘটনার কারণে একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শীতের তীব্রতা কম বেশি হয়। ঢালাওভাবে একক কোনো কারণ বলার সুযোগ নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং ভৌগোলিক কারণেই শীতের এমন তারতম্য দেখা যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।