জুমবাংলা ডেস্ক : টিনের তৈরি এক চালা খোলা ঘর। চারপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। কাছেই বড় ভাইয়ের পাকাঘর। কিন্তু ভাইয়ের ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি। তাঁকে শিকল ও দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল খোলা ঘরটিতে। সেখানে তিনি রোদে পুড়েছেন। বৃষ্টিতে ভিজেছেন। শীতে কষ্ট করেছেন। খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। স্বামী-সন্তান সবাই থাকলেও কেউই খোঁজ নেয়নি তাঁর। এভাবেই শেকলবন্দি অবস্থায় তাঁর জীবন থেকে কেটে গেছে ১২টি বছর। স্বজনদের অযত্নে আর অবহেলায় মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন। মানসিক ভারসাম্যহীন হতভাগ্য ওই নারীর নাম হাবিবুন নেছা (৫৮)। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের জফরপুর গ্রামে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর একটানা প্রায় একযুগ ধরে শেকল বন্দিজীবনের অবসান হয়েছে। স্থানীয়ভাবে খবর পেয়ে বড়লেখা থানার ওসি মো. ইয়াছিনুল হক তাঁকে শেকলমুক্ত করেছেন। এরপর তাঁকে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। নেন চিকিৎসার দায়িত্বও।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাবিবুন নেছা বড়লেখা সদর ইউনিয়নের জফরপুর গ্রামের মুহিবুর রহমানের স্ত্রী। স্বামীর সংসারে তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বিয়ের প্রায় ৭-৮ বছর পর হঠাৎ হাবিবুনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর স্বামী মুহিবুর রহমান আরেকটা বিয়ে করে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করেন। এ অবস্থায় স্বামীর সংসারে বেশ কয়েক বছর অযত্নে আর অবহেলায় ছিলেন। ছেলে-মেয়েরাও কোনো খবর নেয়নি। এ অবস্থায় আনুমানিক ১৪ বছর আগে হাবিবুন নেছাকে বাড়ি নিয়ে যান বড় ভাই ইসলাম উদ্দিন। সেখানে তাঁর দেখাশোনা করেন। বছর দেড়েক ভালো ছিলেন। আবার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন তিনি। এরপর শেকল ও দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। দীর্ঘদিন এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করলেও খোঁজ নেননি স্বামী। এমনকি নিজের ছেলে-মেয়েরা বড় হলেও মায়ের খবর রাখেনি। খোলা ঘরে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজেই পার হয়েছে তাঁর একযুগ। মানসিক ভারসাম্যহীন থাকায় তাঁর কষ্টের যন্ত্রণার এই কথাগুলো কাউকে বলতে পারেননি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্থানীয়ভাবে খবর পান বড়লেখা থানার ওসি। মর্মান্তিক এ ঘটনা তাঁর হৃদয়ে নাড়া দেয়। দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার করেন শেকলবন্দি হাবিবুন নেছাকে। ওই বাড়িতে তাঁকে গোসল করান। খাবার দেন। খাবার শেষে হাবিবুন নেছাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন ওসি। সেখানে নিজ দায়িত্বে ভর্তি করান। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ফলমূল কিনে দেন। দেখা শোনার জন্য দুইজন নারী পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দেন তিনি।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাবিবুন নেছার চিকিৎসা চলছে। তাকে ঘিরে রয়েছে মানুষজন। দীর্ঘদিন খেতে না পেয়ে শরীরে সব হাড় বেরিয়ে গেছে। কঙ্কালসার হাবিবুন নেছা শুধু ফেল ফেল করে তাকিয়েই আছেন। কথা বলতে গিয়ে দুর্বল শরীরের কারণে কোনো কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। সবাইকে কাছে পেয়ে তাঁর মুখে যেন হাসি ফুটেছে।
হাবিবুন নেছার বড় ভাই ইসলাম উদ্দিন বলেন, বিয়ের ৭-৮ বছরের মধ্যেই ছোট বোনের মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি সুস্থ হননি। স্বামী ও ছেলে-মেয়েরা খোঁজ-খবর নেয় না। ভাগ্না নাজিম উদ্দিন ও আলা উদ্দিন বিয়ে করেছে। তাদের ফার্নিচারের ব্যবসা রয়েছে। তারা মায়ের কোনো খোঁজই রাখে না।
ময়লা-আবর্জনার মধ্যে একজন মানুষকে বেঁধে রাখা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুলে দিলে মানুষকে মারধর করেন। উধাও হয়ে যান। এজন্য এভাবে বেঁধে রেখেছেন।
এ ব্যাপারে বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক বলেন, ‘ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে আমরা শোনেছি। এরপর সেখানে দ্রুত যাই। গিয়ে দেখি এক এক চালা খোলা একটি ঘরে হাবিবুন নেছাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। এটি অনেকটা খুঁপড়ি ঘরের মতো। এর কাছেই ভাইয়ের ঘর পাকা ঘর ছিল। অথচ সেখানে তাঁকে না রেখে নোঙরা স্থানে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। স্বামী ও সন্তান থাকলেও কেউ খোঁজ নেয়নি তাঁর। একজন মানুষকে প্রায় ১২ বছর ধরে নোঙরা স্থানে এভাবে বেধে রাখা অত্যন্ত অমানবিক। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। তাঁর চিকিৎসার সব দায়-দায়িত্ব নিয়েছি। দেখে তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তাঁর স্বামী-সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।