ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: ৭ মার্চের ভাষণটিকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আর দিনটি এখন বাংলাদেশের জাতিয় দিবসগুলোর অন্যতম। মার্চ বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারে অন্যতম আলোচিত এবং ঘটনাবহুল একটি মাস। এ মাসেই ৭, ১৭, ২৫ আর ২৬-এর মতো তারিখগুলো, যে দিনগুলোকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে চিন্তাও করা যায় না। এ কারণে মার্চ এলেই ৭ মার্চের আগে পরে আমাদের লেখায়, বলায় আর আলোচনায় ঘুরে-ফিরে বারবার ফিরে আসে ৭ মার্চ।
আমাদের এবারের ৭ মার্চে প্রেক্ষাপটটা একেবারেই অন্যরকম। এই ৭ মার্চে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে তার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের। স্বাধীন দেশে হিসেবে বাংলাদেশের বন্ধুর পথ চলায় ৭ মার্চ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের স্বাক্ষী। ছিয়াত্তরে এই ৭ মার্চেই ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে যেমন অনুষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশ, তেমনি ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর ৭ মার্চকে ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের উল্লসিত উপস্থিতির স্বাক্ষীও ৭ মার্চ। তবে এবারের ৭ মার্চের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের ঠিক আগে আগে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র পেয়েছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আমরা পেয়েছিলাম স্বল্পোন্নত দেশের মার্যাদা, আর ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তির প্রথম ধাপটি সাফল্যের সাথে পার হয়েছিল। সে সময় মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ আর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা এই তিনটি মাপকাঠিতেই উত্তীর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশ। এ তিনটি বছর পর জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) আবারো মূল্যায়নে বসে আমাদের অর্জনগুলোর এবং আবারও সাফল্যের সাথে উতরে যায় বাংলাদেশ। সিডিপির বিবেচনায় আমাদের মাথাপিছু আয় ১২৩০ মার্কিন ডলার হলেই চলতো আর আমরা সেখানে অর্জন করেছি ২০৬৪ ডলার।
মানবসম্পদ সূচকে আমাদের অর্জন ৭৫.৪, অথচ প্রয়োজন ছিল ৬৬। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে মানদণ্ডটি রাখতে হতো সর্বোচ্চ ৩২। আমরা তা নামিয়ে এনেছি ২৭-এ। সিডিপির এই সুপারিশটি আগামী সেপ্টেম্বরে যাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। এর পাচটি বছর পর ২০২৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হব। আমি অর্থনীতিবিদ নই। অর্থনীতির কঠিন হিসেব-নিকেশগুলো আমার কাছে অনেক বেশি দুর্বোদ্ধ। তারপরও আমি যতোটুকু বুঝি এই অর্জন মোটেও সহজসাধ্য কিছু ছিল না। বিশেষ করে এই করোনাকালে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘জীবনের পাশাপাশি জীবিকাকে সচল রাখায়’ যে অনন্য সাধারণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তার আরেকটি স্বীকৃতি সিডিপির এই সুপারিশটি।
এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক কোভিড মোকাবেলায় সাফল্যের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশ্বব্যাপি কোভিড নিয়ন্ত্রনে তার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে চিঠি দিয়েছিলেন। অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা আর খোদ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলও প্রধানমন্ত্রীকে তার কোভিড সাফল্যের জন্য আর এবারতো আসলো এই সমস্ত সাফল্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতিটি।
শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয়বারের মতন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন আমাদের জিডিপির আকার ছিল ১০৩ বিলিয়ন ডলারের মত যা তার সুযোগ্য নেতৃত্বে গত একটি যুগে বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। একই সময় আমাদের রপ্তানি আয় ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০.৫৪ বিলিয়নে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ছিল মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার, এখন তা বেড়ে ঈর্ষণীয় ৪৪ বিলিয়ন। একইভাবে শেখ হাসিনার সুনিপুন ছোয়ায় দারিদ্রের হার কমেছে প্রায় অর্ধেক। ছিল ৪৮.৯ শতাংশ আর এখন তা ২০.৫ শতাংশ। পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়ও সচেষ্ট শেখ হাসিনার সরকার। বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট আর প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্টের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। তালিকায় আছে নেপাল আর ভ‚টান। যুক্ত হতে যাচ্ছে মালদ্বীপ আর ইন্দোনেশিয়া। কৃষি আর রপ্তানিপণ্যের বহুমুখি করণ আর ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে সরকারের উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। আমাদের ইপিজেড, বেজা, বেপজা কিংবা বিশেষ টুরিস্ট অলগুলো আমাদের এই এগিয়ে চলাকে আরও গতিশীল করবে নিঃসন্দেহে।
আমাদের চোখের সামনে আমরা দেখেছি উন্নত দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া আর চীনের উত্তরণ। দেখেছি ভারতের এগিয়ে চলা। এখন আমরাও সেই পথেরই পথিক। আজ থেকে পাশটি বছর আগে এমনি এক ৭ মার্চে জাতির পিতা তার প্রথম বিপ্লবটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত ডাক দিয়েছিলেন। স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। জাতির পিতা তার দ্বিতীয় বিপ্লবকে পরিপূর্ণতা প্রদান করে দিয়ে যাওয়ার সময় পাননি। সেই কাজটি করে দেখাচ্ছেন তার কন্যা যার স্বীকৃতি এসেছে ৭ মার্চের কদিন আগে। এবারের ৭ মার্চ তাই অন্যরকম।
লেখক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ-এর সদস্য সচিব
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।