জুমবাংলা ডেস্ক : জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নিয়ে নাগরিকদের ভোগান্তির শেষ নেই। দিনের পর দিনে ইসির দরবারে ঘুরে সেবা না পেয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেকেই। পরিস্হিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অসহায় হয়ে পড়েছেন। ভুক্তভোগীদের অনেকেই এনআইডি সেবা পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছেন। তাদেরই একজন মো. রুবেল হোসেন। চাকরির কারণে বান্দরবানের লামা উপজেলায় ভোটার হন তিনি। বর্তমানে সাতক্ষীরায় ফার্মেসি ব্যবসা করেন। লাইসেন্স করার জন্য প্রয়োজন এনআইডির। তার কাছে সংরক্ষিত এনআইডি (১৯৯৩০৩১৫১৭৯০০০১১১) নিয়ে সেবা নিতে গিয়ে দেখেন এনআইডি অসম্পূর্ণ। এরপর শুরু দৌড়াদৌড়ি। ছুটে যান বান্দরবানের লামায়।
গত বছরের ১৫ মার্চ বান্দরবানের লামা উপজেলা নির্বাচন অফিসার আলমগীর হোসেন এনআইডি মহাপরিচালক বরাবর রুবেলসহ উপজেলায় পাঁচ জন ভোটারের স্ট্যাটাস ইনকমপ্লিট থাকার বিষয়টি অবগত করে পত্র দেন। তারও কোনো সমাধান হয়নি। পত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসার জানান, নিম্নোক্ত আবেদনকারীগণ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র স্ট্যাটাস ইনকমপ্লিট হওয়ায় রিএক্টিভ্যাট করার জন্য কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করেন। সংশ্লিষ্টদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিচয়পত্রে স্ট্যাটাস বিধি মোতাবেক রিএক্টিভ্যাট করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হলো।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ের সেই সুপারিশ ইসিতেই পড়ে আছে। ভুক্তভোগী নন্দবোধি শ্রামণ, মো. রুবেল হোসেন, ইছমাইল হোসেন, অপর্ণা চৌধুরী এবং মোছা. জয়নাব ছিদ্দিকা ঢাকার এনআইডি অফিসে ধরনা দিয়েও এখনো সমাধান পাননি।
এ বিষয়ে মো. রুবেল হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, উপজেলা নির্বাচন অফিসারের নির্বাচন কমিশনে পত্র দেওয়ার পর ইসিতে সমাধানের জন্য চলে আসি। এক পর্যায়ে ইসির টেকনিক্যাল বিভাগ থেকে সম্প্রতি বলা হয়, লামা নির্বাচন অফিসে গিয়ে পুনরায় ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার জন্য। আবার চলে যাই লামায়। প্রায় চার মাস ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার পরও এখনো আমার এনআইডি চালু করা হয়নি।
এনআইডি নিয়ে ভোগান্তির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেন, এনআইডি সেবাকে কেন্দ্র করে নাগরিকদের আস্হা অর্জন করতে হবে। কোনোভাবেই নাগরিকরা যাতে দুর্ভোগের শিকার না হন সে বিষয়ে তত্পর থাকতে হবে। এনআইডিতে ছোটখাটো ভুল সংশোধনে ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ নেওয়ার পক্ষে মত দেন এ নির্বাচন কমিশনার।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মাঠ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রতি মাসে এনআইডি সেবা নিতে কত আবেদন পড়েছে, সেই সঙ্গে যেসব আবেদন নিষ্পত্তি করা যায়নি তার কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ ও অসাধু কর্মকাণ্ডে ইসির কোনো কর্মী সম্পৃক্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্হা নেওয়ার কথাও জানান এ নির্বাচন কমিশনার।
২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার পর থেকে ১৩ বছরে এখনো পর্যন্ত নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথমদিকে দেওয়া অনেক তথ্যই এখন পুরাতন হয়ে গেছে, যা প্রতিনিয়ত সংশোধনে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে নাগরিকদের। নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির সেবা কার্যক্রম। ভোটার জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন এবং নতুন কার্ড মুদ্রণে মাঠের উপজেলা অফিস, জেলা অফিস, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগের (এনআইডি) কার কী ক্ষমতা তা-ও নির্ধারিত করা হয় প্রজ্ঞাপনে। তারপরও যেন ভোগান্তি কমছেই না। এসএসসি সনদধারীরা কিছুটা সেবা পেলেও যাদের কোনো সনদ নেই এনআইডি সংশোধনে বেশি বেগ পেতে হয় তাদের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যে ভরপুর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। ছবিসহ ভোটার জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের পরও বিপত্তি পিছু ছাড়ছে না ইসির। হরেক রকমের বিভ্রান্িতর খোঁজ মিলছে ভোটারের তথ্যে। তথ্যভান্ডারে কোনো কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত স্টাটাসে ম্যাডনেস, ইনকমপ্লিট, ম্যাচ নট ফাউন্ড, ম্যাচ ফাউন্ড, মৃত ভোটার, তথ্য ডিলিট প্রদর্শিত হচ্ছে। বিশেষ করে ইসির তথ্যভান্ডারে ৪ হাজার ৩০০ ম্যাডনেস ভোটারের সন্ধান মিলেছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা।
বিড়ম্বনার শেষ নেই : ভোটার হওয়ার পর জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলাসহ নানা সেবা নেন অনিতা বড়~য়া। কিন্তু অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি ভোটার হলেও তথ্যে গরমিল। এনআইডির নম্বর দিয়ে তথ্য খঁুজতে গিয়ে সংশ্লিস্ট কতৃর্র্পক্ষ দেখতে পান ‘ম্যাচ ফাউন্ড’ লেখা। আবার ফাতেমা আক্তার নিজের তথ্য দিয়ে ভোটার হলেও প্রয়োজনীয় সেবার জন্য আবেদন করতে গিয়ে দেখতে পান অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য তার সার্ভারে দেখাচ্ছে। একইভাবে মো. হাবিবুর রহমানের ছবি বদলে অপরিচিত অন্য একজন নাগরিকের ছবি দেখাচ্ছে ইসির তথ্যভান্ডারে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সংশ্লিষ্ট ভোটার আইডিতে হরেক রকমের তথ্যের অসংগতির কারণে লজ্জায় পড়ে যেতে হচ্ছে তাকে।
ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা নাহিদা আফরিন। নাহিদার ভোটার সার্ভারে লেখা ম্যাচ ফাউন্ড অর্থাৎ অন্যের তথ্য তার এনআইডিতে সংযোজিত আছে। এ নিয়ে বিব্রত সংশ্লিষ্ট ভোটার। আবার ছবি এক জনের ভোটার অন্যজন—এমন ঘটনাও রয়েছে ভোটার তালিকায়। এমনই এক জন মো. শহীদুল বারী। তিনি শুধু একা নন, গুলশান এলাকার হূদয় হোসেন ও ফাতেমা বেগম, সাবিনা বেগম ও রোজিনা আক্তার, মৌমিতা নীগার মৌনী এবং লালবাগের ফাতেমা আক্তারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ১৬ জন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা পাওয়া যায়।
১৩ বছরেও তথ্য হালনাগাদ করেনি ইসি : ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ভোটারকে লেমিনেটিং কার্ড তুলে দেওয়ার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান শুরু হয়। সর্বশেষ গত ২ মার্চের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী দেশের ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ১০ হাজার। এই ভোটারদের কমপক্ষে অর্ধেকের মতো অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত—কোনো সনদধারী নন। ১৩ বছর আগে দেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা এবং ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া শুরু হলেও এ বিষয়ে প্রদত্ত সব তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না, তা ভোটাররা আজও জানতে পারেননি। এমনকি ইসিকে তথ্য হালনাগাদের কোনো ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদর্শিত তথ্যগুলো থেকে জানা গেছে। প্রথমদিকে নেওয়া ২১ ধরনের তথ্য সঠিকভাবে লেখা হয়েছে কি না, তা জানার সুযোগ নেই। ২০১২ সাল থেকে এ বিষয়ে তথ্যের সংখ্যা আরো বেড়ে ৪১-এ পৌঁছায়। বর্তমানে ভোটারদের কাছ থেকে ৪৬ ধরনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। অশিক্ষিত ভোটারদের এনআইডিতে কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে সংশোধনে চরম বিপাকে পড়তে হয়।
এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের কয়েক জন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, গত ১৩ বছর আগে দেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮ জন নাগরিক ভোটার হয়েছেন। তাদের ব্যক্তিগত অনেক তথ্যই এ ১১ বছরে পালটে গেছে। বিশেষ করে সে সময়ের তরুণ ভোটারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বৈবাহিক অবস্হা, পেশা—এসব তথ্য স্বাভাবিকভাবেই পালটে যাওয়ার কথা। অনেকের বাবা-মায়ের মৃতু্য হয়েছে, ঠিকানা বদল হয়েছে। কিন্তু এসব তথ্য হালনাগাদ করার সুযোগ কেউ পাননি।
তদবির ছাড়া ফাইল নড়ে না : কোনো ধরনের তদবির বা যোগাযোগ না থাকলে এনআইডি সংক্রান্ত যে কোনো আবেদন বছরের পর বছর পড়ে থাকে ইসি সচিবালয়ে। ফলে সেবা পাওয়া তো দূরের কথা সংশোধনের সঙ্গে সংযুক্ত মূল এনআইডিও ফেরত পান না ভুক্তভোগীরা। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সেই সংশোধন আবেদনে যুক্ত এনআইডির প্রয়োজন হলে বিপদ বাড়ে বহুগুণ। সেক্ষেত্রে অনেকেই হারানো হিসাবে সরকারি কোষাগারে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে পূর্বের এনআইডি তুলতে হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা শিক্ষিত বা সনদধারী তাদের এনআইডিতে ভুল কম। কিন্তু যারা সনদধারী নন বা অশিক্ষিত তাদের এনআইডিতে ভুল সবচেয়ে বেশি। চার ক্যাটাগরিতে এনআইডি সংশোধন করে থাকে ইসি। কোভিড মহামারির কারণে বর্তমানে অনলাইনে এনআইডি সংশোধনের ব্যবস্হা গ্রহণ করে ইসি। কিন্তু এক জন সেবাগ্রহীতা অনলাইনে এনআইডি সংশোধন করলে স্বাভাবিকভাবে সেবা মেলে না। এনআইডি সংশোধনের জন্য তদবির করতে হয় প্রতিনিয়ত। পরিস্হিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, তদবির ছাড়া এনআইডির ফাইল নড়ে না।
স্বস্তিতে নেই ইসিও : নানান অসংগতির কারণে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্টরা স্বস্তিতে নেই। তারা বলছেন, ভোটার নিবন্ধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কারণে নাগরিকের তথ্যে এই গরমিল ও অসংগতি দেখা যাচ্ছে। কারণ দুই ধাপে ভোটার তালিকার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ ও তা লিপিবদ্ধ করা এবং দ্বিতীয় ধাপে চোখের আইরিশ, ফিঙ্গারসহ ছবি তুলে আগের তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে জাতীয় ভোটার তথ্যভান্ডারে আপলোড করা। এই আপলোডের সময় তথ্যে গরমিল হয়েছে বলে এনআইডির প্রযুক্তিবিদরা জানিয়েছেন। তারা আরো বলেন, এসব অসংগতি সংশোধনের জন্য আবেদন করলে তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই শেষে সংশোধন করে দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আরো বলেন, আর যেসব নাগরিকের সার্ভারের ডাটাবেইসে ‘ডিলিট’ লেখা শো করছে এটির মূল কারণ দুই বার ভোটার হওয়া।
জানতে চাইলে এনআইডির মহাপরিচালক কে এম হুমায়ুন কবীর ইত্তেফাককে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে নানা ধরনের অসংগতি যে রয়েছে তা আবেদন যাচাই করে পাওয়া গেছে। আমরা সবগুলো আবেদন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। যত দ্রুত সম্ভব যাতে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করা যায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। কমিশন এসব নাগরিকের বিষয়ে খুবই আন্তরিক।
সম্প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নিতে নাগরিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। কর্মকর্তাদের জনসেবা দিতে গিয়ে প্রভুর মতো আচরণ না করে সেবক হিসেবে কাজ করারও তাগিদ দেন তিনি। সিইসি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের প্র?য়োজন অপরিসীম। এনআইডিতে ভুল বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ভুল সংশোধন নিয়ে অনেকেই আসছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের সেবক হিসেবে কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে।
সূত্র : ইত্তেফাক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।