আলাউদ্দিন আরিফ : ঈদুল আজহার এখনো প্রায় এক মাস বাকি আছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন মোকামে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু বেচাবিক্রি শুরু হয়েছে। তবে দেশে এবার পর্যাপ্ত গবাদিপশুর উৎপাদন হলেও করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি ও জনসাধারণের আয় কমায় চাহিদা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার দেশে উৎপাদিত কমপক্ষে ২০ লাখ গবাদিপশু অবিক্রীত থেকে যেতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য স্থায়ী-অস্থায়ী বাজারের পাশাপাশি অনলাইনে কেনাবেচার দিকে জোর দিচ্ছেন তারা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (খামার) ড. এবিএম খালেদুজ্জামান গতকাল শুক্রবার বলেন, করোনাজনিত কারণে গবাদিপশুর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। করোনা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই খামারিরা গবাদিপশু প্রস্তুত শুরু করেন। ফলে চলতি কোরবানি মৌসুমে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি গবাদিপশু উৎপাদন হয়েছে। গত কোরবানি মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১৮ লাখের মতো। চামড়া প্রাপ্তির হিসাবে দেখা গেছে, গত বছর দেশে ১ কোটি ৬ লাখের মতো গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। অবিক্রীত থেকে গেছে ১২ লাখের মতো। এবার চাহিদা স্বাভাবিক নিয়মে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১ কোটি ১০ লাখ গবাদিপশুর চাহিদা থাকার কথা।
ড. খালেদুজ্জামান আরও বলেন, আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি এবার করোনাজনিত কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কম হওয়ায় মানুষের আয় কমেছে। প্রবাসীরাও দেশে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা কম পাঠাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ অনেকের হাতেই নগদ টাকা নেই। এর প্রভাব পড়বে কোরবানির হাটে। ফলে কোরবানির পশুর চাহিদা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কোরবানির পশুর হাট বসানোর কথা বলা হয়েছে। এজন্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২৫টি টিম কাজ করবে। এছাড়া সারা দেশের ২ হাজার ৪০০ হাটে ১ হাজার ২০০ টিম কাজ করবে।
তিনি আরও বলেন, গবাদিপশুর স্থায়ী-অস্থায়ী হাটের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অনলাইনে গবাদিপশু কেনাবেচার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি করোনা সময়ে খামারে উৎপাদিত ডিম ও মুরগি ও মাংস ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে বিক্রি হয়েছে। এতে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। কোরবানি মৌসুমেও একইভাবে গবাদিপশু বিক্রির চিন্তাভাবনা অধিদপ্তরের রয়েছে।
প্রাণিসম্পদের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা হয়। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং বিজিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন। ওই সভায় কোরবানিতে মোট গবাদিপশুর চাহিদা নিয়ে আলোচনা হয়। এবারও বিষয়টি আলোচনা হবে। সেখানে ভারতীয় বা অন্য দেশ থেকে গরু আসার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হবে এবং সীমান্ত সিল করে রাখার সুপারিশ করবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
এদিকে চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানিকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন মোকামে গবাদিপশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকার বেপারিরা মোকামে গরু কিনে নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে বিক্রি করছেন। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সড়কে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক চলতে দেখা যায়। যারা গরু কিনছেন তারাও লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি মজিবুর রহমান গতকাল বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের টেনশনের শেষ নেই। আমি নিজেও খামারি। আমার ঘরে গত বছরের গরুও রয়ে গেছে। এবার আবার নতুন করে গরু তুলেছি। করোনাজনিত কারণে একদিকে মানুষের হাতে টাকাপয়সা কম তাই মানুষ কোরবানি দিতে পারবে না। আর যাদের হাতে টাকাপয়সা আছে তারাও অনেকে কোরবানি দেবে না কারণ গরু কেনা, মাংস বানানো ও সদকার মাংসের জন্য বাসাবাড়িতে ভিড় হবে। এসব ভিড়ের কারণে ভাইরাস আরও বেশি ছড়াতে পারে। তাই লোকজন পশু কোরবানি দেবে না। ফলে চাহিদা মারাত্মকভাবে কমে যাবে। পশু ব্যবসায়ী ও খামারিরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বে।’
চাঁদপুরের মতলব উপজেলার চেঙ্গারচর গ্রামের হোসেন মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘গত নভেম্বর মাসে গাবতলী হাট থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা দামের মধ্যে ২৪টি গরু কিনেছেন মোটাতাজা করার জন্য। প্রতিটি গরুর জন্য দৈনিক গড়ে ১৫০ টাকা হারে খরচ হয়। সব মিলিয়ে গড়ে প্রতিটি গরুর পেছনে ৭০-৭৫ হাজার টাকা করে খরচই পড়ে। গরুপ্রতি ৫ হাজার টাকা লাভ করতে হলেও প্রতিটি অন্তত ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করতে হবে।’
রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর এলাকায় সওদাগর অ্যাগ্রোর মালিক আরাফাত রুবেল তার খামারে ২০টি গরু প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে আমার এখানকার দুটি গরু বিক্রি করেছি। তবে তেমন একটা লাভ হয়নি। পরিস্থিতি বুঝে অনলাইনে বিক্রি শুরু করার চেষ্টা করছি। সরকারিভাবে অনলাইনে পশুর হাটের উদ্যোগ নিলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল এলাকার সাফি অ্যাগ্রো খামারের মালিক সাফিউল আলম বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে খামারের খরচ বেড়েছে। গোখাদ্যের দাম বেড়েছে। তারপরও গতবারের চেয়ে কম দামে গরু ছাড়তে হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, করোনা আতঙ্কে ও সরকারি নির্দেশনায় মানুষ বাজারে কম যাচ্ছে। তাই দুধ ও মাংসের চাহিদা কিছুটা কমেছে। এতে কৃষক ও খামারি ক্ষতির সম্মুখীন হন। শাহজাদপুরে কোরবানিযোগ্য সাড়ে তিন লাখের মতো গরু আছে। গরুগুলো কোরবানিতে বিক্রি না হলে বড় লোকসানে পড়বেন খামারি ও কৃষকরা।
এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবার রাজধানীতে স্থায়ী ও অস্থায়ী ২৩টি হাট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনেই পশুর হাট বসবে। পশুর হাটে ভিড় এড়ানোর জন্য এক-দুই দিন আগে তাড়াহুড়ো করে পশু না কিনে সময় নিয়ে কিনতে বলা হয়েছে।
নয়াপল্টনের বাসিন্দা আহমেদ আতিক বলেন, ‘প্রতি বছরের মতোই কোরবানি দিতে চাই। কিন্তু বাজারে গিয়ে গরু কেনা, ঈদের দিন মাংস বানানো ও সদকার মাংসের জন্য যে ভিড় হবে সেটা সামাল দেওয়া মুশকিল। তাই এবার কোরবানি নাও দিতে পারি। প্রয়োজনে খাসি কিনে কোরবানি দেব, যাতে বাসায় ভিড় না হয়।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।