আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ছয় মাস ধরে চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যেই এবার পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধেও চড়ল যুদ্ধের পারদ। স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হাউজ অব কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফরকে কেন্দ্র করে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চীনের বারবার কঠোর পরিণতি ভোগের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তাইওয়ানে সফর করেছেন পেলোসি। তার এই সফর ঘিরে তাইওয়ানে চীনের সামরিক অভিযান ও পরবর্তীতে আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তবে করোনা মহামারি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের এই সময়ে চীন আদৌ যুদ্ধে জড়াবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তাও আছে।
পেলোসির সফরের পর তাইওয়ানের চারপাশ ঘিরে সামরিক মহড়া চালানোর ঘোষণা দেয় চীন। দেশটির সেনাবাহিনী তাইওয়ানের কিছু অংশে অভিযান চালানোরও ঘোষণা দিয়েছে। তবে পেলোসি তাইওয়ানে থাকা অবস্থায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি চীন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, পেলোসি ফিরে গেলে সামরিকসহ নানা পদক্ষেপ নিতে পারে শি জিন পিং সরকার। এরই মধ্যে গতকাল তাইওয়ানের আকাশ সীমায় একযোগে চীনের ২৭ যুদ্ধবিমান প্রবেশ করেছে। তাইওয়ানের সমুদ্রসীমাতেও যুদ্ধ জাহাজের আনাগোনা বাড়িয়েছে চীন। পাশাপাশি তাইওয়ানকে শাস্তি দিয়ে বাণিজ্য সীমাবদ্ধতাও আরোপ করেছে চীন। তাইওয়ান থেকে কমলা লেবু এবং কয়েক ধরনের মাছ আমদানি স্থগিত করেছে চীন। চা, মধু ও সি ফুডের মতো আইটেমসহ তাইওয়ানের শতাধিক ফুড ব্রান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে দেশটি।
খবরে প্রকাশ, তাইওয়ান সফরের আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেন স্পিকার পেলোসিকে সতর্ক করেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী যেকোনো দেশ ইচ্ছামতো ভ্রমণের ক্ষমতা রাখেন স্পিকার। তার নিরাপত্তা প্রদান করতে বাধ্য থাকবে এফবিআই। যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণকে যুদ্ধের উস্কানি বলেও ব্যাখ্যা করছেন বিশ্লেষকরা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত মাসে বালিতে জি-২০ বৈঠকের সময় তার চীনা প্রতিপক্ষ ওয়াং ইয়ের সঙ্গে পেলোসির সফরের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, এই ধরনের যেকোনো সফর সম্পূর্ণরূপে পেলোসির সিদ্ধান্ত এবং মার্কিন সরকারের থেকে স্বাধীন হবে।
চীনা সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে ন্যান্সিকে বহনকারী একটি বিমান তাইওয়ানের মাটি স্পর্শ করে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে তিনি তাইপেতে এসে পৌঁছান। তাইওয়ানে পৌঁছানোর পর এক টুইট বার্তায় পেলোসি বলেন, তার প্রতিনিধিদলের সফর ‘তাইওয়ানের গতিশীল গণতন্ত্রের’ প্রতি আমেরিকার অবিচল প্রতিশ্রুতিকে সম্মানিত করেছে। তিনি আরও লিখেন, তাইওয়ানের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের সঙ্গে আমেরিকার সংহতি আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার সফর কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নীতির বিরোধিতা করে না।
বুধবার সফরকালে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের সামনে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশ্যে পেলোসি বলেন, আমি খুব গর্বিত। আজ আমাদের প্রতিনিধিদল তাইওয়ানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে এখানে এসেছে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাতে চাই, তাইওয়ানের প্রতি করা প্রতিশ্রুতি থেকে আমরা নড়ব না এবং আমরা আমাদের এই অটুট বন্ধুত্বের জন্য গর্বিত।
চীনের কড়া হুমকির মধ্যেও এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ন্যান্সি তাইওয়ানে আসায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। এ পদক্ষেপকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বলে বিবৃতি দিয়েছে তারা। বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চীনকে দমাতে তাইওয়ানকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ক্রমাগত তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ বাড়িয়ে ‘এক চীন’ নীতি লঙ্ঘন করছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কে দিচ্ছে। এসব পদক্ষেপ আগুন নিয়ে খেলার মতো, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যারা আগুন নিয়ে খেলা করে তারা এতে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
এদিকে গত কয়েকদিন ধরে ন্যান্সির তাইওয়ানে আগমন ঠেকাতে ন্যান্সিকে বহনকারী সামরিক বিমানে হামলাসহ যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর পরিণতি ভোগের হুঁশিয়ারি দেয় চীন। বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপে শি জিনপিন বলেছিলেন, তাইওয়ান ইস্যুতে নাক গলানো আর আগুন নিয়ে খেলা করা সমতুল্য। ভালো চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এ ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ করা। সেইসঙ্গে ন্যান্সির সফর বাতিল করা।
এত হুঁশিয়ারির পরেও যখন ন্যান্সি তাইওয়ানে পৌঁছান তখন ধারণা করা হচ্ছিল তাকে বহনকারী বিমানে চীনা সামরিক বাহিনী হামলা করতে পারে। একারণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীও তাইওয়ানের আশপাশে নিজেদের সামরিক যুদ্ধাস্ত্র বৃদ্ধি করে। তবে এমনটা ঘটতে দেখা যায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু ন্যান্সিকে বহনকারী বিমানে চীনা সেনারা হামলা করেনি, সেহেতু উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর পারমাণবিক অস্ত্রসহ সবচেয়ে বেশি সামরিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অর্থ তার মিত্রদেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করবে। বিপরীতে চীন অন্যতম শক্তিশালী দেশ হলেও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। আর এ মুহূর্তে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা উভয় দেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়, তাইওয়ানের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তবে তারা আমেরিকান আইনের অধীনে দ্বীপটির আত্মরক্ষার উপায় সরবরাহ করতে বাধ্য। এদিকে মার্কিন কর্মকর্তাদের তাইওয়ান সফরকে দ্বীপটির স্বাধীনতাকামীদের উস্কানি হিসেবে দেখছে চীন। তাইওয়ানও চীনের সার্বভৌমত্বের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, শুধুমাত্র তাইওয়ানের জনগণই দ্বীপের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার রাখে।
সফর ঘিরে তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী তাদের সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়েছে। দ্বীপটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, মঙ্গলবার ২১টি চীনা বিমান তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং চীন আশেপাশের জলে মহড়া দিয়ে মূল বন্দর এবং শহরগুলিকে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। বুধবার তাইওয়ানের এক সিনিয়র কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, তথাকথিত ড্রিল এলাকাগুলি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক চ্যানেলগুলির মধ্যে পড়ছে। আমরা চীনের উচ্চাকাক্সক্ষা দেখতে পাচ্ছি। তারা চাচ্ছে তাইওয়ান প্রণালীকে অ-আন্তর্জাতিক জলসীমায় পরিণত করতে এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের প্রথম দ্বীপ শৃঙ্খলের পশ্চিমের পুরো এলাকাটিতে তাদের প্রভাব বলয় তৈরি করতে।
তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাইওয়ানের ওপর নৌ অবরোধের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছে, তারা তাইওয়ানের আশেপাশে তাদের সামরিক মহড়া দেখেনি যার ফলে নৌ চলাচলের স্বাধীনতার কোনো সমস্যা হয়েছে।
এর আগে মন্ত্রণালয় বলেছিল, পেলোসির সফর তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, চীন-মার্কিন সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে এবং চীনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। চীনা সামরিক বাহিনী বলেছিল, তারা উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে এবং পেলোসির সফরের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ‘লক্ষ্যযুক্ত সামরিক অভিযান’ শুরু করবে।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তার মুখপাত্র জন কিরবি তাইওয়ানে পেলোসির আগমনের পরে বলেছিলেন, চীনের হুমকি বা বিদ্রোহী বক্তব্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয় পাবে না। তার সফরের কারণে সঙ্কট বা সংঘাতের উদ্রেক হওয়ার কোনো কারণ নেই। মার্কিন-চীন সম্পর্কের প্রভাব আগামী দিনে বেইজিংয়ের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে। তবে চীন তাইওয়ানের ওপর ‘অর্থনৈতিক বলপ্রয়োগ’ করতে পারে।
চরম উত্তেজনার মধ্যে তাইওয়ান সফর শেষ করেছেন ন্যান্সি। ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যেই তিনি তাইওয়ান ছেড়েছেন। এখান থেকে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া যাবেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা।
এ সফরকে কেন্দ্র করে বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উভয়টিই হতে পারে বলে মনে করছেন তাইওয়ানের বিশেষজ্ঞরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।