ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর চলার শুরুটা করোনার বেশ আগে। সারা দেশে আন্ত ধর্মীয় সম্প্রীতির বাতায়ন সৃষ্টি আর একাত্তরের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তাগিদে শুরু থেকেই আমাদের ছুটে বেড়ানো এ দেশের পথে আর ঘাটে। কখনো ‘সম্প্রীতি সংলাপ’, তো কখনো ‘শতবর্ষের পথে বঙ্গবন্ধুর কনসেপ্টকে’ ধারণ করে আমাদের এই ছোটাছুটির অভিজ্ঞতাগুলো বড়ই অদ্ভুত।
শীতের রাতে কুয়াশাঘেরা ঝিনাইদহে আমাদের বরণ করতে যখন গভীর রাতেও প্রাণবন্ত উপস্থিতি, তখন উত্তরবঙ্গের একটি শহর থেকে অন্য শহরে সাঁঝের আঁধারে আমাদের যাত্রা নিয়ে উৎকণ্ঠিত স্থানীয় সুহৃদরা। কারণ অন্য কিছুই না। সাঁঝের অন্ধকারে পাছে অন্ধকারের শক্তি হামলে পড়ে আমাদের বহরে! শুধু গত জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের জেলা-উপজেলায় আর ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আমাদের সভা-সমাবেশ, আলোচনা-মতবিনিময় সভার সংখ্যাই শতাধিক।
আমাদের এই ছুটে চলায় হঠাৎ যতি গত মার্চে, কভিডের আকস্মিক আবির্ভাবে। প্রথম দিককার বেহাল দশাটা পুরো দেশের মতোই সামলে উঠতে আমাদেরও সময় লাগেনি খুব একটা। ‘নিউ নরমাল’ জীবনের সঙ্গে আমরাও খাপ খাইয়ে নিয়েছি দ্রুতই।
কভিড অতিমারিতে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। প্রথমত, সারা দেশে আমরা সম্প্রীতির যে রবটা তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম তা যেন হারিয়ে না যায়। আমাদের ঘাম ঝরানো পথ চলায় যত অর্জন আর দেশজুড়ে যত বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী, কভিডে সেসব যেন মিইয়ে না যায়! পাশাপাশি হাসপাতালে আর চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ায় আমাদের যে অভ্যস্ততা, আওয়ামী লীগ সরকারের দশক পেরোনো ধারাবাহিকতায় স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির কারণে তা বেড়েছে পাল্লা দিয়েই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেশের মানুষগুলোর সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করায় যিকঞ্চিৎ অবদান রাখার দায়বদ্ধতাটাও আমাদের নাড়া দিচ্ছিল।
এ জন্য শুরুতেই আমরা সম্প্রীতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ, স্বাধীনতার সপক্ষীয় ৮৭ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে চালু করেছিলাম টেলিমেডিসিন। মূলধারার পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়ায় আর সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই ৮৭ জন কভিডযোদ্ধার নাম, বিশেষায়ণের ক্ষেত্র আর মোবাইল নম্বর। সারা দেশের মানুষ টেলিফোনে তাঁদের কাছে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন দিনের পর দিন, টোয়েন্টি ফোর সেভেন।
পাশাপাশি আমরা সম্প্রীতি বাংলাদেশের ফেসবুক পেজ থেকে আয়োজন করতে থাকি ‘টেলিমেডিসিন’ নামের সাপ্তাহিক একটি অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে এখনো। এই অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে একেক সপ্তাহে যুক্ত থাকেন একেকজন বিশেষজ্ঞ। আছেন যেমন হেপাটোলজিস্ট কিংবা কার্ডিওলজিস্ট, আছেন তেমনি সাইকোথেরাপিস্ট আর ফ্যামিলি মেডিসিন স্পেশালিস্টও। একটি ঘণ্টা ধরে নিজেদের চেম্বার আর পরিবারকে সময় না দিয়ে তাঁরা আমাদের পেজে থেকে এখনো সময় দেন দেশের মানুষকে। প্রশ্ন আসে হরেক রকম। প্রশ্ন করেন হরেক মানুষ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে। আর সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন এসব নিষ্ঠাবান বিশেষজ্ঞ। উপকৃত হন মানুষ আর বারবার চমত্কৃত হই আমরা। চমত্কৃত হই আমাদের প্রতি মানুষের নির্ভরতায় আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিষ্ঠায়। করোনাকালে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় সম্পৃক্ত থাকতে পেরে সম্প্রীতি বাংলাদেশ গর্বিত।
একইভাবে গর্বিত আমরা সম্প্রীতি সংলাপগুলো নিয়েও। প্রতি শনিবার রাত ঠিক ৯টা। সম্প্রীতি বাংলাদেশের ফেসবুক পেজ থেকে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর। শুরু হয় সম্প্রীতি সংলাপ। সদস্যসচিব হিসেবে আমার নাতিদীর্ঘ স্বাগত বক্তব্য এবং অতঃপর কখনো দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা, তো কখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আলোকিত মানুষগুলোর আলো ছড়ানো কথোপকথন। বিষয়বস্তুও তো কতই না। ভ্যাকসিন যেমন আছে আলোচনায়, সরগরম আলোচনা তেমনি আলজাজিরার গলাবাজি নিয়েও।
আলোচনায় কখনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একের পর এক গৌরবগাথা, তো কখনো ছোট আপা আর কামাল ভাইয়ের জন্মদিন। আলোচনায় যেমন ছোট্ট শেখ রাসেল, তেমনি আলোচনায় ১৫ আগস্টের বেদনাবিধুর রাত আর ষড়যন্ত্রের পেছনের ষড়যন্ত্র। ব্যবচ্ছেদ যেমন চলে বাংলাস্তানি মানসিকতার, তেমনি খোজা হয় রাজনীতি আর সমাজনীতির ক্রিয়া-বিক্রিয়ার নানা কার্যকারণও। কখনো হৃদরোগীর কাছে দেবতাতুল্য ডা. দেবী শেঠি, তো কখনো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো… …’ খ্যাত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী—আলোচনায় যোগ দেন, তেমনি থাকেন মান্যবর ভারতীয় হাইকমিশনার দোরাইস্বামীও। আর এমনিভাবেই কেটে যায় আমাদের করোনা-রাত।
আর এই কেটে যাওয়া করোনাকালের ফেলে আসা স্মৃতি রোমন্থনে পেছনে ফিরে সহসা উপলব্ধি আজ আমাদের সেঞ্চুরি হাঁকানোর দিন। আজ ভার্চুয়াল ‘টেলিমেডিসিন’ আর ‘সম্প্রীতি সংলাপ’ মিলিয়ে আমাদের শততম আয়োজন। আজ রাত ৯টায় আবারও যখন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা বক্তব্যের পর স্বাগত বক্তব্য রাখব আমি, তখন তা হবে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এই করোনাকালে আমাদের শততম উপস্থিতি, যা ধন্য ১০ লক্ষাধিক মানুষের ‘লাইক’ আর ‘কমেন্টে’। এই শনিবারটি তাই আমাদের জন্য বিশেষ শনিবার। এই শনিবার করোনাকালে সম্প্রীতি বাংলাদেশের যে গৌরবময় পথচলা তার সাক্ষ্যবহ। পাশাপাশি এই শনিবার আমাদের দায়িত্ববোধটাকে আরেকটু মজবুত করারও। এই শনিবার করোনাকালের সম্প্রীতির।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।