জুমবাংলা ডেস্ক: বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও কোভিডের টিকার সঙ্গে নারীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা এবং গর্ভপাত সংক্রান্ত কিছু মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য এখনও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে। খবর বিবিসি বাংলার।
গর্ভধারণের সময় নারীকে চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে ডাক্তাররা চরম সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। এর ফলে আগে তারা গর্ভবতী নারীদেরকে করোনাভাইরাসের টিকা এড়িয়ে চলার কথা বলতেন।
কিন্তু এখন এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, যার ফলে ডাক্তারদের দেওয়া আগের পরামর্শ বদলে গেছে। শুধু তাই নয়, গর্ভবতী নারীদের এখন এই টিকা নেওয়ার জন্য আরও বেশি করে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
কারণ করোনাভাইরাসের কারণেই প্রেগন্যান্সি বা গর্ভধারণ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এখানে আমরা অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া কিছু বক্তব্যের দিকে নজর দিয়েছি এবং খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি- কেন এসব বক্তব্য ভুল।
টিকা ডিম্বাশয় বা ওভারিতে জমা হয়- মিথ্যা
এই তত্ত্বটি এসেছে জাপানি নিয়ন্ত্রকদের কাছে পেশ করা একটি গবেষণার ভুল ব্যাখ্যা থেকে।
এই গবেষণায় ইঁদুরের শরীরে টিকা দেওয়া হয়েছিল এবং একজন মানুষের শরীরে যতোটুকু টিকা দেওয়া হয় তার চেয়েও বহু গুণ বেশি ডোজে (১,৩৩৩ গুণ বেশি) টিকা দেওয়া হয়েছিল ইঁদুরের দেহে।
দেখা গেছে টিকার ইঞ্জেকশন দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর পুরো ডোজের মাত্র ০.১% (এক হাজার ভাগের এক ভাগ) প্রাণীটির ওভারিতে গিয়ে জমা হয়েছে।
কিন্তু ইঁদুরের শরীরের যে জায়গায় ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে (মানুষের বেলায় সাধারণত টিকা দেওয়া হয় তার বাহুতে) সেখানে এর চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে টিকা জমা হয়েছে। দেখা গেছে এক ঘণ্টা পরে সেখানে জমা হয়েছে টিকার ৫৩% এবং ৪৮ ঘণ্টা পর জমেছে ২৫%।
এর পরে যে জায়গাতে বেশি টিকা জমা হয় সেটি লিভার বা যকৃৎ (৪৮ ঘণ্টা পরে ১৬%)। রক্ত থেকে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে এই লিভার।
চর্বির বুদ্বুদ বা বাবল ব্যবহার করে টিকা দেওয়া হয় শরীরে। এর মধ্যে থাকে ভাইরাসটির জেনেটিক উপাদান। এসব উপাদান দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে তৎপর করে তোলে।
কিন্তু যারা নারীর ওভারিতে টিকা জমা হওয়ার দাবি প্রচার করছেন তারা একটি ভুল তথ্য বেছে নিয়েছেন।
তারা আসলে বলছেন, ওভারিতে জমা হওয়া চর্বির কথা। টিকার কথা নয়।
টিকা নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর ওভারিতে চর্বির মাত্রা আসলেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ টিকার মধ্যে যেসব উপাদান আছে সেগুলো শরীরের যে জায়গায় ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে শরীরের অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে তখনও যে তাতে ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান রয়ে গেছে- এর পক্ষে কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
টিকা দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর কী হয়েছে সেটা আমরা জানি না। এটাই এই গবেষণার সীমাবদ্ধতা।
তথ্য উপাত্তে দেখা যায় টিকা গর্ভপাতের কারণ- যা মিথ্যা
সোশাল মিডিয়ার কোনও কোনও পোস্টে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের টিকা পর্যবেক্ষণ বিষয়ক দুটো প্রকল্পের কাছে গর্ভপাতের বিষয়ে রিপোর্ট করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
টিকা নেওয়ার পর কী ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় এবং শরীরের অবস্থা কেমন হয়- এসব বিষয়ে যে কেউই রিপোর্ট করতে পারে। প্রত্যেকেই রিপোর্ট করে না। কেউ কেউ করে থাকেন।
প্রকল্প দুটোতে গর্ভপাতের বিষয়ে রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মিল আছে। কিন্তু এসবের অর্থ এই নয় যে টিকা নেওয়ার কারণেই গর্ভপাত হয়েছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে- টিকা নেওয়া নারীদের মধ্যে গর্ভপাতের হার, সাধারণ সময়ের গর্ভপাতের হারের প্রায় সমান- ১২.৫%।
লন্ডনে ইম্পেরিয়াল কলেজের একজন বিজ্ঞানী, প্রজনন সংক্রান্ত ইমিউনোলজিস্ট ড. ভিক্টোরিয়া মেইল বলছেন, টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানার জন্য এধরনের রিপোর্টিং ব্যবস্থা খুব ভালো।
এ থেকে বিশেষ বিশেষ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়, যেগুলো হয়তো খুব সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নয়। এক্ষেত্রে কিছু কিছু অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সাথে রক্তের জমাট বেঁধে যাওয়ার বিশেষ ও বিরল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
টিকা নেওয়া লোকজনের শরীরে আপনি যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখতে পান, তখনই সতর্ক হয়ে যাওয়া যায়।
তবে এই পদ্ধতি সাধারণ উপসর্গের উপর নজর রাখার জন্য ততোটা উপযুক্ত নয়। এসব উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- মাসিক বা পিরিয়ডের ধরনে পরিবর্তন, গর্ভপাত এবং হার্টের সমস্যা।
তথ্যভাণ্ডারের মধ্যে এসব উপসর্গ দেখলে খুব বেশি সতর্ক হতে হয় না। কারণ এগুলোকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নেওয়া হয়। টিকা নিলে কিম্বা না নিলেও এরকম হতে পারে।
তবে টিকা না নেওয়া নারীদের চাইতে টিকা নেওয়া নারীদের মধ্যে যদি অনেক বেশি সংখ্যায় গর্ভপাতের ঘটনা ঘটতে শুরু করে, তখনই এসব তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান শুরু করতে হবে।
এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু ঘটেনি।
কোনও কোনও ব্যক্তি অনলাইনে এমন কিছু গ্রাফ শেয়ার করছেন যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে আগের বছরগুলোতে অন্যান্য টিকা ও ওষুধ গ্রহণের পর যতো মানুষ রিপোর্ট করেছিলেন, এবার তার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ তাদের অভিজ্ঞতার কথা রিপোর্ট করেছেন।
কোভিডের টিকা কম নিরাপদ- এধরনের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে এসব গ্রাফ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বেশি সংখ্যক মানুষের রিপোর্ট করার ঘটনা থেকে এরকম কিছু প্রমাণ হয় না।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে এখন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ রিপোর্ট করছেন। সম্ভবত আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় নজিরবিহীন সংখ্যায় লোকজনকে টিকা দেওয়া এবং এটি বহুল আলোচিত বিষয় হওয়ার কারণে এরকমটা হয়ে থাকতে পারে।
প্ল্যাসেন্টাকে আক্রমণ করতে পারে টিকা- প্রমাণ নেই
ব্রিটেনে মাইকেল ইয়েডন নামের একজন বৈজ্ঞানিক গবেষকের একটি পিটিশন সোশাল মিডিয়াতে বহুবার শেয়ার হয়েছে। কোভিড সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর কিছু বক্তব্য দিয়ে তিনি আলোচিত হয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ফাইজার ও মডার্নার টিকায় করোনাভাইরাসের যে স্পাইক প্রোটিন যুক্ত করা হয়েছে তার সঙ্গে প্ল্যাসেন্টার একটি প্রোটিনের মিল রয়েছে। এই প্রোটিনের নাম সিঙ্কিটিন-ওয়ান, প্ল্যাসেন্টা গঠনে যার ভূমিকা রয়েছে।
তার ধারণা এর ফলে ভাইরাসটি ঠেকাতে যেসব অ্যান্টিবডি তৈরি হবে সেগুলো গর্ভধারণকেও ঠেকিয়ে দিতে পারে।
এই ধারণা থেকেই কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে কোভিড টিকার কারণে নারীর প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু এই ধারণা ভুল। কারণ করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সাথে প্ল্যাসেন্টার সিঙ্কিটিন-ওয়ান প্রোটিনের কিছুটা মিল রয়েছে বটে, কিন্তু এই দুই প্রোটিনের চরিত্র হুবহু এক নয়। তাদের মধ্যে যে তফাতগুলো আছে তা কখনই শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করবে না।
এ বিষয়ে এখন অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণও পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নারীর প্রজনন ক্ষমতা সংক্রান্ত চিকিৎসক র্যান্ডি মরিস এবিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তার কাছে আইভিএফ চিকিৎসা নিতে আসা কিছু নারীর ওপর নজর রাখেন তিনি। দেখার চেষ্টা করেন করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার কারণে তাদের গর্ভধারণের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে কীনা।
ড. মরিসের গবেষণায় ১৪৩ জন নারী অংশ নিয়েছেন যাতে টিকা নেওয়া, না নেওয়া এবং করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন এমন নারীরাও ছিলেন। দেখা গেছে তাদের মধ্যে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে তেমন কোনও তারতম্য ঘটেনি।
ড. মরিস বলছেন, যেসব মানুষ এধরনের ভয় ছড়াচ্ছেন তারা কিন্তু ব্যাখ্যা করছেন না যে টিকা নেওয়ার কারণে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি, নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে- এই ধারণা তারা কেন বিশ্বাস করছেন।
সমস্যা হচ্ছে, লোকজনকে আশ্বস্ত করতে বিজ্ঞানীরা যখন তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন, তার আগেই লোকজন অনলাইনে অন্যান্য বিষয়ের দিকে সরে যান।
যেমনটা ড. মরিস বলছিলেন: এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যখনই এগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করা হয়, তখনই লোকেরা গোলপোস্ট অন্যদিকে সরিয়ে নেয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।