করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ১১ জেলায় শিশুসহ আরো ১২ জন মারা গেছে। গত সোমবার রাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওই সব ব্যক্তির বাড়ি ‘লকডাউন’ করা এবং পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিন করার ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। করোনা সংক্রমিত হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে কি না সেটা জানতে কারো কারো নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ নিয়ে গত ২২ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা সংক্রমণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আবার অনেকেরই নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সঙ্গে এবার মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ডেঙ্গু যোগ হয়ে ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাঁরা বলছেন, মৌসুমি ফ্লুতে শ্বাসকষ্ট থাকে আবার করোনায়ও শ্বাসকষ্ট থাকে। সে কারণে উপসর্গ আলাদা করতে এবার সাধারণ মানুষ হিমশিম খেতে পারে, চিকিৎসাকর্মীরাও এক ধরনের জটিলতায় পড়ে যাচ্ছেন বা ইতিমধ্যেই পড়ে গেছেন।
এমন অবস্থায় করোনা পরীক্ষার পরিসর বাড়ানো হয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার বিকপাশা গ্রামে ছয় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। জ্বর, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা ছাড়াও সে কিডনি সমস্যায় ভুগছিল বলে তার পরিবার জানিয়েছে। শিশুটির বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। ওই বাড়িতে থাকা ১২ জনকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিন পালনের নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এ ছাড়া শিশুটির সংস্পর্শে থাকা তার খালাতো ভাইও (১৬) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তাকে বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা ওই বাড়িতে যাওয়ার আগেই লাশ দাফন করা হয়।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গতকাল সকালে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক ব্যক্তির (৬০) মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নমুনা ঢাকায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জিসেলি ঘোষ মুনমুন জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে ওই ব্যক্তি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসার পর তাঁকে ভর্তি করা হয়। তিনি নিজের ও বাবার নাম বলতে পারলেও ঠিকানা বলতে পারেননি। একটি ফোন নম্বর দিয়েছিলেন, সেটাও বন্ধ পাওয়া গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা এলাকার সাহেব গ্রামে জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ৬৫ বছর বয়সের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ৮টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর রাতেই ওই এলাকা লকডাউন করা হয়।
গোমস্তাপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুর রহমান জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি মানিকগঞ্জে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সোমবার সকালে বাড়ি ফিরে আসেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সারওয়ার জাহান জানান, দেরি হওয়ায় ওই ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর সঙ্গে থাকা ওই এলাকার আরেক ব্যক্তির নমুনা নেওয়া হয়েছে। তাঁকে হোম কোয়ারেন্টিন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনার পূর্বধলার গোহালকান্দা ইউনিয়নের কিছমত বারেঙ্গা গ্রামে সোমবার রাতে ৩৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তি সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন। ওই দিন দুপুরে তিনিসহ দুজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। মারা যাওয়া ব্যক্তি শ্যামগঞ্জ বাজারের একটি খাবারের হোটেলে কাজ করতেন। তাঁর বাড়িসহ আশপাশের সাতটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। গত রবিবার করোনার উপসর্গ নিয়ে উপজেলায় এক নারী মারা যান।
শ্যামগঞ্জ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা. ওয়াহিদুর রহমান খান মামুন জানান, ওই ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, কয়েক বছর আগে ওই ব্যক্তির যক্ষ্মা হয়েছিল। চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ৫২ বছর বয়সী এক রিকশাচালক মারা গেছেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার দিলালপুর ইউনিয়নের তাতালচর গ্রামে। সোমবার সকালে তিনি জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। তাঁর পরিবারের ছয় সদস্যকে প্রশাসন হোম কোয়ারেন্টিনে রেখেছে।
বাজিতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ জানান, মৃত ব্যক্তির নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। ইউএনও দীপ্তিময়ী জামান জানান, করোনায় আক্রান্ত রোগীর মতোই তাঁকে দাফন করা হয়েছে। করোনা নিশ্চিত হলে এলাকা লকডাউন হবে।
জেলার পাকুন্দিয়ার নামাপুটিয়া গ্রামে গতকাল দুপুরে এক যুবকের (৩০) মৃত্যু হয়েছে। তিনি একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁর নমুনা জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে (আইপিএইচ) পাঠানো হয়েছে। পরিবারের সব সদস্যকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। গ্রামও লকডাউন করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জমির মো. হাসিবুস ছাত্তার বলেছেন, ওই যুবক জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাঁকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হলেও তিনি মানেননি।
জানা গেছে, গতকাল কটিয়াদী উপজেলা থেকে ফেরার পথে বাড়ির সামনে এসে মারা যান ওই যুবক।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের রসুলপাড়ায় গতকাল ৭০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন। জেলার সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় জানান, মৃত ব্যক্তির নমুনা রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে সোমবার জ্বর, সর্দি ও কাশিতে আক্রান্ত হাতীবান্ধা উপজেলার কেতকীবাড়ী গ্রামের ৩৫ বছর বয়সী এক যুবকের নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন। তিনি সম্প্রতি ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছেন।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নের ভাটি পাঁচানির গ্রামে ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় রিকশা চালাতেন। এক সপ্তাহ আগে অসুস্থ হয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। এলাকার লোকজন বিষয়টি জানালেও কোনো স্বাস্থ্যকর্মী তাঁর খোঁজখবর নেননি। ওই ব্যক্তির পরিবার বলছে, তিনি অসুস্থ ছিলেন না। মাটি কাটতে গিয়ে হৃদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক মো. হিরা মিয়া জানান, মৃত ব্যক্তির দুই ভাই গত কয়েক দিন ধরেই তাঁর কাছ থেকে জ্বর, সর্দি ও কাশির ওষুধ নিয়েছেন। তাঁর ভাতিজিও একই উপসর্গের জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ওষুধ নিয়েছেন। নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমকর্তা ইকবাল আহম্মেদ নাসের জানান, খবর পেয়ে তিনি স্বাস্থ্যকর্মীসহ করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের ওই বাড়িতে পাঠিয়ে জানতে পেরেছেন ওই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরসীতা এলাকায় গতকাল এক ব্যক্তির (৫৫) মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় চর বাদাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন জসিম জানান, দীর্ঘদিন ধরে ওই ব্যক্তি ক্যান্সার ও কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. কামনাশীষ মজুমদার জানান, নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ইউএনও মো. আব্দুল মোমিন জানান, মৃত ব্যক্তির বাড়িসহ তিনটি বাড়ি লকডাউনে রাখা হয়েছে।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সোমবার রাতে ষাটোর্ধ্ব এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এলাকার লোকজন তাঁর করোনার উপসর্গ ছিল বলে দাবি করছে। তারা বলছে, ওই নারী ১০-১২ দিন আগে ঢাকায় তাঁর ছেলের বাসায় জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হন। ওই অবস্থায় তিনি নাতিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ও মৃত সনদ প্রস্তুতকারী চিকিৎসক ডা. অনল রায় বলেন, ওই নারীর করোনা উপসর্গ পাওয়া যায়নি। ওই রোগীর দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে স্ট্রোকও করেছিলেন।
সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ জানান, মৃত নারী ও তাঁর নাতির নমুনা পরীক্ষা করা হবে। তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও নমুনা নেওয়া হবে।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাটিতাকান্দি গ্রামে গতকাল সকালে ৭৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তিনি ১০-১২ দিন আগে তাবলিগ জামাত থেকে বাড়ি ফিরে জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন বলে স্থানীয় আনেহলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান তালুকদার জানান। ওই ব্যক্তির বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাইফুর রহমান খান জানান, তাঁরা মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে সিভিল সার্জন অফিসে পাঠিয়েছেন।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার দৌলখাঁড় গ্রামে গতকাল এক ব্যক্তির (৪০) মৃত্যু হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব জানান, ওই ব্যক্তি ১৫ দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। গত চার দিন তিনি ডায়রিয়ায় ভুগছিলেন। এ ছাড়া তাঁর হালকা গলা ব্যথাও ছিল। তিনি স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ছিলেন। স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। জানা গেছে, করোনা রোগীদের দাফনে গঠিত উপজেলা দাফন কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তিকে দাফন করেছে।
(প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য তথ্য দিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক এবং জেলা, আঞ্চলিক ও উপজেলা প্রতিনিধিরা)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।