ফার্নান্দো দুয়ার্তে, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস: গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন যে, প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আসা একটি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তার মাথা ব্যথা হচ্ছে, নাক দিয়ে পানি পড়ছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা বুঝতে পারছিলেন না সমস্যাটা কোথায়?
একটি সিটি স্ক্যান, মূত্র পরীক্ষা, রক্তে চিনির মাত্রা এবং শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে তারা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন- তিনি কোন বিষক্রিয়া আক্রান্ত হননি অথবা রহস্যজনক কোন রোগে আক্রান্ত নন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচগুলোর একটি খেয়েছিলেন।
তিনি যে জাতের মরিচ খেয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে ক্যারোলিনা রিপার, যেটি সাধারণ জালাপিনো মরিচের চেয়ে ২৭৫ গুণ বেশি ঝাল। ৩৪ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একটি প্রতিযোগিতায় নেমে ওই ঝাল মরিচ খেয়েছিলেন।
তবে তিনি ভাগ্যবান যে, তার মস্তিষ্কের চাপা হয়ে যাওয়া রক্তনালী আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এটা হয়তো একটি চরম উদাহরণ।
কিন্তু বিশ্বের নানা কোনে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ, হয়তো কোটি কোটি যখন ঝাল মসলার খাবার খেতে বসেন, হয়তো তাদের জিহ্বায় তীব্র অনুভূতির তৈরি হয়, যখন তারা তাড়াতাড়ি পানি বা কোমল পানিয় খেয়ে ঝাল কমানোর চেষ্টা করেন।
অনেকের পেট খারাপ করে তোলে। তারপরেও মানুষ কেন ঝাল খায়?
এটা আসলে এমন একটা ভালোবাসার গল্প যা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে এবং সেটির কমতিরও কোন লক্ষণ নেই।
সেটা বুঝতে পারা যায় এই পরিসংখ্যান দেখলে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন।
বিবর্তনমূলক প্রবৃত্তি
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সবক্সের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে আমরা প্রত্যেকে গতবছর প্রায় পাঁচ কেজি করে মরিচ খেয়েছি। গড়পড়তা একটি লাল মরিচের ওজন হয়ে থাকে ২০গ্রাম।
অনেক দেশের নাগরিকদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি ঝাল খাওয়ার প্রবণতা থাকে।
তুরস্কের বাসিন্দারা প্রতিদিন গড়ে ৮৬.৫ গ্রাম মরিচ খেয়ে থাকে- যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো, যারা বছরে ৫০.৯৫ গ্রাম মরিচ খায়, যারা বিশেষ করে ঝালমসলাযুক্ত খাবারের জন্য বিখ্যাত।
কিন্তু কেন আমরা ঝাল খাবার এতো বেশি পছন্দ করি?
এর পেছনে লুকিয়ে আছে শিহরিত হয়ে ওঠার মতো মনোবিজ্ঞান ও বিবর্তনের প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি জটিল গল্প।
প্রকৃতির গোপনীয়তা
কোন বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মরিচের ভেতর ঝালের জন্য দায়ী ক্যাপসাইসিনের সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরিচের ঝাল ক্রমেই বেড়েছে এবং উদ্ভিদগুলো এমন একটি ঝাল বা উত্তাপ তৈরি করেছে, যার ফলে স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পোকামাকড় এসব উদ্ভিদ খাওয়া থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু দেখা গেছে, পাখির এ নিয়ে কোন সমস্যা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বের করেছেন যে, কেন মরিচের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি খুব ভালোভাবে কাজ করেছে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মরিচের বিচি পেটের ভেতরে হজম করে ফেলে, ফলে নতুন করে আর গাছের বংশবিস্তার সম্ভব হয় না। কিন্তু পাখির ক্ষেত্রে তা হয় না- বীজ পাখির মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে এবং নতুন উদ্ভিদের জন্ম হতে পারে।
সুতরাং মরিচের গাছ যদি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিজের ফল খাওয়া বন্ধ করতে এই ঝালের ব্যবস্থা তৈরি করে থাকে, তাহলে মানুষের ক্ষেত্রে কেন সেটি প্রযোজ্য হচ্ছে না?
এটা আরো অবাক করার মতো, কারণ মানুষ সাধারণত তিক্ত স্বাদকে বিষের সঙ্গে যুক্ত করে থাকে, যা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে।
জ্বলে যাওয়ার সতর্কতা
একটি থিওরি হলো যে, মানুষ ঝাল খাবারের স্বাদ পেয়েছে তাদের অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল বৈশিষ্ট্যের কারণে।
ধারণাটি হলো যে, মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করে য, ঝাল মসলার খাবার পচে যাওয়ার সম্ভাবনা কম- খাবারে উত্তাপ থাকার মানে হলো সেটি নষ্ট হয়ে যায়নি।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী জেনিফার বিলিং এবং পল ডব্লিউ.শেরম্যান ১৯৯৮ সালের দিকে প্রথম এই ধারণা নিয়ে সামনে আসেন।
তারা ৩৬টি দেশের মাংস দিয়ে তৈরি কয়েক হাজার ঐতিহ্যগত খাবার বিশ্লেষণ করে দেখেছেন এবং দেখতে পেয়েছেন, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর অঞ্চলগুলোয় ঝালযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া হয়, যেখানে খাবার সহজেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর অঞ্চলগুলোয় ঝালযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া হয়, যেখানে খাবার সহজেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
”গরমের দেশগুলোয় মাংস দিয়ে তৈরি প্রতিটি খাবারেই অন্তত একটি মসলা থাকবেই, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক মসলা থাকে, ভারী মসলা। আর ঠাণ্ডার দেশগুলোয় বেশিরভাগ খাবার তৈরি করা হয় মসলাবিহীন বা খুব সামান্য মসলা দিয়ে,” তারা উপসংহারে পৌঁছান।
থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, ভারত ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোয় মসলা নির্ভর খাবার বেশি তৈরি করা হয়। অন্যদিকে সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং নরওয়েতে সবচেয়ে কম মসলা খাওয়া হয়।
”আমার মতে, খাবার রান্নার পদ্ধতি দেখলেই বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরজীবী বা জীবাণুগুলোর সঙ্গে ও আমাদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার একটি ইতিহাস দেখতে পাওয়া যায়। আমরা যেসব খাবার খাই, পরজীবীগুলোও সেই একই খাবার খাওয়ার চেষ্টা করে।” বলছেন শেরম্যান।
”খাবার নিয়ে যা কিছু আমরা করি, শুকাই, রান্না করি, ভাপে সেদ্ধ করি, লবণ মিশিয়ে রাখি অথবা মসলা মাখি- সব কিছুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব জীবাণু যাতে খাবারটি নষ্ট করে ফেলতে না পারে। ”
কোমলতার প্রতিষেধক?
খাদ্য বিজ্ঞানী কাওরি ও’কনোর আরেকটি সূত্র যোগ করেছেন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলছেন, আখ এবং আলুর মতো, মরিচ এমন একটি খাদ্যদ্রব্য যা ইউরোপের মানুষদের কাছে বহু বছর অচেনা ছিল। কিন্তু ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় পৌঁছার পর এবং বাণিজ্য পথ চালুর পর, সেটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
”ইউরোপের অভিযাত্রীদের মাধ্যমে মরিচ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে,” বলছেন ও’কনোর।
এগুলোর চমকপ্রদ স্বাদ খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বের খাবারে ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেশের মধ্যে আছে ভারত, চীন এবং থাইল্যান্ড।
”আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে যে, সেই সময় ইউরোপের খাবার খুবই মৃদু ধরণের ছিল। কিন্তু মরিচ সেগুলোয় স্বাদ যোগ করেছে, যেমনটা হয়েছে চিনি আসার পর।”
রোমাঞ্চ ও পেটে ব্যথা
তবে মরিচের প্রতি আমাদের ভালোবাসার কারণ হিসাবে আরেকটা বিকল্প তত্ত্ব আছে। মশলাযুক্ত খাবারের প্রতি আমাদের ঝোঁকের কারণ হিসাবে মনে করা হয় ”সীমিত ঝুঁকি” নেয়ার প্রবণতাকে।
এই তত্ত্বে বলা হয় যে, এখন মানুষ যেমন রোমাঞ্চের জন্য রোলারকোস্টার বা স্কাইডাইভিং করতে পছন্দ করে, ঠিক একই রকম রোমাঞ্চের জন্য ঝাল ঝাল মরিচ খেতে শুরু করে।
কষ্টের স্বাদ
এই ধারণাটি প্রথম প্রকাশ করেন পল রোজিন, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার একজন মনোরোগবিদ। তিনি প্রথম এই বিষয়ে আগ্রহ বোধ করেন এটা লক্ষ্য করে যে, বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খায় না, মানুষ বাদে।
তিনি পরীক্ষার অংশ হিসাবে মানুষজনকে ক্রমেই বেশি ঝালের মরিচ দিতে থাকেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা আর ঝাল খেতে পারে না।
সাক্ষাৎকারের সময় তিনি অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চান, কোন মরিচ তাদের সবচেয়ে ভালো লেগেছে। তারা বলেছেন, সবচেয়ে বেশি ঝালের মরিচটি।
পল রোজিন ব্যাখ্যা করে বলছেন, ”মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যারা অতি নেতিবাচক বিষয়কেও উপভোগ করতে পারে।”
”আমাদের শরীর যদি বিপরীত আচরণও করে, তারপরেও আমাদের মন জানে যে, আমরা আসলে খুব বড় কোন বিপদের মধ্যে নেই।”
এটা তুলনা করা যেতে পারে এভাবে যে, মানুষ অতিরিক্ত ঝাল খেতে পছন্দ করে, ঠিক যেমন তারা ভীতিকর ভৌতিক চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করে।
বৈশিষ্ট্য এবং লিঙ্গ
বিজ্ঞানীরা আরো বোঝার চেষ্টা করেছেন, কেন কিছু কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায় বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করে।
খাদ্য বিজ্ঞানী নাদিয়া বাইর্নেস জানার চেষ্টা করেছেন যে, মানুষের লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য কি ঝালমসলাযুক্ত খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব রাখে কিনা।
তিনি দেখতে পেয়েছেন, পুরুষরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যদের দেখানোর জন্য বেশি ঝালের মরিচ খায়, অন্যদিকে নারীরা কষ্টদায়ক ঝালের অনুভূতি পেতে চায়।
” উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মেক্সিকোয় মরিচ খাওয়া মানে হলো শক্তি, বেপরোয়া এবং পুরুষত্ব প্রদর্শনের ব্যাপার।”
তবে একটা বিষয় পরিষ্কার: মরিচ খাওয়ার পেছনে রোমাঞ্চপ্রিয়তা, কষ্ট উপভোগ অথবা প্রাচীন প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, কারণ যাই হোক না কেন, বিশ্বে এখন আরো বেশি পরিমাণের মরিচ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং মরিচের ঝালও দিনে দিনে বাড়ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।