শরীফ হেলালী: বাংলাদেশের অন্যতম সেরা জয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে গেলাম। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বসেই বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্তানের মধ্যকার প্রথম ওয়ান ডে খেলাটি বাংলাদেশের জয় অবধি উপভোগ করার সৌভাগ্য হলো। বাংলাদেশের স্কোর যখন ৫ উইকেটে ২৮ রান তখনই স্টেডিয়ামে প্রবেশ করছিলাম। পঞ্চম উইকেট হিসেবে সাকিব আল হাসান আউট হওয়ার সাথে সাথেই অসংখ্য দর্শককে স্টেডিয়াম হতে বের হয়ে যেতে দেখলাম। আমাদেরকে ঢুকতে দেখে অনেককেই বলতে শুনেছি, “এখন কি জন্য ঢুকছেন? খেলা তো শেষ!” প্রকৃত অর্থে খেলা কিন্তু তখনও শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরেকটি অসাধারণ জয়ের কাব্য রচিত হয়েই শেষ হয়েছে ম্যাচটি।
ক্রমাগত উইকেট পতনে বাংলাদেশের জয়ের আশা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিলো। লজ্জাজনক হারের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছিলো। আরেকটি পরাজয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিলো মাত্র! আমরা দর্শক গ্যালারিতে গিয়ে বসতে না বসতেই আরেকটি উইকেটের পতন। স্কোর তখন ৪৫/৬ । অতীতে অনেক ম্যাচে এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পেরেছে। কতগুলো ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে এবং কতগুলো ম্যাচ জিততে পেরেছে, সে পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই ক্রিকেটপ্রেমী ও দর্শকদের ভালোই জানা আছে। তাই তারা হয়তো কোনোভাবেই আশার আলো দেখছিলো না। তবে আমি ও আমার বন্ধু মাঠের অবশিষ্ট দর্শকদের সাথে খেলাটা দেখছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটিং এ প্রাথমিক বড় বিপর্যয়ের পর জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী দর্শক তেমন দেখতে পেলাম না। কেননা এই জুটি ভাঙ্গলেই যে আমাদের আর কোনো ব্যাটসম্যান অবশিষ্ট ছিলো না। সেই হিসাবে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বলা যায় ম্যাচের ফলাফল নিশ্চিতভাবেই আফগানিস্তানের পক্ষে যাবার কথা। অতীতে আমরা কিছু কিছু ম্যাচে বাংলাদেশকে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো খেলতে দেখেছি সত্যি। আবার অনেক ম্যাচেই সম্ভাবনা কিংবা প্রত্যাশার বেলুন নিমিষে চুপসে যেতেও দেখেছি। একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেকগুলো জয় এসেছে। আশা জাগানিয়া, হতাশা কিংবা আক্ষেপ জাগানিয়া ম্যাচও দেখেছি অনেক।
চাকুরি আর ব্যস্ততার কারণে এখন ক্রিকেট খেলা আগের মতো দেখা হয় না এবং মাঠে গিয়েও খেলার সুযোগ হয় না। একসময় বাংলাদেশের খেলা দেখার জন্য অনেক বেশি অস্থির থাকতাম। কবে খেলা শুরু হবে, অনেক আগে থেকেই দিনগণনা শুরু করতাম। খেলার দিন তাড়াতাড়ি সব কাজকর্ম শেষ করে গোসল, নামাজ, খাবার শেষ করে রেডি হয়ে টিভির সামনে বসে পড়তাম। অনেক রাতে যেসব খেলা শুরু হতো সেগুলো দেখার জন্য এ্যালার্ম সেট করে ঘুমাতে যেতাম। এমনকি টেস্ট ম্যাচেও পাঁচদিন একটানা বসে খেলা দেখতাম। কখনো কখনো স্টেডিয়ামে সরাসরি গিয়ে খেলা দেখতাম। ক্রিকেট নিয়ে আমার মতো পাগল ভক্তরা নিশ্চয়ই সব সময় একটু বেশি অস্থির, উত্তেজিত ও আবেগী হয়ে থাকেন ৷ যেদিন বাংলাদেশ সম্ভাবনা জাগিয়ে হেরে যেতো কিংবা জয় পাওয়া উচিত এমন ম্যাচ হেরে যেতো কিংবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের কাছে হেরে যেতো, সেদিন মনটা এতো বেশি খারাপ হতো যে কিছুই ভালো লাগতো না। ঘুম, খাবার-দাবার, পড়াশুনা সবকিছুতেই সাংঘাতিক ব্যাঘাত ঘটতো। অথচ বিপরীত অবস্থা ছিলো বাংলাদেশের জয়ের দিন। সেদিন সব কিছুই ভালো লাগতো। শরীর ও মনে আনন্দ খেলা করতো। পড়াশুনা ভালো হতো। মাথা হালকা হয়ে যেতো। চোখে-মুখে উজ্জ্বল আভা থাকতো। সবাই মিলে খুব মজা হতো! মনে হতো মাঠে আমরা নিজেরাই খেলেছি, নিজেরাই জিতেছি। বড় দলের সাথে জিততে পারলে যেন বিশ্বজয় হয়ে যেতো। সে আনন্দ একেবারেই অন্য রকম ছিলো। বাংলাদেশের জয়ে রাস্তায় রাস্তায়, পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে আনন্দ মিছিলও হতে দেখেছি। অনেক সময় আমিও মিছিলে সামিল হয়েছি।
বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের প্রথম ম্যাচটি স্টেডিয়ামে বসে দেখার সুবাদে আশেপাশে দর্শকদেরকে প্রত্যেক বলে মন্তব্য করতে শুনেছি। চিৎকার করে আফিফ আর মিরাজকে প্রতি মুহূর্তে পরামর্শ, সাহস ও উৎসাহ দিচ্ছিলেন- ধীরে খেলো। টিকে থাকো।’ একটা চার বা ছয় হাঁকালেই বলে উঠতো- আউট হয়ো না ভাই, এতো রিস্ক নিও না’ ইত্যাদি কতো কথা, কতো বিশ্লেষণ। মূলত স্টেডিয়ামের গ্যালারি কিংবা টিভির সামনে যারা খেলা দেখে সময়ে সময়ে এমন মন্তব্য করে থাকেন যেন সবাই একেকজন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। তারা মনে করে যে কোনো কঠিন সময়ে তাদেরকে মাঠে নামিয়ে দিলে তারা খেলোয়াড়দের চেয়েও ভালো খেলে দলকে জিতিয়ে দিতে পারবে। বোলার মার খেলে দর্শক হিসেবে তারা যেন বুঝে যায় কোন জায়গায় বল করলে বা কীভাবে বল করলে বোলার মার খাবে না! ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। অথচ বোলার কেন এটা বুঝে না! একজন ব্যাটসম্যান কেন স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারে না! প্রয়োজন অনুযায়ী মাথা ঠিক রেখে খেলতে পারে না! কেন পেশাদারিত্ব বজায় রেখে এবং মেজাজ ঠিক রেখে খেলতে পারে না ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ও চিন্তা দর্শককে অস্থির এবং উত্তেজিত করে তোলে। হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়। কেননা দর্শকরা ক্রিকেটকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের ভাবনায় কিছুই হয় না। যা হয় মাঠে যারা খেলছেন তাদের পারফরম্যান্স দিয়েই হয়। সবসময়ই খেলোয়াড়রা দলের এবং নিজের পরিকল্পনা মতোই খেলেন। কখনো জয় আসে, কখনো পরাজয়। খেলার ধর্ম এটাই। তবে এটা সত্য, আপনি যতোই ভালো খেলোয়াড় হয়ে থাকেন আপনার সামান্য ভুল, খামখেয়ালিপনা কিংবা কঠিন পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়লে আপনার পরাজয় অনিবার্য। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, এটা আমরা জানি। তারপরও আমাদের দর্শকরা যেন কিছুতেই খেলোয়াড়দের ভুল মানতে নারাজ। জয়ের পর যেমন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে ভুলে না তেমনি পরাজয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ কিংবা সমালোচনা করতেও ভুলে না।
আফগানিস্তানের সাথে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচটি মনে হয় হারার দ্বারপ্রান্ত থেকেই জিতে গেলাম। কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দুই ব্যাটারের অনবদ্য ব্যাটিং নৈপুণ্যে শেষ পর্যন্ত আমরা জয়ের বন্দরে পৌঁছে গেলাম। অনেক বড় জয় বলা যায় এটিকে। এতে ক্রিকেটরই জয় হয়েছে। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে টিকতে পারা এবং শেষে সফলভাবে শেষ করতে পারাটা যে কোনো খেলার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক পেশাদার খেলোয়াড়কেওভুলে যেতে দেখি। মেজাজ হারাতে দেখি। কিন্তু এই ম্যাচটি লো-স্কোরিং ম্যাচ হলেও দলের ছয়জন অভিজ্ঞ ও স্বীকৃত ব্যাটসম্যান দ্রুত আউট হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আফিফ ও মিরাজ যে কতটা চাপে পড়েছিলো তা অনুমান করা খুবই সহজ। তারপরও তারা দুইজনেই খেলেছেন একদম স্বাভাবিক খেলা। পরিস্থিতি বুঝে একেবারে নিয়ম মেনে মেজাজ ঠিক রেখেই খেলেছেন শেষ অবধি। অতিরিক্ত উত্তেজনা, আবেগ কিংবা খামখেয়ালিপনা অন্তত এই ম্যাচে তাদের কাছ থেকে লক্ষ্য করা যায়নি। তাঁদের অসাধারণ পারফরম্যান্স ও বাংলাদেশের এই জয়ে দর্শকরাও ভীষণ খুশি, উল্লসিত এবং ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চয়ই আরও বেশি আশাবাদী হবেন।
আমরা যারা খেলা কিছুটা বুঝি, খেলা দেখি তারা অনেক সময় মনে হয় খেলোয়াড় বা খেলা বিশেষজ্ঞদের চেয়ে বেশি বুঝি। তবে একজন ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে কিংবা শুধু একজন দর্শক হিসেবে আমাদের আবেগ, উৎসাহ, উত্তেজনা থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা হয়তো আন্তর্জাতিক মানের একটি খেলা কতটা ভিন্ন মানের, কতটা চাপের, কতটা উত্তেজনাকর, কত বড় পেশাদারিত্ব্বের, সর্বোপরি কতটা সহজ কিংবা কতটা কঠিন সেই হিসাব বুঝি না। বুঝতে চাই না। আমরা আমাদের জ্ঞান, আমাদের ভাবনা, আমাদের হিসাব দিয়েই যে কোনো খেলার প্রতিটি মূহুর্তকে মূল্যায়ন করি, বিচার করি। তবে একজন খুঁতখুঁতে দর্শক কিংবা একজন ক্রিকেট জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির ক্রিকেট বিশ্লেষণ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক হয় সেটিও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ক্রিকেটারদের বা টিম ম্যানেজমেন্টের বক্তব্য থেকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়। দর্শকরা খেলাকে ভালোবাসেন বলেই খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে আসেন কিংবা টিভির সামনে বসে পড়েন। কোনো খেলোয়াড় খারাপ খেললে কিংবা দল হেরে গেলে দর্শকদের মন খারাপ বা হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। তবে এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো বা উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত থাকাই বাঞ্চনীয়। দর্শক তার নিজের মতো করে ভাবতে পারে, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে বাস্তব কথা হচ্ছে, প্রতিটি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেটের মান, সামর্থ্য, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব ভিন্ন ভিন্ন। ক্রিকেটপ্রেমী ও দর্শক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশাও আমাদের ক্রিকেটের মান ও সামর্থ্য অনুযায়ী হওয়া যৌক্তিক। খেলায় হার-জিত থাকবেই, এটা মেনে নিতে হবে। অন্যদিকে আমাদের খেলোয়াড়দের উচিত দেশের জনগণ ও দর্শকদের প্রত্যাশাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে সর্বোচ্চ ভালো খেলার চেষ্টা করা এবং নিজের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি দেশের ক্রিকেটের মান উন্নয়নে বেশি মনোযোগী হওয়া। সকল পরিস্থিতিতে পেশাদার ক্রিকেটারসূলভ আচরণই তাঁদের কাছ থেকে কাম্য।
লেখক: সিনিয়র সহকারী কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, চট্টগ্রাম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।