জুমবাংলা ডেস্ক : আদানিকাণ্ডে তোলপাড় পুরো বিশ্ব। তাদের জালিয়াতি, প্রতারণা নিয়ে সারাবিশ্ব সরব। এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার একদিনেই আদানি গ্রুপ ৩৪০০ কোটি ডলারের বাজার হারিয়েছে শেয়ারবাজারে। এ নিয়ে অনলাইন বিবিসিতে সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাস লিখেছেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী গৌতম আদানি যুক্তরাষ্ট্রে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় উদযাপন করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত প্রকল্পে ১০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এখন ৬২ বছর বয়সী ভারতীয় এই ধনকুবের এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশে এবং বিদেশে তার উচ্চাভিলাস সম্বলিত যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা বিপন্ন হতে পারে। তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিভিন্ন বন্দর ও নবায়নয়যোগ্য জ্বালানির বিস্তৃত সাম্রাজ্যে আছে তার ১৬৯০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রসিকিউটররা অভিযোগ করেছেন তিনি ২৫ কোটি ডলারের ঘুষ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিজের সম্পদ বাড়াতে চেয়েছেন। ২০ বছর ধরে এই প্রকল্প থেকে লাভ পাবেন এমন পরিকল্পনায় কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য তিনি ও তার নির্বাহীরা ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে তা অস্বীকার করেছে আদানি গ্রুপ। তারা অস্বীকার করলেও এরই মধ্যে এই গ্রুপ এবং ভারতের অর্থনীতিতে আঘাত আসা শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে ৩৪০০ কোটি ডলার হারিয়েছে। এর ১০টি কোম্পানির সম্মিলিতভাবে বাজারে মূলধন ১৪৭০০ কোটি ডলারের। অভিযোগের কেন্দ্র রয়েছে আদানি গ্রিন এনার্জি গ্রুপ। তারা ৬০ কোটি ডলারের বন্ড বিক্রি করতে পারেনি।
ভারতের ব্যবসা ও রাজনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। দেশটিতে এখনও অবকাঠামো খাতে শীর্ষ স্থানীয় আদানি গ্রুপ। তারা ভারতের অর্থনীতিকে গভীর থেকে নাড়া দিয়েছে। আদানি গ্রুপ পরিচালনা করে ১৩টি বন্দর (শতকরা ৩০ ভাগ মার্কেট শেয়ার), সাতটি বিমানবন্দর (শতকরা ২৩ ভাগ প্যাসেঞ্জার ট্রাফিক) এবং ভারতের দ্বিতীয় বৃহৎ সিমেন্ট ব্যবসা (বাজারের শতকরা ২০ ভাগ)। ৬টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে বিদ্যুতে আদানি ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে আদানি পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন চালিত প্রকল্পে ৫০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার অঙ্গীকার করেছেন। পাশাপাশি ৮০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন পরিচালনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছেন। নবরূপে উন্নয়ন করছেন ভারতের সবচেয়ে বড় বস্তি। তার অধীনে কর্মসংস্থান হয়েছে কমপক্ষে ৪৫০০০ মানুষের। ফলে সারাদেশে তার বিনিয়োগ বড় রকম প্রভাব ফেলছে।
গৌতম আদানি: এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনী
গৌতম আদানির বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষামূলক প্রকল্পের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় আছে কয়লা খনি। আফ্রিকায় আছে অবকাঠামোগত প্রকল্প। তার প্রকল্পগুলোতে নরেন্দ্র মোদির অগ্রাধিকারমূলক নীতির প্রতিফলন আছে। তার মধ্যে অবকাঠামো থেকে শুরু করে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। সমালোচকরা তার সমালোচনা করলেও পেছন দিকে ফিরে তাকাননি। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদি ও গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। তারা দুজনেই আদানির প্রশংসা করেছেন। ভারতের সফল অন্য ব্যবসায়ীদের মতোই আদানি সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন বিরোধী দলীয় অনেক নেতার সঙ্গেও। এর ফলে তাদের রাজ্যগুলোতেও বিনিয়োগ করেছেন আদানি।
ভারতীয় ব্যবসা নিয়ে দীর্ঘ লেখালেখি আছে সাংবাদিক পরানজয় গুহা ঠাকুরতার। তিনি বলেন, এই ঘুষ দেয়ার অভিযোগ বিরাট আকারের। দীর্ঘ সময় ধরে আদানি ও মোদিকে আলাদা করে দেখা যায় নি। এটা হলো ভারতে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার একটি চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের হিন্ডেনবার্গ রিসার্সের ২০২৩ সালের একটি রিপোর্টে স্টক নিয়ে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। তারপর প্রায় দু’বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন আদানি। কিন্তু তার মধ্যেই এই আঘাত এসে হানা দিলো।
আদানি যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তবুও তাতে শেয়ারবাজারে ক্রয়বিক্রয়ে বড় রকম প্রভাব ফেলেছে। ভারতে শেয়ারবাজার রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান এসইবিআই। তারা এই অভিযোগ তদন্ত করছে। উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আদানি তার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন এবং দেখানোর চেষ্টা করছেন যে, হিন্ডেনবার্গ গ্রুপ যেসব অভিযোগ করেছে তা বেশ আগের। তা সত্য নয়। তার কোম্পানি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আসলেই খুব ভালভাবে কাজ করছে। গত এক বছরে তা সমসাময়িক সময়ে বেশ কিছু নতুন চুক্তি ও বিনিয়োগ নিয়ে চুক্তি হয়েছে। তার মধ্যে এই অভিযোগ এই বিলিয়নারের ওপর যেন শারীরিক আঘাত হিসেবে এসেছে।
এখন দেশের ভিতর যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন তা কাটিয়ে উঠা আদানির জন্য খুব কঠিন হবে। নিরপেক্ষ বাজার বিশ্লেষক আম্বরিশ বালিগা বলেন, বাজারে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তা গুরুতর। বড় প্রকল্পগুলোতে এখনও বিনিয়োগ করবে আদানি। তবে তাতে বিলম্ব হবে। সর্বশেষ যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে বিশ্বজুড়ে আদানি তার যে সম্প্রসারণবাদের পরিকল্পনা করেছিলেন তার প্রতিও একটি আঘাত। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বিতর্কিত বিদ্যুৎ চুক্তি করার কারণে তিনি এরই মধ্যে যথাক্রমে কেনিয়া ও বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির লি কং চোইন প্রফেসর নির্মলয়া কুমার বলেন, এই ঘুষকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ পরিকল্পনাকে থামিয়ে দেবে।
তারপর কি?
এরই মধ্যে গৌতম আদানিকে গ্রেপ্তারের জন্য জোর আবেদন করেছেন রাজনীতিক, বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি এ ইস্যুতে পার্লামেন্টকে উত্তপ্ত করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্মলয়া কুমার মনে করেন, ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়া নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ ঘুষ দেয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে চোখ চড়কগাছ। আমি মনে করি এই ঘুষকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কিছু নাম সম্পর্কে জানে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের রাজনীতিতে এ নিয়ে হট্টগোল হওয়ার আশঙ্কা আছে। সামনে আরো অনেক কিছু আসছে। এখন নিজেদের রক্ষা করার জন্য আদানি টিম সর্বোচ্চ আইনজ্ঞদের ভাড়া করবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, সবে তো আমরা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এখনও অনেক কিছু সামনে আসতে বাকি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ব্যবসায়িক সম্পর্ক নজরদারিতে থাকতে পারে, তবে তার বড় কোনো প্রভাব থাকবে বলে মনে হয় ন। কুগেলম্যান বলেন, সম্প্রতি শ্রীলংকায় একটি বন্দরের প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ব্যবসায়িক সম্পর্ক শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে। এই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক অনেক বড় ও বহুমুখী।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এখনও এটা পরিষ্কার নয় যে, আদানিকে টার্গেট করা যাবে। বিষয়টি নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন নতুন প্রশাসনের ওপর। তারা এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে কতটা সামনে এগিয়ে যেতে দেবে, তার ওপর নির্ভর করে অনেকটা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।